বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষকের অভাব, অপ্রশিক্ষণ, অবকাঠামোর অপ্রতুলতা, পাঠ্যপুস্তকের মানহীনতা, শিক্ষকদের মর্যাদা হ্রাস, রাজনীতির হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে শিক্ষার মান ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া, নিম্নমানের শিখন-শিক্ষণ ব্যবস্থা, বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার অবলুপ্তি, অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপ স্টাডি ভিত্তিক শিক্ষার অসুবিধা ইত্যাদি সমস্যাও বিদ্যমান। এই সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, যেমন – শিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, নীতি নির্ধারণে শিক্ষকদের মতামত গ্রহণ, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা পুনর্বহাল, অবকাঠামো উন্নয়ন, পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রাজনীতি দূর করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং শিক্ষার মান নিরীক্ষণ। এছাড়াও, শিক্ষাব্যবস্থায় আরও বেশি রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ করা এবং গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান খুঁজে বের করার আবশ্যক।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রাথমিক শিক্ষার মতো একেবারে গোড়া থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নানারকম সংকট বিদ্যমান। এই সংকটগুলো শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের নয়, বরং সমগ্র জাতির উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। জাতীয় উন্নয়নের জন্য এই খাতের পুনর্গঠন অত্যন্ত জরুরি। শুধু জরুরি বললে ভুল হবে, বরং বলা উচিত “আবশ্যক”। এই লেখায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করার চেষ্টা করব। সেই সাথে সেসব সমস্যার সমাধানের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা-ও আলোচনা করব। তবে মনে রাখতে হবে যে এই এক লেখাতে সকল সমস্যা তুলে ধরা কিংবা তাদের ফলপ্রসূ সমাধান আলোচনা করা সম্ভব নয়। এ জন্য গভীরভাবে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এই লেখাতে “গভীর গবেষণা” সেই অর্থে করা হয়নি। তবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তাদের সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার প্রাথমিক একটা প্রচেষ্টা করা হয়েছে এই লেখাতে। এই প্রচেষ্টার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে গভীরভাবে গবেষণার মাধ্যমে আমরা কার্যকরী পদক্ষেপগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
আমাদের সংকট ও আমাদের চ্যালেঞ্জ
প্রাথমিক শিক্ষা একটি জাতির ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার মান যথেষ্ট উদ্বেগজনক। শিক্ষকদের অভাব, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, দুর্বল অবকাঠামো, পাঠ্যপুস্তকের মানহীনতা ইত্যাদি কারণে শিক্ষার মান ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পাওয়া, তাদের বেতন-ভাতা কম হওয়া, দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অসামঞ্জস্য ইত্যাদি কারণে শিক্ষকরা তাদের কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এই একই সমস্যা শুধু প্রাথমিক শিক্ষাতেই নয়, বরং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক – এই দুটো ক্ষেত্রেও দেখা যায়। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও চিত্র একই রকম। কারণ প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে সংকটে আক্রান্ত শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঢুকছে। এর সাথে যোগ হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব সংকট – শিক্ষকের অভাব, গবেষণার অভাব, পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শিক্ষার্থীরা কেবল ডিগ্রি অর্জনের জন্যই পড়াশোনা করে, তাদের মধ্যে জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কোচিং সেন্টারের মতো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোনরকমে মুখস্ত করিয়ে পরীক্ষা বসিয়ে যোগ্যতার চেয়ে বেশি ফল পাইয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে। পরবর্তীতে এসব শিক্ষার্থীরা দেশের বেকার সমাজে যুক্ত হওয়া ছাড়া আর তেমন কোনো কাজে আসে না।
সব সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে আমাদের একদম মূলে যেতে হবে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার করে লাভ নেই। কারণ শিক্ষার্থীরা স্কুল কলেজে যেভাবে শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে, তা যদি উন্নত করা না যায় – তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নত শিক্ষায়ও তাদের কোনো লাভ হবে না। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে খারাপ ফলাফল করে তারা হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়বে। তাই আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট ও চ্যালেঞ্জগুলো আগে বের করতে হবে। তারপর তার সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে।
আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যাগুলো কি কি?
