বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষকের অভাব, অপ্রশিক্ষণ, অবকাঠামোর অপ্রতুলতা, পাঠ্যপুস্তকের মানহীনতা, শিক্ষকদের মর্যাদা হ্রাস, রাজনীতির হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে শিক্ষার মান ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া, নিম্নমানের শিখন-শিক্ষণ ব্যবস্থা, বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার অবলুপ্তি, অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপ স্টাডি ভিত্তিক শিক্ষার অসুবিধা ইত্যাদি সমস্যাও বিদ্যমান। এই সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, যেমন – শিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, নীতি নির্ধারণে শিক্ষকদের মতামত গ্রহণ, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা পুনর্বহাল, অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রাজনীতি দূর করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং শিক্ষার মান নিরীক্ষণ। এছাড়াও, শিক্ষাব্যবস্থায় আরও বেশি রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ করা এবং গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান খুঁজে বের করার আবশ্যক।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রাথমিক শিক্ষার মতো একেবারে গোড়া থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নানারকম সংকট বিদ্যমান। এই সংকটগুলো শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের নয়, বরং সমগ্র জাতির উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। জাতীয় উন্নয়নের জন্য এই খাতের পুনর্গঠন অত্যন্ত জরুরি। শুধু জরুরি বললে ভুল হবে, বরং বলা উচিত “আবশ্যক”। এই লেখায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করার চেষ্টা করব। সেই সাথে সেসব সমস্যার সমাধানের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা-ও আলোচনা করব। তবে মনে রাখতে হবে যে এই এক লেখাতে সকল সমস্যা তুলে ধরা কিংবা তাদের ফলপ্রসূ সমাধান আলোচনা করা সম্ভব নয়। এ জন্য গভীরভাবে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এই লেখাতে “গভীর গবেষণা” সেই অর্থে করা হয়নি। তবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তাদের সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার প্রাথমিক একটা প্রচেষ্টা করা হয়েছে এই লেখাতে। এই প্রচেষ্টার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে গভীরভাবে গবেষণার মাধ্যমে আমরা কার্যকরী পদক্ষেপগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
আমাদের সংকট ও আমাদের চ্যালেঞ্জ
প্রাথমিক শিক্ষা একটি জাতির ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার মান যথেষ্ট উদ্বেগজনক। শিক্ষকদের অভাব, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, দুর্বল অবকাঠামো, পাঠ্যপুস্তকের মানহীনতা ইত্যাদি কারণে শিক্ষার মান ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পাওয়া, তাদের বেতন-ভাতা কম হওয়া, দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অসামঞ্জস্য ইত্যাদি কারণে শিক্ষকরা তাদের কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এই একই সমস্যা শুধু প্রাথমিক শিক্ষাতেই নয়, বরং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক – এই দুটো ক্ষেত্রেও দেখা যায়। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও চিত্র একই রকম। কারণ প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে সংকটে আক্রান্ত শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঢুকছে। এর সাথে যোগ হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব সংকট – শিক্ষকের অভাব, গবেষণার অভাব, পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শিক্ষার্থীরা কেবল ডিগ্রি অর্জনের জন্যই পড়াশোনা করে, তাদের মধ্যে জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কোচিং সেন্টারের মতো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোনরকমে মুখস্ত করিয়ে পরীক্ষা বসিয়ে যোগ্যতার চেয়ে বেশি ফল পাইয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে। পরবর্তীতে এসব শিক্ষার্থীরা দেশের বেকার সমাজে যুক্ত হওয়া ছাড়া আর তেমন কোনো কাজে আসে না।
সব সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে আমাদের একদম মূলে যেতে হবে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার করে লাভ নেই। কারণ শিক্ষার্থীরা স্কুল কলেজে যেভাবে শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে, তা যদি উন্নত করা না যায় – তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নত শিক্ষায়ও তাদের কোনো লাভ হবে না। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে খারাপ ফলাফল করে তারা হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়বে। তাই আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট ও চ্যালেঞ্জগুলো আগে বের করতে হবে। তারপর তার সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে।