চট্টগ্রাম : একটি শহর, একটি জেলা, একটি বিভাগ

আপনাকে যদি বলা হয় সারা বিশ্বের সেরা স্থানের তালিকায় কোন স্থানটিকে রাখবেন – আপনি কাকে রাখবেন? চিন্তায় পড়ে গেলেন? পৃথিবীর নামী দামী সব শহরের নাম লাইন ধরে মাথায় আসছে? আপনি কাকে রেখে কার নাম বলবেন আমি জানিনা। কিন্তু আমার লিস্টের একদম একনম্বর জায়গায় থাকবে – চট্টগ্রাম!

আগেই বলে নিচ্ছি – আমার এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কিছুটা নয়, বরং বিশাল পক্ষপাত রয়েছে। আমি নিজে কিন্তু “চিটাইংগা” নই। কিন্তু আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, মেট্রিক পরীক্ষা – সবই চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। চট্টগ্রামের ধুলা-বাতাস গায়ে মেখেই বড় হয়েছি। এ কারণে মনের গভীরে চট্টগ্রামের জন্য বি-শা-ল একটা জায়গা বরাদ্দ হয়ে আছে।

আমার কথা বাদ দিন, আমি যদি আপনাকে চট্টগ্রামের কিছু ছবি দেখাই তবে আপনিও হয়তো আমার দলে চলে আসতে পারেন!

চট্টগ্রাম শহরটা দেখতে কেমন? দিনের বেলা এক রূপ আর রাতের বেলা আরেক রূপ।

শহরের সাথেই রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। বিখ্যাত এই বন্দরের রাতের নয়নাভিরাম কিছু ছবি দেখি চলুন।

নদী দেখতে চান? চলুন দেখে আসি আকাশ থেকে তোলা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী।

নদীর পর সমুদ্র দেখবেন?

ব্যাপার না ঘুরে আসুন পতেঙ্গা সৈকত থেকে।

সমুদ্রে এসেছেন যখন তখন সূর্যাস্ত না দেখে গেলে কি হয়? সেটাও না হয় দেখে নেয়া যাক।

সমুদ্র আর ভালো লাগছে না? তাহলে চলুন পাহাড় দেখি। শহরের মাঝেই “টাইগার পাস” এলাকাটা চক্কর দিয়ে আসি। এটা কিন্তু আমার খুব পছন্দের জায়গা!

“বাটালি হিল” ই বা বাদ যাবে কেন। পাহাড় চূড়ায় উঠে দেখে নিন চট্টগ্রাম শহরটিকে।

নদী, সমুদ্র, পাহাড় দেখে ক্লান্ত? তাহলে চলুন ঘুরে আসি হ্রদ থেকে – ফয়েস লেক তার নাম।

ফয়েস লেক দেখা হলে ঘুরে আসুন ভাটিয়ারি লেক থেকে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলভূমি এই বাংলাদেশে পর্যটনের ক্ষেত্রে এবং দর্শনীয় স্থানের হিসাবে চট্টগ্রাম বিভাগ অন্য বিভাগ থেকে এগিয়ে আছে বেশ কয়েক ধাপ। পাহাড় এবং সমুদ্রের সন্নিবেশ ঘটেছে সুন্দরের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিভাগে। চট্টগ্রাম জেলায় আছে চন্দ্রনাথ পাহাড়, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, বাটালি পাহাড়, লালদিঘি, পারকী সমুদ্র সৈকত, ফয়েস লেক, থিম পার্ক আনন্দ ভুবন ইত্যাদি।

এসব শেষ করে এবার যাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাহাড় ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একবার ঢুকে পড়লে আর বের হতে মন চাইবে না। পাহাড়ের কোলে পড়াশোনার সুযোগ ক’জনের ভাগ্যেই বা জোটে?

আপনি কি জানেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রেল স্টেশন রয়েছে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনগুলোকে মাঝেমধ্যেই শিক্ষার্থীরা আপন রঙে রাঙিয়ে তোলে।

চাষাবাদের দিক থেকেও চট্টগ্রাম কম যায় না। চট্টগ্রামে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়। এছাড়া শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচুর শাকসবজির চাষ হয়। যেমন – বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, সাদা কুমড়া, লাউ, ঢেড়শ, ঝিংগা, চিচিংগা, শশা, বরবটি, সীম, মটরশুঁটি, টমেটো, মুলা, বীট, গাজর, শালগম, ফুলকপি, বাধাকপি, পটল করলা, বিভিন্ন রকমের শাক ইত্যাদি। ফলমূলের ক্ষেত্রে নারিকেলই প্রধান। তাছাড়া আম, কলা ও কাঁঠালের উৎপাদনও হয়ে থাকে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে প্রচুর তামাক চাষ হয়। চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা হওয়ায় এখানে প্রচুর লবন চাষও হয়।