শিক্ষকদের অভাব ও অপ্রশিক্ষণ: অনেক স্কুলেই পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নেই, যার ফলে একজন শিক্ষককে একটা শ্রেণিতে অনেক বেশি ছাত্রছাত্রীকে পড়াতে হয়। এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের যথাযথ মনোযোগ পায় না এবং শিক্ষার মান কমে যায়। আবার, অনেক শিক্ষকই পর্যাপ্ত শিক্ষণ প্রশিক্ষণ পাননি, যার ফলে তারা শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানকে কার্যকরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ কম এবং বেতন-ভাতাও তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় অনেক যোগ্য শিক্ষক এই পেশা থেকে বিরত থাকেন। ফলে, শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ শিক্ষকের অভাব দেখা যায়। এছাড়া, শিক্ষকদের মধ্যে নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতাও কম। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা আধুনিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
শিক্ষকের মর্যাদা: সমাজে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা দিন দিন কমছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ১৩ গ্রেডের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন, যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়, যা তাদের পেশাগত মানসিকতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়াও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কম হওয়ায় ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা না থাকায় যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিরা সুযোগ পেলেও শিক্ষকতায় না এসে অন্য পেশায় যোগ দিচ্ছেন।
নীতি নির্ধারণ ও শিক্ষকদের মতামতের অবমূল্যায়ন: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণে শিক্ষকদের মতামত প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে, যা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে একটি বড় অন্তরায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যারা সরাসরি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করেন, তাদের অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টি নীতি নির্ধারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, নীতিনির্ধারকরা বেশিরভাগ সময়ই শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই নতুন পদ্ধতি ও পাঠ্যক্রম প্রবর্তন করেন। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তনগুলি আসে, সেগুলো প্রায়শই কার্যকর হয় না এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা এবং মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থায় নীতিগত ত্রুটি দেখা দেয়, যা শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সঠিকভাবে শিক্ষকদের মতামত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করলে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে, যা একটি উন্নত জাতি গঠনে সহায়ক হবে।
বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার অবলুপ্তি: বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার অবলুপ্তি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মাধ্যমিক স্তর থেকে বিজ্ঞান, মানবিক, ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে এই শাখাগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহ ও ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে থাকে। তবে নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় সব বিষয়ের ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের আগ্রহের বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জনের সুযোগ কমিয়ে দেবে। এই পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকবে না এবং তারা ভবিষ্যতে বিশেষায়িত পেশায় প্রবেশের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্যও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা এই নতুন ব্যবস্থায় সংকুচিত হতে পারে। সুতরাং, বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার অবলুপ্তি বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত পরিকল্পনাকে অস্পষ্ট করে তুলতে পারে।
অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপ স্টাডি ভিত্তিক শিক্ষা: নতুন শিক্ষাব্যবস্থা অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপ স্টাডির ওপর ভিত্তি করে চালু হয়েছে। এই ধরনের শিক্ষাপদ্ধতিতে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, অনেক অভিভাবকই এ বিষয়ে সচেতন বা প্রশিক্ষিত নন। ফলে, শিক্ষার্থীরা প্রায়ই নিজেদের প্রচেষ্টা না করে ইন্টারনেট থেকে উত্তর কপি করে জমা দেওয়ার প্রবণতা দেখায়, যা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে চরমভাবে ব্যাহত করে। এতে শিক্ষার্থীরা বেশি বেশি কপি-পেস্টের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এদিকে, গ্রুপভিত্তিক কাজেও অনেকেই প্রয়োজনীয় সমন্বয় করতে পারছে না।
তাত্ত্বিক শিক্ষার দুর্বলতা: বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন পাঠ্যবইগুলোতে তথ্যের ঘাটতি ও গুণগত মানের অভাব রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহও কমিয়ে দিয়েছে।
