মুবারাকময় ঈদ কিংবা ঈদ মুবারাক

গত তিনটা ঈদ (ফিতর আর আদহা আলাদা করে ধরলে অবশ্য সংখ্যাটা দাঁড়ায় ছয়ে) দেশের বাইরে করার সময় মন মেজাজ খুব ত্যাড়া-ব্যাড়া হয়ে থাকত। জন্মের পর থেকেই কাছের মানুষজনদের নিয়ে ঈদ করার অভ্যাস। কাছের মানুষজন না থাকলে ঈদ যে কতটা স্বাদহীন পানসে হতে সেটা দেশের বাইরে না গেলে টের পেতাম না। বিদেশীরা তো আর ঈদ করেনা। তাই ঈদের দিনটার সাথে আর অন্য দশটা দিনের তেমন কোনই পার্থক্য থাকেনা। শুধুমাত্র সকালবেলা ঈদের নামাজ পড়তে গেলে মসজিদের সামনে আরো কিছু লোকজন দেখা যায় – এই যা, এর বেশি কিছু না, নামাজ আদায় করেই লোকজন ছুটে যায় নিজ নিজ কর্মস্থলে, কারো দিকে কারো তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই! একেবারে জঘন্য ঈদ বলতে যা বোঝায় সেটাই হয় বিদেশ-বিভুঁইয়ে। যারা বিদেশ থাকেন তাদের সবার কাছেই ব্যাপারটা এইরকম খারাপ লাগে কী না আমি তা জানিনা, তবে একদম ছোটবেলা থেকে পরিবারঘেঁষা বলেই হয়তো এই বর্ণহীন-দ্যুতিহীন ঈদের দিনটা আমার মন মেজাজকে ঈদের আগের রাত থেকেই চিরেচ্যাপ্টা করে রাখত। আল্লাহর অশেষ রহমত যে আমি এইবার আবার আমার কাছের মানুষদের সাথে নিয়ে ঈদ করতে পারছি! পরপর তিনবার দেশের বাইরে বিস্বাদ ঈদ করার পর কাছের মানুষদের সাথে নিজের দেশে নিজের শহরে নিজের বাসায় ঈদ করাটা যে কতটা আনন্দের হতে পারে সেটা নিজে অনুভব না করলে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। দোয়া করি সবার ঈদ যেন সত্যিকার অর্থেই মুবারাকময় হয়।

Continue reading মুবারাকময় ঈদ কিংবা ঈদ মুবারাক

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস

১লা আষাঢ় আজ! আরো ভালো করে বললে ১৪১৮ সালে আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ। কাগজে কলমে বর্ষা ঋতুর চলে আসার দিন। অলিখিতভাবে আরো কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বর্ষা কালবৈশাখীকে সঙ্গী করে তার স্বভাবসুলভ তেজের ছটা দেখিয়ে গিয়েছে। অবশ্য বর্ষা নিয়ে আমার খুব একটা উৎসাহ নেই। বর্ষাকাল আমার ভালোও লাগেনা। তবে কীনা আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের জন্য বর্ষাকে খুব একটা খারাপ ও লাগেনা!

raindrops
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর ...

 

Continue reading আষাঢ়স্য প্রথম দিবস

২০১১ – ঢাকা, বাংলাদেশ।

সপ্তাহ দুয়েকের কিছু বেশি হল নিজের দেশে আসলাম। নিজের দেশে! বাংলাদেশে! নিজের কাছেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা। এখনো স্বপ্নের মত মনে হয়। মনে হয় ঘুম ভেঙ্গে গেলেই আবার নিজেকে নেদারল্যান্ডে আবিষ্কার করব। প্লেন থেকে যখন সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে সবুজের মাঝে রূপালি ফিতার মত পেঁচিয়ে থাকা চিকচিকে নদীগুলোকে দেখছিলাম – তখন যে কী খুশি লাগছিল সেটা বলার মত নয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাথে কোলাকুলি করতে ইচ্ছা করছিল। প্লেনের জানালা দিয়ে এভাবে মনে হয় ঘন্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিলাম। ইট পাথরের জঙ্গল ঢাকাকে অদ্ভুত লাগে উপর থেকে। মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। প্লেন ল্যান্ড করার পর সেই মোহ ভাঙ্গল। এর মাঝে প্লেনের ভেতর কি কি হয়েছে কিছু খেয়াল নেই, এমনকি এয়ারহোস্টেস কোনও খাবারদাবার অফার করে গেছে কীনা তাও জানিনা। পায়ের নীচে তখন সবুজ বাংলাদেশ, এ সময় এয়ারহোস্টেস নিয়ে কে মাথা ঘামায়?


Continue reading ২০১১ – ঢাকা, বাংলাদেশ।

খোঁজ দ্যা সার্চ: খোঁজাখুঁজি’র এক কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য!

আমাদের বাংলা সিনেমার ইতিহাসে মহাকাব্যের সংখ্যা সম্ভবত হাতে গোনা – বেদের মেয়ে জোছনা (নাকি জোৎস্না?), রূপভান, নবাব সিরাজুদ্দৌলা ও সোহরাব-রুস্তম ছাড়া স্মৃতি হাতড়ে আর কিছু বের করতে পারলাম না। তবে ডাইহার্ড ফ্যানদের দাবীর মুখে মাহমুদ কলি, ওয়াসিম কিংবা ইলিয়াস কাঞ্চনের একগাদা রাজা-বাদশাহ-জমিদার-প্রজা টাইপ সিনেমাগুলোকে গোনায় ধরলে অবশ্য অন্য কথা, গুনতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলতে হবে। সেই সাথে যদি যুক্ত হয় কিংবদন্তী পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু’র নাম- তাহলে তো কথা নেই! সংখ্যা যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে! এ সব অবশ্য মহাকাব্যিক সিনেমার কথা। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমাদের এই সব মহাকাব্য গুনতে টুনতে হবেনা। কারণ আমাদের এই আলোচনা এসব মহাকাব্যিক বাংলা সিনেমা নিয়ে নয় বরং কালোত্তীর্ণ এক মহাকাব্য নিয়ে! আর এখনও পর্যন্ত বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ‘কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য’ কিন্তু একটিই নির্মিত হয়েছে, সেটা হল – “খোঁজ দ্যা সার্চ”!

Khoj the search

প্রথমেই একটা সাফ কথা জানিয়ে দেই – আমি বাংলা সিনেমার একনিষ্ঠ দর্শক নই। তাই আমার রিভিউকে রামায়ন ধরে নেবার কোন কারণই নেই। এই ছবি দেখার পর হাত এতই নিশপিশ করছিলো যে এর একটা রিভিউ না লিখলে বদহজম হয়ে যাবার জোগাড় হচ্ছিল। তাই নিজের হজমকে বদ হওয়া থেকে রক্ষা করতেই এই দাওয়াই। প্রশ্ন আসতেই পারে যে কেন এই ছবিকে “কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য” বললাম? এই সিনেমাটির ট্রেইলার দেখে যা ভেবেছিলাম, চাক্ষুষ পুরো সিনেমাটি দেখার পর মনে হচ্ছে যে “কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য” বললেও এই ছবি সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করা হয়না। কিন্তু আর কোন বিশেষণ মাথায় এলোনা দেখে আপাতত এই বিশেষণেই থাকি। কালোত্তীর্ণ এই সিনেমাটির ‘দুর্ধর্ষ’ ট্রেইলার দেখে যারা এটাকে রস-কষহীন অ্যাকশন সিনেমা হিসেবে ভেবে নিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যেই বঙ্গদেশীয় কবি বলেছেন “চকচক করলেই সোনা হয়না” – ট্রেইলার দেখে সিনেমা বোঝা যায়না; অ্যাকশনের মোড়কে আবৃত এই সিনেমাটি আদতে আগাগোড়াই কমেডি একটা সিনেমা, আরো ভালো করে বললে ‘একটা ট্রেইলার’! জ্বী, ঠিকই শুনেছেন এটা একটা ট্রেইলার, বেশ বড়সর ধরনের ট্রেইলার, এই ধরুন গিয়ে পুরো দুই ঘন্টাব্যাপী বিশাল ট্রেইলার। কেন ট্রেইলার? সেই ব্যাপারে একটু পরে আসি, তারচেয়ে বরং চলুন কালোত্তীর্ণ এই মহাকাব্যের অন্য বিষয়গুলোও একটু দেখি।

সবার আগে আসুন নামকরণের ব্যাপারে। এই মহাকাব্যের নাম দেখে একজন অশিক্ষিত গন্ডমূর্খও বুঝবে যে এটা কত উঁচুমাপের সৃস্টি – ইংলিশ ও বাংলার মত দু’দুটো ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করতে হয়েছে এই সৃষ্টির নামকরণে। তাছাড়া নামটাও বেশ চিন্তাউদ্দীপক – “খোঁজ দ্যা সার্চ”। কিছু একটা খুঁজতে বলা হচ্ছে। কিন্তু কি খুঁজবেন? ঘোড়েল প্রশ্ন! তারচেয়েও ঘোড়েল প্রশ্ন হচ্ছে, যা খোঁজার কথা সেটা কি দর্শক হিসেবে আপনি খুঁজবেন নাকি সিনেমার কলাকুশলীরা খুঁজবে? তবে সারা ছবি দেখেও কূলকিনারা করতে পারলাম না যে আসলে কি খোঁজ করার কথা। আরো সহজভাবে বললে কি বা কে হারিয়ে গিয়েছে সেটাই বুঝলামনা! সিনেমার মাঝখানে অবশ্য নায়ক বাবাজীর স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছিল, শুধু হারিয়ে গিয়েছিল বললে ভুল হবে, বরঞ্চ ভিলেনপক্ষ সেটা ওভাররাইট করে নিজেদের বানানো তথ্য নায়ক সাহেবের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল! ভাবছেন সাইফাই মুভি’র মত কোন গুন্ডা-ডাক্তার আজগুবি কোন যন্ত্র দিয়ে এই মহাকর্মটি সাধন করেছে? মোটেইনা। গডফাদার শামসুদ্দীন নওয়াবের আর্মস সাপ্লাইয়ার ‘মাস্টার’ কেবলমাত্র একটি ডান্ডা, কয়েক গামলা পানি ও একটি হাডুড়ি দিয়ে এই কাজটি একা একাই করে ফেলেছেন! কাকতালীয়ভাবে এই মাস্টার অবশ্য ব্যক্তিগত জীবনে ডাক্তার, অন্তত নামের আগে ডাক্তার পদবী লাগায়, তার নাম হচ্ছে ডাঃ এজাজ। যা বলছিলাম … পুরো ছবিতে নায়কের স্মৃতি ছাড়া আর কোনকিছু হারিয়েছে বলে মনে হল না। অবশ্য স্মৃতি হারাবার ফলে সেটা ‘সার্চ’ করার জন্য নায়কের মাঝে কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। সে ধীরে সুস্থে তার কমেডি ছবি টেনে নিয়ে গিয়েছেন। ভালো কথা… আগেই বলেছিলাম যে এই ছবিটা কমেডি ছবি। ছবি দেখে দমফাটানো হাসি আসাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তাই দেখার সময় খুব সাবধান! ছবি দেখে কেউ হাসতে হাসতে অসুস্থ হয়ে পড়লে এই লেখক কোনভাবে দায়ী থাকবেনা।

মহাকাব্যের মহানায়কের নাম মেজর মাহমুদ হাসান, সে বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিস (বিএসএস) এর একজন স্পাই (!)। বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিসের অফিসটা বেশ ভালোই, সেখানে সবাই ইংলিশে কথা বলে। মেজর কামরুল নামের একজন আছেন, সে যেকোন বিষয়ে একেবারে গলা বাড়িয়ে ইংলিশে বুলি আওড়ানো শুরু করে, কিন্তু এই লোকই যখন নায়কের মাকে নায়কের মৃত্যুর খবর দিতে যায় তখন তার মুখনিঃসৃত বাংলা শুনে মনে হল উল্টা দিকে দৌড় দেই। তো এসব বাংলাদেশী ইংলিশম্যানদের খপ্পড়ে পড়ে বিএসএস’র চিফ সোহেল রানাকেও বাংলাদেশীদের সাথেই ইংলিশে বাক্যবিনিময় করতে হয়। তার এই কাজটা আরো কঠিন হয়ে যায় যখন আমেরিকা ফেরত নায়ক এসে ইংলিশ বুলি আওড়ানো শুরু করে। আহা কী সেই ইংলিশ! শুধু নায়কের ইংলিশের প্রশংসা করলে কম করে বলা হবে, নায়কের বাংলাও মাশাল্লাহ ‘সেইরকম’। শুনলে মনে হবে কেউ যেন কানের ভেতরটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। তবে একদিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় যে সিনেমাটিতে বেশ কিছু গূঢ় তথ্য রয়েছে, যেমন ধরুন, নায়কের মোহনীয় বাংলা ও সুললিত ইংলিশ উচ্চারণ কিন্তু সচেতন মহলে বিবিসি জানালার পাশাপাশি বিটিভি জানালা চালু করার একটা প্রচ্ছন্ন বার্তাও প্রেরণ করে।

সিনেমার নায়কের আগমন দৃশ্য বেশ চৌকস। বিএসএস চিফ যখন জানতে পারেন যে তার তুরুপের তাস মেজর মাহমুদ হাসান আম্রিকায় স্পাইয়িংয়ে ব্যস্ত তখনই দেখা যায় স্ক্রিন ধোঁয়ায় ভরে উঠে। সেকেন্ডের মাঝেই সেই ধোঁয়া কেটে বেরিয়ে আসে নায়কের দুধ-ঘি খাওয়া আদুল দেহ, পরের সেকেন্ডেই নায়ককে দেখা যায় সুইমিং পুলে সাঁতারে ব্যস্ত, পরের সেকেন্ডেই আমরা আবিষ্কার করি নায়ক লাস ভেগাসের আকাশে হেলিকপ্টার নিয়ে চক্কর খাচ্ছে এবং পরের সেকেন্ডেই নায়ককে লাসভেগাসের রাস্তায় কালো আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় অশরীরিভাবে পদচারণা করতে দেখা যায় (হেলিকপ্টারটি কোথায় ক্র্যাশ করেছিলো সেটা দেখায়নি যদিও)। লাসভেগাসে এক হোটেলের সামনে দুই আম্রিকান ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট এসে মাহমুদ সাহেবকে একটা ডিস্ক ভর্তি ইন্টেলিজেন্স দিয়ে গেল। এই ইন্টেলিজেন্স কিন্তু নায়কের মাথায় ভরার জন্য নয়, বরং ‘নিনো’ নামের বিশ্ব তামা-তামা করা এক সন্ত্রাসীর ইন্টেলিজেন্স ইনফরমেশন। পরের দৃশ্যে আমরা দেখি নায়ক সাহেব এক বিদেশিনীকে গাড়ি করে পুরো হলিউড ঘুরিয়ে তার বাসার দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে সিনেমায় তার সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ বাক্য উচ্চারণ করেন – “টেল মি ইবাউট নিনু”! তার পরের দৃশ্যে দেখা যায় বিএসএস চিফ তার তুরুপের তাস মেজর মাহমুদকে নিনোর কেস ফেলে দিয়ে বাংলাদেশে ডেকে পাঠান নতুন কেসের তদন্ত করতে। কী তামশা, নতুন কেসও হচ্ছে নিনো নিয়ে!

এরমাঝে ক্যাপ্টেন ববি’র আগমন ঘটে বিএসএস অফিসে। লাস ভেগাস ফেরৎ মেজর মাহমুদকে চিফ পরিচয় করিয়ে দেয় ক্যাপ্টেন ববির সাথে, সঙ্গে এও উল্লেখ করতে ভুলেননা যে মেজর মাহমুদের সাক্সেস রেট ১০০% মানে এখনো কোনকিছুতে ফেল্টুস হননাই নায়ক বাবাজী! চিরাচরিত নিয়মানুসারে ক্যাপ্টেন ববিকেই নায়কের সাথে কাজ করার জন্য জুটিয়ে দেয়া হল, হাজার হোক নায়িকা বলে কথা। এদিকে আমরা আবিষ্কার করি যে নায়কের স্বাস্থ্য মাশাল্লাহ ‘সেরকম’ হলেও নায়ক মনেপ্রাণে কিন্তু বেশ স্বাস্থ্যসচেতন। সেজন্যই সকালবেলা নায়ককে দেখা যায় জিন্স পড়ে গ্রামের রাস্তায় জগিং করতে, বুকডন দিতে, নারিকেল গাছের সাথে ঘুষাঘুষি করতে (সুপারি গাছ বা খেজুর গাছ ও হতে পারে, নিশ্চিত না)! তাছাড়া নায়ক আবার গল্ফপ্রেমী। সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতা, সাদা ক্যাপ পড়ে তাকে দেখা যায় গল্ফ মাঠে। একটা শট খেলেইই স্লোমোশনে মোহনীয় ভঙ্গিতে ভুড়ি দুলিয়ে নায়িকার দিকে আসতে আসতেই মন জয় করে ফেলে নায়িকার। আর যায় কই! সাথে সাথে শুরু হয় গান!