চট্টগ্রামের অদূরের হালদা নদীর উৎসমুখ থেকে মদুনাঘাট পর্ষন্ত মিঠা পানির প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে বেশ উর্বর। বৃহত্তর চট্টগ্রামে দিঘী, বিল ও হাওড়ের সংখ্যা ৫৬৮ প্রায় এবং পুকুর ও ডোবার সংখ্যা ৯৫,৯৪১ প্রায়। মোট আয়তন ৮৫,৭০০ একর, কর্ণফুলী নদীর মোহনায় প্রায় ৬ লাখ ৪০ হাজার একর বিস্তৃত মাছ ধরার জায়গা হিসাবে চিহ্নিত। (তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)। আর তাই চট্টগ্রাম জেলা মাছচাষের জন্য আর রপ্তানির জন্য অনেক আগে থেকেই ঐতিহ্যগতভাবে বিখ্যাত। রপ্তানির ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছ হাঙ্গর, স্কেট, রে, হেরিং, রূপচাঁদা ও চিংড়ি উল্লেখযোগ্য।

আপনার কি জানা আছে – চট্টগ্রামের মাছ চাষ ও আহরনের অন্যতম উল্ল্যেখযোগ্য দিক হলে শুঁটকি । সোনাদিয়া, সন্দ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপাঞ্চল থেকে শুঁটকি মাছ চট্টগ্রামের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়। সারাদেশের শুঁটকির চাহিদা কিন্তু এই চট্টগ্রামই পূরণ করে।

চট্টগ্রামের মানুষ ভোজন রসিক এবং অথিতিপরায়ন হিসেবে অধিক পরিচিত। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহি খাদ্যের মধ্যে শুঁটকি মাছ , মধুভাত, বেলা বিস্কিট,বাকর খানি, লক্ষিশাক , কালো গরুর গোস্ত ভুনা , পেলন ডাল, মেজবানি মাংস, আফলাতুন হালুয়া, তাল পিঠা, নোনা ইলিশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

চট্টগ্রাম কিন্তু বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। কেন বাণিজ্যিক রাজধানী তা কি জানেন? চট্টগ্রাম বন্দর এর মাধ্যমে সারাদেশে পণ্য সরবরাহ করা হয় এবং দেশ থেকে বিদেশেও পণ্য রপ্তানি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর নগরী হিসাবে ব্রিটিশ-পূর্ব, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান পর্বে চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সবসময়ই এগিয়ে ছিল। সে সময়ই বন্দরভিত্তিক কর্মকান্ড ছাড়াও ব্রিটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়। পাকিস্তান-পর্বে চট্টগ্রামে ভারী শিল্প যেমন – ইস্পাত, মোটরগাড়ি, পাট, বস্ত্র, সুতা, তামাক, ম্যাচ,ঔষধ শিল্পের কারখানা ইত্যাদি গড়ে ওঠে। তাছাড়া অনেক বহুজাতিক কোম্পানির সদর দপ্তরও চট্টগ্রামে অবস্থিত। চট্টগ্রামের জাহাজ কাটা শিল্প অনেক আগেই থেকেই আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে চলেছে।

বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো বিভিন্ন খেলা (যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, বিলিয়ার্ড, টেবিল টেনিস, এথলেটিক্স, স্নুকার, দাবা ইত্যাদি) চট্টগ্রামে ও প্রচলিত। সেই সাথে চট্টগ্রামে ঐতিহাসিক ভাবে কিছু প্রাচীন খেলা এখনও চালু আছে, যেমন – জব্বারের বলীখেলা, কুস্তি, গরুর লড়াই. তুম্বুরু, চুঁয়াখেলা, ঘাডুঘাডু, টুনি ভাইয়র টুনি, তৈইক্যা চুরি, হাতগুত্তি, কইল্যা, কড়ি

, নাউট্টা চড়াই, ডাংগুলি, বৈচি, নৌকা বাইচ এবং আরও অনেক কিছু।

খেলাধূলার কথা যখন আসলোই, তখন জানিয়ে রাখি, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ দল যখন প্রথম বিশ্ব অলিম্পিকে অংশ নেয় তখন চট্টগ্রামের স্প্রিন্টার মোশাররফ হোসেন শামীম বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র ক্রীড়াবিদ ছিলেন। তিনি জাতীয় পর্যায়ে পরপর ৭ বার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। আইসিসি ট্রফি জেতা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দলনেতা ছিলেন আকরাম খান। কমনওয়েলথ গেমস থেকে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণপদক অর্জনকারী চট্টগ্রামের শুটার আতিকুর রহমান। আর নিচের এই ভদ্রলোককে নিশ্চয়ই পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না – ইনিও কিন্তু চট্টগ্রামের ধূলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছেন।

চট্টগ্রামের সাথে আমার সম্পর্ক জন্ম থেকে। যেই সেই সম্পর্ক নয় – একেবারে নাড়ির টান যাকে বলে! কম দেশ তো ঘুরি নাই। সেসব দেশের বিভিন্ন শহর-বন্দরও দেখেছি। কিন্তু চট্টগ্রামের মাটিতে পা দিলে চুম্বকের মত যে আকর্ষণটা পাই সেটা অন্য কোথাও পাইনা!

Leave a Reply