অবকাঠামোর অপ্রতুলতা: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রধান সমস্যা হলো অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি, শৌচাগার, খেলার মাঠ, পানির সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব শিক্ষার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই অবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং তাদের অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। স্কুলগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকারি তহবিল বৃদ্ধি, দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতা গ্রহণ, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এবং প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ জরুরি।
পাঠ্যপুস্তকের মানহীনতা: বেশিরভাগ পাঠ্যপুস্তকই আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বইগুলোতে তথ্যের সঠিকতা, স্পষ্টতা এবং উপস্থাপনার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠে। অনেক সময় ভুল তথ্য, অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু এবং জটিল ভাষা ব্যবহারের কারণে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকগুলোকে বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হয়। এছাড়া, পাঠ্যপুস্তকগুলোতে ছবি, চিত্র এবং চার্টের অভাব বা তাদের মানহীনতা শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তোলে। ফলে, শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে অন্যান্য উৎস থেকে তথ্য খুঁজতে বাধ্য হয়, যা তাদের শিক্ষার গুণগত মানকে প্রভাবিত করে।
শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতির হস্তক্ষেপ: বাংলাদেশের শিক্ষার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার একটি প্রধান কারণ। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিণত করে। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, টেন্ডার প্রক্রিয়া, পাঠ্যক্রম নির্ধারণ ইত্যাদি সব কিছুতেই রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই হস্তক্ষেপের ফলে যোগ্য ব্যক্তির পরিবর্তে অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়, শিক্ষার মান নির্ধারণের পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং শিক্ষার মান ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। রাজনীতির এই হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষকরা তাদের কাজে মনোযোগ না দিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহের অভাব: বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষার্থীই পড়াশোনাকে একটা বোঝা মনে করে। খুঁজতে গেলে এর পেছনে নানা কারণ চলে আসবে। প্রথমত, পাঠ্যপুস্তকগুলোর মানহীনতা এবং শিক্ষকদের পড়ানোর পদ্ধতির একঘেয়েমি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান অর্জনের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য বিনোদনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাকে উপেক্ষা করে। তৃতীয়ত, কর্মসংস্থানের বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র চাকরি পাওয়ার জন্য পড়াশোনা করে, জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়। চতুর্থত, সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য বার্তা মাধ্যমে খেলা কিংবা বিনোদন জগতকে নিয়ে যতটা মাতামাতি হয়, শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোকিত মানুষদের নিয়ে তার সিকিভাগও আলোচনা হয় না। এসব কারণ একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের, সমস্যার গভীরে ঢুকলে আরও কারণ বেরিয়ে আসবে। ফলে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের পিপাসা কমে যাচ্ছে এবং তারা সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারছে না। এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হবে।
নিম্নমানের শিখন-শিক্ষণ ব্যবস্থা: বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশের নিম্নমানের শিখন-শিক্ষণ ব্যবস্থার ওপর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না, ফলে তাদের শিক্ষাজীবনের প্রায় ৪.৫ বছর কার্যত অপচয় হচ্ছে। ১১ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষার্থীরা মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণির যোগ্যতা অর্জন করছে, যা তাদের ভবিষ্যত দক্ষতা ও কর্মজীবনে প্রভাব ফেলছে। শিক্ষকদের অপ্রতুল প্রশিক্ষণ, বিদ্যালয়ের দুর্বল অবকাঠামো এবং নিম্নমানের পাঠ্যক্রম এসবের পেছনের প্রধান কারণ।
এই সমস্যাগুলো সমাধানের উপায়
শিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের অভাব একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্যা দূর করার জন্য এবং শিক্ষকদের যোগ্যতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, শিক্ষকদের আকর্ষণীয় বেতন, ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত যাতে তারা এই পেশাকে একটি আকর্ষণীয় কর্মসূচি হিসেবে দেখতে পায়। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত যাতে তারা আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের আরও ভালোভাবে শিক্ষা দিতে পারে। তৃতীয়ত, শিক্ষক নিযুক্তির ক্ষেত্রে যোগ্যতা এবং দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। চতুর্থত, শিক্ষকদের জন্য কেরিয়ার ডেভেলপমেন্টের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত যাতে তারা নিজেদেরকে উন্নত করতে পারে। পঞ্চমত, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা উচিত যাতে তারা সমাজে সম্মানিত পদে অধিষ্ঠিত বোধ করতে পারে। এইসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষকদের অভাব দূর করা এবং তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়ন করা সম্ভব।
শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা যতটা হওয়া উচিত, ততটা নয়। শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা জরুরি কারণ তারা জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে তোলেন। শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে তাদের বেতন ভাতা বাড়াতে হবে, কাজের পরিবেশ উন্নত করতে হবে এবং সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি হলে তারা নিজেদের কাজের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হবেন এবং শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শিক্ষা দিতে পারবেন। এছাড়াও সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা হবে তা হল মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিরা শিক্ষকতাকে তাদের পছন্দের পেশা হিসেবে প্রথমেই বেছে নেবেন। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নতি হবে।
নীতি নির্ধারণে শিক্ষকদের মতামতের মূল্যায়ন: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিক্ষকরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন এবং শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র সবচেয়ে ভালোভাবে জানেন। তাদের মতামতের মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন, নিয়মিত সভা-সম্মেলন, ওয়ার্কশপের আয়োজন করে শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় করা যেতে পারে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সার্ভে, প্রশ্নোত্তরের আয়োজন করে তাদের মতামত জানা যেতে পারে। অরাজনৈতিক শিক্ষক সংগঠনগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাদের মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ করা হলে শিক্ষাব্যবস্থায় সুষ্ঠু পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা পুনর্বহাল: বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় “বিষয় ভিত্তিক শিক্ষা” সংরক্ষণ করে তা আরও উন্নত করা সম্ভব যদি শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচনে স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং তাদের আগ্রহ ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বিশেষায়িত শিক্ষার সুযোগ প্রদান করা যায়। এর জন্য প্রতিটি স্তরে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমত বিষয় বেছে নিতে পারে। পাশাপাশি, বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, সমৃদ্ধ পাঠ্যক্রম, এবং পর্যাপ্ত শিখন সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতার ওপরও জোর দেওয়া উচিত, যা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করবে। এভাবে, বিষয় ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবলুপ্তি না ঘটিয়ে, বরং তার প্রয়োগ এবং প্রসার বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপ স্টাডি ভিত্তিক শিক্ষাকে পুনর্গঠন করা: বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপ স্টাডি ভিত্তিক শিক্ষার প্রাধান্য সীমিত করে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার জন্য, পাঠদানের প্রক্রিয়ায় আরও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি। প্রথমত, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের মৌলিক ধারণা ও তাত্ত্বিক জ্ঞান নিশ্চিত করা উচিত। গ্রুপ স্টাডির মাধ্যমে অর্জিত ফলাফল অধিকাংশ সময় ব্যক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি না করে কেবল সহপাঠীদের সঙ্গে সেখানকার প্রতিযোগিতায় সীমাবদ্ধ থাকে। সুতরাং, এই পদ্ধতির পাশাপাশি, ব্যক্তিগতভাবে মৌলিক বিষয়গুলোতে গভীর জ্ঞান অর্জনের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল চিন্তাভাবনার সুযোগ দেওয়া, ন্যায়সঙ্গত পরীক্ষামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য নিয়মিত পর্যালোচনা ও আপডেট করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাঠদানের কৌশল উন্নত করতে হবে, যাতে তারা গ্রুপ স্টাডির পাশাপাশি ব্যক্তিগত অধ্যয়নকে আরও কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারেন। এভাবে, অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপ স্টাডি ভিত্তিক শিক্ষার স্বল্পগুরুত্ব বজায় রেখে, একটি স্বতন্ত্র এবং ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
তাত্ত্বিক শিক্ষার মান উন্নয়ন: বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় তাত্ত্বিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত বিষয়বস্তুর গভীরতা ও প্রাসঙ্গিকতা বাড়ানো উচিত, যা শিক্ষার্থীদের মৌলিক ধারণা ও তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেবে। পাঠ্যপুস্তকগুলির গুণগত মান উন্নত করার পাশাপাশি, তাদের শিক্ষামূলক সঠিকতা এবং আধুনিকীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা জরুরি, যাতে তারা আধুনিক শিক্ষার কৌশল ও তাত্ত্বিক বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। তৃতীয়ত, পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের মূল্যায়ন করা হলে, সেই মূল্যায়নকে আরও ব্যাপক ও গভীরভাবে করার ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রগুলিতে তাত্ত্বিক ধারণা, বিশ্লেষণমূলক ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার পরীক্ষা নেওয়া উচিত। চূড়ান্তভাবে, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক মান নিশ্চিতকরণ এবং শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যাতে শিক্ষার মান সময়ে সময়ে পর্যালোচনা ও উন্নত করা যায়। এভাবে, তাত্ত্বিক শিক্ষার মান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে এবং এটি শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক শিক্ষাগত সফলতা নিশ্চিত করবে।