এভাবেই চলছিল। তারপর কাহিনী জট পাকিয়ে যায় যখন ১০০% সাক্সেস রেটের মেজর সাহেব একটা মিশনে ফেল্টুস মেরে গুন্ডাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তারপর গুন্ডারাজ ‘মাস্টার’ মেজরকে এমন ধোলাই দেয় যে মেজর আক্ষরিক অর্থেই নিজের নাম ভুলে গেল! এরপর থেকেই ছবিতে নায়কের নতুন নাম হয় ‘অনন্ত’। গোলাপ ফুলের উপর টার্গেট প্র্যাকটিস করে বেড়ে (!) উঠতে থাকে অনন্ত। সেই সাথে স্মৃতি হারিয়ে অনন্ত ক্রমাগত প্রশ্ন করে যায় – “আমি ক্যা?”। স্মৃতি হারানো অবস্থাতেই তার সাথে দেখা হয় ছবির আরেক নায়িকা বর্ষা’র সাথে। বর্ষা হচ্ছে মাস্টারের বস শামসুদ্দিন নওয়াবের একমাত্র বোন। শামসুদ্দিন নওয়াব হচ্ছে বাংলাদেশের গডফাদার যে কিনা স্যুটবুট পড়ে সারক্ষণ মুখে পাউডার আর ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে রাখে! যাই হোক, এক বিটকেলে পরিস্থিতিতে বর্ষাকে তার নিজের ভাইয়ের গুন্ডারা তাড়া করলে মহানায়ক একাই পুরো গ্যাংকে শুইয়ে দিয়ে মোটরবাইকে বর্ষাকে নিয়ে কেটে পড়ে। এদিকে নিনো আসে বাংলাদেশে। অনন্ত’র নাই স্মৃতিশক্তি! সেই সাথে ক্যাপ্টেন ববি’র সাথে প্যারালালি যুক্ত হয়েছে বর্ষা! বর্ষা ও নায়ক কক্সবাজারে। ঐ দিকে সিনেমার সেকেন্ড হিরো আবার বর্ষার বয়ফ্রেন্ড। টান টান উত্তেজনা! এমন সময়ই নায়ক বাবাজী সব স্মৃতি ফিরে পায়, মানে মাস্টার মশাই প্রাণের ভয়ে (নাকি বিরক্তিতে কে জানে?) নায়কের কাছে তার পরিচয় ফাঁস করে দেয়। অবশ্য না দিয়েও উপায় নাই, নায়ক কয়েক গন্ডা মানুষ মেরে মাস্টারের সামনে এসে ওভারকোট পড়ে “মা-আ-শ-টা-আ-র” বলে চেঁচিয়ে যেভাবে অস্ত্র ধরেছিল, তাতে এই বিরক্তিকর চরিত্রের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই মাস্টার সব হড়বড় করে বলে দেয় বলে আমার ধারণা। অবশ্য তারপরও মাস্টার এই বিরক্তিকর চরিত্রকে মারার জন্য একটা চেষ্টা নিয়েছিলেন। কিন্তু নায়ক আচমকা “মাশটার! আপনার মত পপেশনালের পেসন তেকে গুলি করা মানায়না” – বলে, মাস্টারকে গুলি করে নিজেই সিনেমা থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে দেয়। খুনোখুনি করার পর নায়কও তার নিজের পরিচয় পেয়ে কিংকংয়ের মত দেহখানা নিয়ে ঠিক ঠিক মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়!

হলিউডের টার্মিনেটরের পরের সিরিজগুলোর জন্য নায়ক অনন্তকে অফার দেয়া যেতে পারে। কারন তার রোবটিক অঙ্গভঙ্গি, যান্ত্রিক বাচনভঙ্গি কিংবা ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি – আর যাই হোক মানবসম্প্রদায়ের কাউকে মনে করিয়ে দেয়না। এর সাথে নায়কের শরীর-স্বাস্থ্য বিবেচনা করলে প্রাণীজগতে বড়জোর টেনেটুনে কিংকং পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে, এর বেশি কিছু নয়! তবে নায়ক মানুষ নাকি রোবট সেটা নিয়ে বিভ্রান্ত নায়িকাও প্রশ্ন করেছিল নায়ককে “আপনি রোবটের মত কেন?”। এমনকি ভিলেনকূলও মহা গবেষণা শুরু করে দিয়েছিল যে এই লোক মানুষ নাকি রোবট – তা নিয়ে। এই নায়কের পোশাক আশাক দেখে মনে হল নায়ক বঙ্গবাজারের বিশেষ ফ্যান। তার ছিড়া-বিড়া জামাকাপড় আর হাতে পায়ে বিভিন্ন পট্টি দেখে তাকে গুলিস্তানের ফ্যান বলেও মনে হতে পারে। তবে পরে জানলাম যে তার নিজেরই একখান গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে! সন্দেহ হচ্ছে এইসব টুটা-ফাটা কাপড়-চোপড় সেই ফ্যাক্টরিরই অবদান।

এতক্ষণ দেখি কেবল নায়কের কথাই বলে গেলাম, ছবির অন্যান্য ব্যাপারে কিছুই বললাম না! অন্য ব্যাপারগুলোও কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য ব্যাপারের মাঝে প্রথমেই আসি গানের ব্যাপারে। ইমন সাহা ও হাবিব ওয়াহিদের মত সংগীত পরিচালকরা কাজ করেছেন এই ছবিতে। গানগুলোও বেশ ভালো, তবে শর্ত হচ্ছে চোখ বন্ধ করে শুনতে হবে! যদি আপনি চোখ খোলা রেখে টুটা-ফাটা পোশাক পরিহিত বাংলার কিংকংএর হাত ছোঁড়াছুঁড়ি দেখতে দেখতে (একটা নায়ক যে কেবলমাত্র হাতকে নাড়াচাড়া একটা সিনেমার সব গান গেয়ে ফেলতে পারে সেটা এই সিনেমা না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর) গান শুনতে চান তাহলে সেটা নিজ দায়িত্বে করবেন। শুধু মনে রাখবেন যে আমি আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। তবে সেনাবহিনীর সুশৃংখল জীবনে অভ্যস্ত মেজর মাহমুদের এইসব ‘আইকনিক’ ফ্যাশান ও গানের সাথে হাদুমপাদুম নড়াচড়া দেখে আমাদের সেনাবাহিনীর মেজররা কাজেকর্মে উদাস কিংবা হতাশ হয়ে যেতে পারেন! এ ব্যাপারে সরকারে আশু দৃষ্টি দেয়া দরকার।

ছবির নির্মাণশৈলীতে রয়েছে নতুনত্ব। এই ছবিতে সম্ভবত নতুন ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করা হয়েছে – অনেকগুলো ছোট ছোট দৃশ্যকে একসাথে জুড়ে দিয়ে পুরো সিনেমাটা বানানো হয়েছে। তবে কিনা ঐসব ছোট ছোট দৃশ্যের নিজেদের ভেতর তেমন একটা মিল নেই! এই ছবির এডিটরকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। এক হাতে কাঁচি আরেক হাতে আইকা নিয়ে ফিল্মের রোল খালি কেটেছে আর জোড়া দিয়েছে। কয়েক মিনিটের কাজ! উপরে বলছিলাম না যে এটা একটা ট্রেইলার? ঠিক এ কারণেই বলেছিলাম। একটা ট্রেইলারে যেমন পুরো ছবির বিভিন্ন খাপছাড়া দৃশ্য দিয়ে জনমনে কৌতুহল তৈরি করে, এখানেও ঠিক তাই-ই করা হয়েছে। তাই এটাকে সিনেমা না বলে বিশাল বড় কোন ট্রেইলার বলাটাই বেশি মানানসই। সবচেয়ে দীর্ঘ ট্রেইলারের জন্য গিনেস বুকে একটা ট্রাই মারা যেতে পারে, বলা তো যায় না যদি লাইগ্যা যায়!

ছবির কাহিনীর গাঁথুনীও অভিনব। এর শক্তিশালী চিত্রনাট্য দর্শকদের চিন্তাশক্তিকে উস্কে দেয় অনেকগুলো প্রশ্ন ও ধাঁধাঁ দিয়ে। বিশেষ করে নায়িকা বর্ষা যখন সরাসরি মাথায় গুলি খায়, তারপর তাকে সে অবস্থায় ফেলে রেখে নায়ক চলে যায় নিনোকে ধাওয়া করতে, ঐ দিকে কিভাবে কিভাবে যেন নায়িকা গুলি খাওয়া মাথা নিয়ে পৌঁছে যায় হাসপাতালে। প্রশ্ন জাগে যে নায়িকা কিভাবে গেল হাসপাতালে? কারণ ইতিমধ্যেই সেকেন্ড হিরো অক্কা পেয়েছে। তাছাড়া বিএসএস চিফ সোহেল রানা শেষমেষ বেঁচে থাকে না মারা যায় সেটাও একটা অমিমাংসিত ধাঁধা। এদিকে গন্ডা গন্ডা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত নায়ক যখন নিনো’র সাথে শেষ মারপিট করতে যায় তখন কুদরতিভাবে তার সব অস্ত্র হাওয়া হয়ে গিয়ে একটা গ্রেনেড ছাড়া আর কিছুই থাকেনা। তারপরও ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে ঝুলে ঝুলে নিনোর প্যান্টের ভেতর কিভাবে কিভাবে যেন ঢুকিয়ে দেয় সেই গ্রেনেড। ফলাফল ট্রেনের ইঞ্জিনের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকা নিনোর জায়গায় মাঝারি আকারের ধোঁয়ার বিস্ফোরণ। অথচ পুরো রেলগাড়ীর ডিজেল ইঞ্জিনে একটা আচঁড়ও নেই! বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন তাহলে কি ধাতু দিয়ে তৈরি? বিস্ফোরণের পরপরই মাথার ঘিলুতে গুলি খাওয়া নায়িকাকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় নায়কের সাথে নাচগান করতে দেখা যায়। ঘিলুতে গুলি লাগলে চিকিৎসা কি? এদিকে অন্য নায়িকার কোন খোঁজ খবর নেই, কি হয় ক্যাপ্টেন ববির? মেজর কিংবা ক্যাপ্টেন হয়ে এত নাচানাচি আর গানের তালিম কোত্থেকে পাওয়া যায় – সেটা জানার বড়ই শখ ছিল। এক দৃশ্যে নায়ক লাফ দিয়ে ঘোড়ার উপর উঠতে গেলে দেখা যায় যে, ঘোড়া শেষ মুহুর্তে অনীহা প্রকাশ করে পিছিয়ে যায়। খুব জানতে ইচ্ছা করে কী চিন্তা করছিল তখন ঘোড়াটা?

সিনেমা শেষে এতসব উন্মুক্ত ধাঁধাঁ থাকার অর্থ কিন্তু একটাই – অদূর ভবিষ্যতে এই মুভির সিক্যুয়াল আসছে (আল্লাহ রহম কর)। কি হবে সেই সিক্যুয়ালের নাম? “পাইছি দ্যা ফাউন্ড”?

একটি ননটেকি পোস্টঃ আমি কেন উবুন্টু নিয়ে লাফালাফি করি

ইদানিং আমি লিনাক্স; আরো সূক্ষ্ম করে বললে উবুন্টু নিয়ে বেশ মাতামাতি করছি। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করি উবুন্টু প্রচার করতে। এই প্রচার করতে গিয়েই টের পেলাম লোকজনের মধ্যে কিছু জিজ্ঞাসা বারবার ঘুরে ফিরে আসে- কেন আমি উবুন্টুর প্রচার করি? উবুন্টু কি আমাকে এজন্য পয়সা দেয়? যদি পয়সা না দেয় তাহলে এভাবে প্রচার করে আমার কি লাভ? মজার ব্যাপার হচ্ছে এই প্রশ্নগুলো কিন্তু কোন লিনাক্স ব্যবহারকারীর মনে আসেনা। যারা উইন্ডোজ বা মাইক্রসফটের পণ্য ব্যবহার করে তাদের মনেই প্রশ্নটা আসে। এইবার নিশ্চয়ই ধাক্কা খেলেন! “যারা উইন্ডোজ বা মাইক্রোসফটের পণ্য ব্যবহার করে” – এর মানে কি? সবাইতো উইন্ডোজ ব্যবহার করে! নাহ, সবাই উইন্ডোজ ব্যবহার করেনা; এই যেমন আমি! আমি উইন্ডোজ ব্যবহার করিনা, বাসার ডেস্কটপেও না, নিজের ল্যাপটপেও না। আর আমার মত এরকম আরো অনেকেই আছেন। আর এ সংখ্যাটা কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে।