অবকাঠামো উন্নয়ন: বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি এবং খেলার মাঠ নিশ্চিত করা জরুরী। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন কম্পিউটার, ইন্টারনেট এবং স্মার্ট বোর্ড দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। তৃতীয়ত, গ্রামীণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য স্কুলগুলোতে সুপরিবেক্ষণে খেলাধুলা এবং বিভিন্ন কার্যক্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে দেশ হিসেবে হয়তো আমরা এসব বিষয়ে খুব বেশি খরচ করার মত সামর্থবান নই। তাই খুব ভালো হয় শিক্ষকদের সাথে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে – তাহলে হয়তো বর্তমান অবকাঠামোকে ঘিরেই কিছু বিকল্পব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে।
পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়ন: পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের প্রধান মাধ্যম। তাই পাঠ্যপুস্তকের মান যতো উন্নত হবে, শিক্ষার মানও ততো উন্নত হবে। পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন, পাঠ্যপুস্তকগুলোকে আরও আধুনিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব করা, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা করা, পাঠ্যপুস্তকে চিত্র, চার্ট ও গ্রাফের ব্যবহার বাড়ানো, এবং পাঠ্যপুস্তকগুলোকে নিয়মিত আপডেট করা। এছাড়াও, পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে প্রযুক্তির সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে। এইসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়ন করা সম্ভব।
শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রাজনীতি দূর করা: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতির প্রবেশ একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্যা দূর করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরি। প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করে কঠোরভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষক নিয়োগে দক্ষতা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে সুশিক্ষিত ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চতুর্থত, শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত থাকা নিষিদ্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতির প্রভাব কমাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে রাজনীতি দূর হলে শিক্ষার মান উন্নতি পাবে এবং দেশের উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা: বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেটের অপব্যবহারের বিকল্প হিসেবে শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। শিক্ষাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা, মেলা এবং কার্যক্রমের আয়োজন করা যেতে পারে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের বিষয়গুলোকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষাকে আরো মজাদার করা যেতে পারে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের শিক্ষণ পদ্ধতি আধুনিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব করে তুলতে হবে। স্কুল-কলেজে লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি এবং খেলার মাঠের উন্নয়ন করে শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বপ্ন ও লক্ষ্য গঠনে সহায়তা করে তাদেরকে অধ্যয়নের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে। এইসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা সম্ভব।
শিক্ষার মান নিরীক্ষণ: বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মান নিরীক্ষণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। প্রথমত, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখনফল মূল্যায়ন করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের দক্ষতা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, শিক্ষা উপকরণ এবং পাঠ্যক্রমের মান নিয়মিত মূল্যায়ন করতে হবে। চতুর্থত, অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছ থেকে মতামত নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার মান নির্ধারণ করা যেতে পারে। পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে তুলনা করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা বিশ্লেষণ করা জরুরি। শিক্ষার মান নিরীক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব সমস্যা রয়েছে তা চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধানের পথ খুঁজে বের করা সম্ভব।
শিক্ষাব্যবস্থায় আরও বেশি রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ
২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে, যখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট তাদের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করে, তখন থেকে শিক্ষা খাতে মোট জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সরকার সর্বোচ্চ ২.৪৯ শতাংশ জিডিপি বরাদ্দ করেছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। এরপর থেকে গত নয় বছরে এই বরাদ্দ ধীরে ধীরে কমেছে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এটি সর্বনিম্নে পৌঁছেছে (১.৬৯%), যা বর্তমান সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট। শিক্ষাবিদরা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭% বরাদ্দ দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন, যা কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের ১৯৭২ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। ইউনেসকোর হিসেবে মোট জিডিপি’র অন্তত ৬% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখা আবশ্যক। এ দুটো মানদন্ড হিসেব করলে বাংলাদেশ সে হিসেবে বাংলাদেশ শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে।
কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের ১৯৭২ সালের প্রতিবেদনে জাতীয় বাজেটের অন্তত ৩০% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করার কথা বলা আছে। অথচ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ১১.৮৮% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে। তার আগের বছরগুলোতেও সংখ্যাটি খুব একটা হেরফের হয়নি। কেবলমাত্র ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের ১৪.৩৮% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, জাতীয় বাজেটের প্রতিটি অর্থ বছরেই শিক্ষা খাত অতি অবহেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
তাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বর্তমানে দেশের মোট বাজেটের যথেষ্ট পরিমাণ অংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নেই, যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আরও বেশি বাজেট বরাদ্দ করার মাধ্যমে আমরা শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়ন, শিক্ষকদের যোগ্যতা বৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ উন্নত করতে পারব। সেই সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেটের সঠিক বন্টন ও দুর্নীতি দমন নিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর গুরুত্ব কি? গুরুত্ব অবশ্যই আছে। যেমন,
শিক্ষার মান উন্নয়ন: বেশি বাজেটের মাধ্যমে আমরা আধুনিক শিক্ষা উপকরণ, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি স্থাপন করতে পারব। এছাড়াও, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, পাঠ্যক্রমকে আরও আধুনিক ও প্রাসঙ্গিক করা সম্ভব হবে।
শিক্ষকদের আকর্ষণ: বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষকদের এই পেশায় আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন: স্কুল-কলেজের ভবন, শৌচাগার, খেলার মাঠ ইত্যাদি মেরামত ও উন্নয়ন করা যাবে।
শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ উন্নয়ন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
শিক্ষার সার্বজনীনকরণ: বেশি বাজেটের মাধ্যমে গ্রামীণ ও দূরবর্তী এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নয়ন করা এবং শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এই বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হলে কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। যেমন,
সরকারের অগ্রাধিকার: সরকারকে শিক্ষাকে উন্নয়নের অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য করতে হবে।
দাতা সংস্থার সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষা খাতে দুর্নীতি দমন: শিক্ষা খাতে দুর্নীতি দমন করে বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
… এবং গবেষণার বিকল্প নেই
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে প্রয়োজন মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কার্যকর সমাধান গ্রহণ করা। শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, নীতি প্রণয়নে তাদের অন্তর্ভুক্তি, বিষয় ভিত্তিক শিক্ষার পুনর্বহাল, এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও এগিয়ে নিতে পারি। এই উদ্দেশ্যে আরও গভীর গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে আমরা শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যার মূল কারণ নির্ণয় করতে পারব। এসব গবেষনার জন্য বিদেশি কোন সংস্থাকে ভাড়া করে আনার দরকার নাই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণার জন্য। এজন্য আমরা বিভিন্ন কনফারেন্স আয়োজন করতে পারি, জার্নালে গবেষনাগুলো প্রকাশে শিক্ষকদের উৎসাহ দিতে পারি। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কোন কোন দিকে জোর দেওয়া উচিত, পাঠ্যক্রমে কী ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত — এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষা সংস্কারের কাজ আরও সুসংগত ও কার্যকর হবে। গবেষণা শুধুমাত্র সমস্যা চিহ্নিত করবে না, বরং সমাধানের উপায়ও সুপারিশ করবে। গবেষণার মাধ্যমে আমরা একটি তথ্যভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সঠিক গবেষণা হলে আমাদের অন্য দেশের রেডিমেড শিক্ষাব্যবস্থা কপি-পেস্ট করার দরকার পড়বেনা। আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ও নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নিজেদের গবেষকদের গবেষণায় উঠে আসা সমস্যা ও সমাধানগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দিয়েই গড়ে তোলা সম্ভব।
শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার করার জন্য সরকার, শিক্ষক, অভিভাবক এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শুধুমাত্র সরকারের প্রচেষ্টায় এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। সরকারের উচিত অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা জাতীয় উন্নয়নের পথকে সুগম করবে।