যাইহোক এবার উবুন্টু নিয়ে মাতামাতি করার কারনগুলো বলি।

প্রথমতঃ ক্যানোনিকাল হচ্ছে সেই কম্পানি যারা উবুন্টু নামের অপারেটিং সিস্টেমটা তৈরি করে, তারপর বিনামূল্যে সেটা সবাইকে বিতরণও করে। গুণে-মানে উবুন্টু উইন্ডোজ থেকে অনেক উন্নত, এটা শুধু আমার মতামত না যারা কম্পিউটার জিনিসটার কাজের ব্যাপার স্যাপারগুলো বুঝেন তারাও একবাক্যে একথা স্বীকার করেন। এখন একটা কম্পানি আমাকে বিনাপয়সায় একটা উন্নত অপারেটিং সিস্টেম দিচ্ছে, আমি সেটা ব্যবহারও করছি। বিনিময়ে আমারও তো কিছু দেয়া উচিত। এই বিনিময়টাই আমি দেই উবুন্টুর প্রচার আর প্রসার করে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- বিনাপয়সায় উবুন্টু দিয়ে ক্যানোনিকাল আমার স্বার্থ দেখছে আর আমি উবুন্টুর প্রচার করে ক্যানোনিকালের স্বার্থ দেখছি। যে আমার স্বার্থ দেখে তার স্বার্থ তো আমাকে দেখতেই হবে নাকি!

দ্বিতীয়তঃ পাইরেসি একটা বিশাল সমস্যা বাংলাদেশে। আমরা যেই চল্লিশ টাকার উইন্ডোজের সিডি কিনি, সেই সিডিটার আসল দাম কত জানেন? প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। আমরা যে কথায় কথায় ফটোশপ বা ইলস্ট্রেটর নিজেদের পিসিতে ইন্সটল করে ফেলি সেগুলোর দাম হচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মত। মাইক্রোসফট অফিসের দামও কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মত। তাহলে চিন্তা করুন তো এই যে আমরা চল্লিশ টাকা দিয়ে যেই সিডি/ডিভিডিগুলো কিনছি সেটার আসল মূল্য আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা যেগুলো কিনছি সেগুলো আসলে চোরাই কপি। আমরা চোরাই মোবাইল ফোন কিনিনা, চোরাই গাড়ি কিনিনা কিন্তু চোরাই সফটওয়্যার ঠিকই কিনছি। এমনও অনেকে আছেন যারা পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়েন, আল্লাহভীরু মানুষ, কিন্তু ব্যবহার করার সময় ঠিকই চোরাই সফটওয়্যার ব্যবহার করছেন। চোরাই জিনিস কিনে কি আমরা একজন চোরের সমান অপরাধ করছিনা? উপরন্তু টাকা দিয়ে কিনে আবার চোরকে উৎসাহ দিচ্ছি আরো সফটওয়্যার চুরি করার জন্য। এতে করে দেশের কম্পিউটার দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে চুরির জিনিস বিক্রি হচ্ছে, আর বেশি খোলামেলা হবার কারনে এটা যে বিশাল একটা অপরাধ সেটাও লোকজন টের পাচ্ছেনা (অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করছে)। ফলাফলস্বরূপ বাংলাদেশ সফটওয়্যার পাইরেসিতে দ্বিতীয় স্থান দখল করে আছে, যেখানে পাশের দেশ ভারতের অবস্থান একচল্লিশতম।এটাতো দেশের প্রতি একধরনের অপমান। নিজের দেশের অপমান কার কাছেই বা ভালো লাগে? তাই যত বেশি উবুন্টু (বা লিনাক্স) ব্যবহার করা হবে ততই আমাদের উপর থেকে চোরের খেতাব সরে যেতে থাকবে। একজন বাংলাদেশী হিসেবে দেশের নাম উজ্জ্বল করাকে আমি নিজের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে দেখি। সেজন্যই লোকজনকে পাইরেসি বাদ দিয়ে ওপেনসোর্স সফটওয়ারের দিকে আসার আহবান জানাই।

তৃতীয়তঃ ভাইরাস, সিস্টেম ক্র্যাশ, রিইন্সটলেশন, ডিফ্র্যাগমেন্ট – এইসব কঠিন কঠিন (!) শব্দগুলো উইন্ডোজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। অথচ উবুন্টুতে এগুলোর কোনটাই নাই। তাই যখন দেখি যে আমার আশপাশে লোকজন এইসব ঝামেলাকে অবলম্বন করেই অসহায়ের মত কম্পিউটার জিনিসটা চালায়, তখন নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগে। আমি নিজে কত সুন্দর ঝামেলাহীনভাবে পিসি চালাচ্ছি, অথচ অন্যরা কত কষ্ট করছে! প্রতিনিয়ত তারা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করছে, হরহামেশা সিস্টেম ক্র্যাশ করে নীল রংয়ের স্ক্রিন আসছে, রুটিন করে উইন্ডোজ রিইন্সটল করছে। ফলে নিজে থেকেই তাদের বোঝাই যে এইসব কঠিন কঠিন শব্দগুলো ছাড়াও কম্পিউটার চালানো যায়। আর সেই কম্পিউটারও খুব ভালোভাবেই চলবে। তবে সেজন্য উইন্ডোজ বাদ দিয়ে উবুন্টু ইন্সটল করতে হবে। শুধুমাত্র যেচে এসে পরোপকার করার জন্যই তাদের কাছে আমি উবুন্টুর কথা প্রচার করি। এটা বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার!

চতুর্থতঃ আমার নিজেরও কিছু স্বার্থ আছে। যত বেশি মানুষ উবুন্টু ব্যবহার করবে আমার নিজেরও ততবেশি সুবিধা হবে সবার সাথে সব কিছু শেয়ার করতে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেইঃ উইন্ডোজে যেমন এমএস অফিস সেরকম উবুন্টুতে আছে ওপেন অফিস। এমএস অফিসের .doc ফরম্যাট যেমন ঠিক সেরকম ওপেন অফিসে .odt ফরম্যাট। কিন্তু কাউকে কিছু লেখা পাঠাতে হলে আমাকে সেই .odt কে ওপেন অফিসেই .doc তে কনভার্ট করে পাঠাতে হয়, কারন সেই লোক উইন্ডোজ ব্যবহার করে। যাকে পাঠাচ্ছি সে যদি উবুন্টু ব্যবহার করত তাহলে আমাকে এই কষ্টটা করতে হতনা! তাছাড়া বেশি বেশি লোক উবুন্টু ব্যবহার করলে যেকোন সমস্যায় সাহায্য পাওয়া সম্ভব হবে। তাই এক্ষেত্রে নিজের কিছু স্বার্থও কাজ করে।

শুরুর প্রশ্নগুলোর উত্তর কি পেয়েছেন? আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশে উবুন্টু আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে সেটা খুবই ধীরে। সেজন্য প্রক্রিয়াটা সেভাবে চোখে পড়ছেনা। আমার প্রচারণায যদি এই প্রক্রিয়াটা আরেকটু তরান্বিত হয় তাহলে তো উপরি লাভ। এটা হয়তো বিশাল সাগরে এক বালতি পানি দেবার মত, স্থূলভাবে বোঝা না গেলেও সূক্ষ্মভাবে বোঝা যায়।


অবশেষে লিনাক্সে অভ্র আসিলো!

কোমলমতি এই নাদানের মরা কান্নায় বোধকরি অবশেষে অভ্র জনকের ধ্যান ভাঙ্গিল। তিনি অভ্রকে লিনাক্সের পরিসরে আনিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন। তারই ফলস্বরূপ বারোখান ঘন্টক পূর্বে সকল বাধা অতিক্রম করিয়া লিনাক্সের মহিমান্বিত জগতে অভ্র প্রবেশ করিল। লিনাক্স ব্যবহারকারিগনদের নিকট এই সংবাদ যেন ভাদ্র মাসের সুপরিচিত আউলাটক্কা গরমের মধ্যে ভারিবর্ষনের ন্যায় সুসংবাদের জলধারা স্বরূপ বর্ষিত হইয়াছে। লিনাক্স অনুরাগীগন অদ্য হইতে অভ্রের জাদুকর স্পর্শ লিনাক্সে চাখিয়া দেখিবার সুযোগ পাইবেন।

আপাতত ইহা কেবলমাত্র উবুন্টু ৯.০৪ এবং লিনাক্স মিন্ট ৭ এ পরীক্ষা করা হইলেও অতি শীঘ্রই ইহা অন্যান্য লিনাক্সের জন্য মুক্ত করা হইবে।

পরিশেষে যাহারা ইহা চাখিয়া দেখিতে চান তাহারা দয়া করিয়া এইখানে একটিবার ভ্রমন করিয়া আসুন।

লিনাক্স মিন্টে হড়বড় করিয়া চলিতেছে অভ্র!
লিনাক্স মিন্টে হড়বড় করিয়া চলিতেছে অভ্র!

একটি বর্ষাপ্লাবিত দিন!

বাংলাদেশে এসে অনেকদিন পর কুকুর-বিড়াক টাইপের মুষলধারে বৃষ্টি দেখলাম। কথা নাই বার্তা নাই রাত বারটার দিকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। ভ্যাপসা গরমের পর বৃষ্টি বেশ ভালোই লাগলো। রাতে আরামে ঘুমানো যাবে চিন্তা করেই বিছানায় চলে গেলাম! তাছাড়া আবার পরদিন আমার পুরনো কর্মক্ষেত্রে প্রাক্তন কলিগদের সাথে দেখা করার কথা। তাই এমন বৃষ্টির রাতে ঝরঝরে ঘুম হওয়াটা বেশ জরুরি ব্যাপার।

পরদিন সকালে সকাল আটটার দিকে ঘুম ভাঙলো। বাইরে তখনো বৃষ্টি হচ্ছে! একটানা বৃষ্টি হচ্ছে নাকি মাঝে বন্ধ হয়ে আবার শুরুর হয়েছে বোঝার কোন উপায় নাই। বন্ধ হয়ে থাকবে হয়তো, কারন টানা বৃষ্টি বাংলা দেশে দেখিনা বহুদিন। ছোটবেলায় এমন বৃষ্টি নামতো যে স্কুল ছুটি করে দেয়া হত, ঐদিনকে বলা হত রেইনি ডে। সেসময় ঝুম বৃষ্টি হলেই দোয়া পড়তাম যেন স্কুল বন্ধ ঘোষনা করে! সেরকম বৃষ্টি দেখিনা অনেক বছর। এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে দেখি আম্মু চলে এসেছে। প্রতিদিন সকালে ছোট বোনকে কলেজে দিয়ে আম্মু বাসায় চলে আসে। তবে আজকে ব্যতিক্রম, সঙ্গে দেখি বোনও চলে এসেছে? কাহিনী কি! পরে শুনি আজকে ওদের স্কুলে রেইনি ডে!

ছবিটি ২৯ শে জুলাইয়ের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠা ছাপা হয়।

আম্মুর কাছেই প্রথম শুনলাম যে ঢাকার রাস্তা ঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে! যেই ধানমন্ডি সহজে ডুবেনা সেটা পর্যন্ত পানিতে থইথই করছে, ধানমন্ডি লেক পানিতে টইটুম্বুর! বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন খবর পেতে লাগলাম- সাতাশ নম্বরে রাপাপ্লাজার সামনে নাকি মাথার উপর দিয়ে পানি যাচ্ছে, মানুষজন লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, রাস্তা ঘাটে গাড়িগুলো সব অচল হয়ে পড়ে আছে, কোন কোন জায়গায় নাকি গাড়ির ছাদ পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে- আরো কত কি! যাই হোক সব শুনেটুনে মনে হল আজকে সংগত কারনেই আর পুরনো কর্মস্থল পরিদর্শনে যাওয়া হবে না। শরীফ ভাইকে ফোনে জানালাম যে আসতে পারছিনা, ঢাকার অবস্থার বর্ননা দিলাম! বেচারা ঘুম ঘুম চোখে কি শুনল কে জানে তবে বেশ খুশিই হল মনে হল, একটা টানা ঘুম দিতে পারবে অন্তত।

বাসায় বড়মামা ফোন দিল, মালিবাগে আমার নানুবাড়ির একতলায় হাঁটু পানি। এইটা একটু ভয়ঙ্কর ব্যাপার, মালিবাগ এলাকাটা এমনিতেই একটু নিচু, তাই বৃষ্টি হলে পানি জমে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সেই পানি ঠেকাতে ঘরেরে সামনে এবং গেটের সামনে ইট সিমেন্ট দিয়ে সাত-আট ইঞ্চি উঁচু ছোটখাট বাঁধ দেয়া হয়েছিল। সেই বাঁধ টপকে পানি ঢুকে পড়েছে। পানি উঠার প্রথম পর্বে একতলায় নাকি পানি সেচার কাজ হচ্ছিল, এখন বাইরের পানি আর ঘরের পানির লেভেল এক হয়ে যাওয়াতে সেই কাজ আপাতত বন্ধ!

এরপর ফোন দিল মিনহাজ ভাই, তার বাসায়ও নাকি হাঁটু পানি! এইবার ভালো বিচলিত হলাম, যতদূর জানি এই লোক থাকে তিনতলায় বা চারতলায়, অর্থ্যাৎ ছাদের ঠিক নিচের ফ্লোরেই। তারমানে কি এতই বৃষ্টি হল যে তার বাড়ির একতলা দোতলা ডুবে গিয়ে তিনতলার ফ্লোরও ডুবিয়ে দিয়েছে! পরে জানলাম খবর অন্য, উনাদের ছাদের পানি জাবার পাইপ ব্লকড হয়ে যাওয়ায় ছাদের সব পানি সিঁড়ি দিয়ে তাদের বাসায় চলে এসেছে!

ঢাকার ষাট বছরেরে ইতিহাসে নাকি সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে সেদিন, ৩৩০ মিলিলিটার! দশ ঘন্টার সেই বৃষ্টি হলে ঢাকা হয়ে যায় একটা বড়সর লেক – কোন ছাগল যে ঢাকাকে আধুনিক শহর নাম দিয়েছিল! টিভি আর খবরের কাগজে দেখলাম চিরাচরিত সেই দৃশ্য- সিটি কর্পোরেশন দোষ দিচ্ছে ওয়াসার ঘাড়ে আর ওয়াসা দিচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ঘাড়ে। অথচ জলাবদ্ধতা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নাই- যেন এইটা তাদের কাজ না! অশিক্ষিত মূর্খ একেকটা সরকার আর তাদের গবেট পা চাটা সরকারি লোকগুলোর পাল্লায় পড়ে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে ভাবতে বসলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। হয়তোবা আজ থেকে আরো চল্লিশ বছর পর ইতিহাস বইয়ে লেখা থাকবে “দক্ষিন এশিয়ায় বাংলাদেশ নামে একটা দেশ ছিল যার অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলে পুরো বিলুপ্ত করে ফেলেছে”!

একজন মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

তখন ক্লাশ সিক্সে পড়ি, কিশোর বয়স। কমিক্সের পাশাপাশি তিনগোয়েন্দা পড়া শুরু করেছি মাত্র। একদিন ক্লাশে মুশফিকের কাছে একটা বই দেখলাম, নাম “দুষ্ট ছেলের দল”, লেখকের নাম পরিচিত জাফর ইকবাল! পরিচিত এই হিসেবে যে আমি জাফর ইকবাল কে চিনতাম, আসলে একজন জাফর ইকবালকেই আমি চিনতাম, সে লোক সিনেমার হিরো ছিলো! আমি তো অবাক, সিনেমার হিরোরা বই লিখতে পারে বলে আমার কোন ধারনা ছিলোনা, তাও আবার কিশোর উপন্যাস! মূশফিক জিজ্ঞেস করলো যে বইটা আমি পড়ব নাকি! আমি তখন কিশোরদের বই বলতে চিনি তিনগোয়েন্দা, গোয়েন্দা রাজু, ফেলুদা, শঙ্কু – এইসব। তখন আমার প্রিয় লেখক ছিল সত্যজিত রায় (এখনো আছে!)। সেই লোকের গল্প, উপন্যাস, ছড়া, আঁকাআঁকি- সবকিছুতেই আমি মুগ্ধ! তাই কোথাকার কোন সিনেমাওয়ালা বই লিখেছে, সেটা পড়ার কোন উৎসাহ আমার মধ্যে হলনা। আমি না বলে দিলাম। মুশফিক দমবার পাত্র না, সে বুঝাতে লাগলো এই লোক হুমায়ুন আহমেদের আপন ভাই। হুমায়ুন আহমেদকে সবাই খুব পছন্দ করলেও কেন জানি আমি পছন্দ করিনা, আমার মতে তার সবচেয়ে দারুন সৃষ্টি হচ্ছে “বোতল ভূত” (যে বইটা পড়ে আমি হোমিওপ্যাথিকের শিশিতে কাগজ পোড়ানো ধোঁয়া ভরে সত্যি সত্যি পকেটে ভরে হাঁটতাম)। তাই হুমায়ুন আহমেদের ভাই শুনে মনটা আরো দমে গেল!

মাসখানেক পরের কথা। ছোটবেলায় চিটাগাং নিউমার্কেটে গেলে মিনিমাম একটা বই কেনা ছিল আমার রুটিন ওয়ার্ক। আম্মুর সাথে নিউমার্কেট গিয়ে সেই রুটিন কাজের অংশ হিসেবে বইয়ের দোকানের সামনে যখন গেলাম তখন দেখি দোকানি “দুষ্ট ছেলের দল” ঝুলিয়ে রেখেছে। কী মনে হল কে জানে, ঐ বইটা কিনে ফেললাম। বাসায় আসার পর যখন বইটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললাম তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় আরেকটা নতুন নাম ঢুকে পড়েছে – মুহম্মদ জাফর ইকবাল!

Continue reading একজন মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস