সপ্তাহ দুয়েকের কিছু বেশি হল নিজের দেশে আসলাম। নিজের দেশে! বাংলাদেশে! নিজের কাছেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা। এখনো স্বপ্নের মত মনে হয়। মনে হয় ঘুম ভেঙ্গে গেলেই আবার নিজেকে নেদারল্যান্ডে আবিষ্কার করব। প্লেন থেকে যখন সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে সবুজের মাঝে রূপালি ফিতার মত পেঁচিয়ে থাকা চিকচিকে নদীগুলোকে দেখছিলাম – তখন যে কী খুশি লাগছিল সেটা বলার মত নয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাথে কোলাকুলি করতে ইচ্ছা করছিল। প্লেনের জানালা দিয়ে এভাবে মনে হয় ঘন্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিলাম। ইট পাথরের জঙ্গল ঢাকাকে অদ্ভুত লাগে উপর থেকে। মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। প্লেন ল্যান্ড করার পর সেই মোহ ভাঙ্গল। এর মাঝে প্লেনের ভেতর কি কি হয়েছে কিছু খেয়াল নেই, এমনকি এয়ারহোস্টেস কোনও খাবারদাবার অফার করে গেছে কীনা তাও জানিনা। পায়ের নীচে তখন সবুজ বাংলাদেশ, এ সময় এয়ারহোস্টেস নিয়ে কে মাথা ঘামায়?
নেদারল্যান্ডে তাপমাত্রা দেখে এসেছিলাম ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ঢাকায় এসে পেলাম প্রায় ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুব একটা আকাশপাতাল ফাড়াকে পড়িনি। পার্থক্য খালি একটাই – নেদারল্যান্ডে গরমে সেইভাবে ঘাম আসতোনা কিন্তু ঢাকায় ঘাম আসে। এয়ারপোর্টে পা দিয়েই মনে হল “আসিলাম … নিজভূমে আসিলাম”। সবাইকে আপন আপন মনে হচ্ছিল। বোর্ডিং ব্রিজের সামনে যে লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল তাদেরকে আপন লাগছিল। ভেতরে যারা হাঁটাহাঁটি করছিল তাদেরকে আপন লাগছিল। যারা ফ্লোর ঝাড়ু দিচ্ছিল তাদেরকেও আপন লাগছিল। এমনকি ইমিগ্রেশনের ডেস্কে বসে থাকা কাঠগোঁয়াড় বেরসিক পুলিশগুলোকেও আপন আপন লাগছিল। চারদিকে এত আপনজন দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমার বুকের ভেতর শ’খানেক চিংড়ি উদ্বাহু নৃত্য করছে! ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় ইমিগ্রেশনের সার্ভার তখন রিবুট হচ্ছে। ডেস্কে বসে থাকা পুলিশের সাথে তখন সার্ভার জনিত কিছু কথা বলার চেষ্টা করলাম – হাজার হোক আপনজন বলে কথা, আলাপ সালাপ না করলে কেমন কেমন দেখায়। কথা ঠিক মত শুরু করার আগেই অবশ্য সার্ভারটা রিস্টার্ট হয়ে গেল। কী আর করা! ইমিগ্রেশন পার হয়ে কনভেয়ার বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে গেটের দিকে এগোতে থাকলাম, দেখলাম কাস্টমস চেকিংয়েও আপন আপন টাইপের লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতরের চিংড়িগুলো তখনো নেচেই যাচ্ছে!
ঢাকার রাস্তায় বেশ কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে দিয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত একটা রাস্তা গেছে দেখলাম। বিজয় সরণীর র্যাংগস ভবনটি নেই, সেখানে তেজগাঁও পর্যন্ত একটা টানা রাস্তা করা হয়েছে। গাড়ীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে। চারদিকে প্রচুর হর্ণ! কাজে হর্ণ, অকাজে হর্ণ। অনেকে জ্যামে বসে মনের মাধুরি মিশিয়ে হর্ণ বাজিয়েই যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তাদের সামনে গাড়ির স্টিয়ারিং নয় বরং জলজ্যান্ত পিয়ানো বিছানো রয়েছে। হর্ণ নিয়ে দেখলাম ফেসবুকে আমার জার্মান ফেরৎ বন্ধু রাফি কাতরভাবে স্ট্যাটাস দিয়েছে – বাঙ্গালী এত হর্ণি কেন?
ইদানিং বাসা থেকে বের হলেই রাস্তায় বিশাল বিশাল বিলবোর্ডগুলোতে স্যুট-টাই পড়া এক ভদ্রলোককে কিছুক্ষণ পর পর দেখা যায়। প্রথম ধাক্কায় ভদ্রলোককে চিনতে পারিনি। “চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা”। অবশ্য ভদ্রলোককে ঠাওড় করতে বেশি সময় লাগলনা। ইনি আমাদের সুপারস্টার ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল! ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির ২এক্স ফর্মুলার কী এক ক্রিমের নয়া মডেল। অবশ্য না চিনতে পারার কারণ ও ছিল। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মেখেই কীনা কে জানে, বিলবোর্ডে ভদ্রলোকের চেহারাখানা এমন খোলতাই হয়েছে যে একবারে চিনে ফেলাটা বেশ মুস্কিল। তামিম-সাকিব ইদানিং ইংল্যান্ডের বাংলা চ্যানেলগুলোতে দাপিয়ে বিজ্ঞাপন করে যাচ্ছে। “আমি অমুক শুঁটকি ভর্তা খাই, আপনিও খান” কিংবা “আমি তমুক ফোন কার্ড দিয়ে দেশে কথা বলি আপনি কথা বলুন” – ইত্যাদি রকমারি বিজ্ঞাপন। তবে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’র ব্র্যান্ডফেস হিসেবে তামিমকে দেখে বেশ মজাই লাগল। ঘোর শ্যামলকান্তি এই লোকটির ধবলকান্ত রূপের বাহার দেখে যে কারোরই একটু টাশকি খাওয়ারই কথা।
ঢাকায় লোকজন মনে হয় প্রকটভাবে বেড়ে গিয়েছে। সেদিন মঙ্গলবার বিকেলে রবীন্দ্র সরোবরে গিয়ে দেখি মানুষের মাথা মানুষ খায় টাইপের দশা! এত লোক কোথা থেকে উদয় হল কে জানে। মঙ্গলবারেই যদি এই অবস্থা হয় তবে শুক্রবার যে কী হয়ে কে জানে! একটা জিনিস যেটা বুঝলাম, ওখানে জড়ো হওয়া মানুষের শতকরা ৯০ ভাগই ধানমন্ডির বাইরে থেকে আসা। তারমানে কী এই দাঁড়ায় যে ধানমন্ডি লেক ছাড়া ঢাকায় চিত্ত বিনোদনের সেরকম কোন জায়গা নেই? বড়ই ভয়ানক কথা!
ইদানিং আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করার মত, সেটা হল সবার ঘাড়ে ঘাড়েই অন্তত একটা ডিএসএলআর ঝুলছে! সবাই দেখি ফটুকবাজ হতে চায়। সেদিন দিপু আর মারুফের সাথে আইডিবি গেলাম মারুফের প্রিন্টারের কার্টিজ কিনতে। ক্যাননের শোরুমের খালি কয়েকটা শেলফ দেখিয়ে মারুফ বলল যে এই শেলফগুলোতে নাকি সপ্তাহখানেক আগেও থরে থরে ডিএসএলআর সাজানো থাকতো, এখন একটাও নাই! ডিএসএলআর মনে হচ্ছে নয়া স্ট্যাটাস। নিদেন পক্ষে একটা ডিএসএলআর না থাকলে কেউ মনে হয় পাত্তা দেয়না। যে যেখানে পারছে ডিএসএলআর নিয়ে দাঁড়িয়ে পটাপট ছবি তুলছে। সেদিন দেখি বিজয় সরণীর প্লেনের নীচে এক টোকাই হেভিসে পোজ দিচ্ছে আর তিন-তিনজন ফটুকবাজ পুটুস পাটুস করে ছবি তুলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ঢাকায় এখন মডেলের চেয়ে ফটোগ্রাফার বেশি।
সুন্দর লেখা দাদা। তা দাদা কবে এয়েচেন ঢাকাতে? আসুন না একদিন আমাদের এফওএসএস বাংলাদেশ এর অফিসে। সাক্ষাৎতে সিংগাড়া আর চা এর সাথে জমিয়ে আড্ডা হবে।
আপাতত সময় সংকটে আছি, সবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে হচ্ছে তো। বাংলাদেশেই আছি যখন তখন হয়তো ইনশাল্লাহ দেখা হবে।
আপনি দেশে? জানতাম না তো 🙁
আমি আপতত ঢাকায় আছি, একটা গেট-টুগেদার হতে পারে, কি বলেন? 😀
কয়দিন আছো ঢাকায়? পারলে মেইল দিও…
বাংলাদেশে এসেছেন এই প্রথম পড়লাম, তা মশাই আপনার সাথে পরিচিত হওয়া কি যায় না ? অন্তত লিনাক্স জগতের মানুষ হিসেবে কিংবা তড়িৎ মিস্তিরির দাবীতে 😉
পরিচিত তো হয়েই আছি। নাকি? অবশ্য দেখা সাক্ষাৎ করা যেতে পারে। তবে কী না এই মুহুর্তে সবার সাথে দেখা করা প্লাস দেশে অনুপস্থিতির ব্যস্ততা – সব মিলিয়ে সময় নিয়ে টানাটানির মধ্যে আছি। সময় বের হলে ইনশাল্লাহ সবই হবে। 🙂
@maqtanim:disqus ভাই চিংড়ি এতো পছন্দ যে ফড়িং নাচনের বদলে চিংড়ি নাচন শুরু হইলো?
দেশে পুনরায় স্বাগতম।
দেশের মানুষ কেবল হর্ণি নয় বেশ ‘হট”ও আছে বটে, বাসে দুইদিন যাতায়াত করলেই নমুনা পেয়ে যাবেন 😛
দেশে আসছেন যখন তখন দেখা করবো। ভাইয়ের বাসা কি ধানমন্ডির দিকে? এক শনিবার অফিস শেষে দেখা করা যেতে পারে। আমার অফিস ঢানমন্ডি ৮ এ ব্রনক্স এন্ড ক্যাফে-র বিল্ডিং এর চতুর্থ+পঞ্চম তলায়।
আর ডিএসএলআর কেনার শখ অনেকদিনেরই কেবল টাকা ছিলো না, এখন টাকা জমাচ্ছি শীঘ্রই কিনবো। কিন্তু যদি সবাই ভাব নেবার জন্য ক্যামেরা কেনা শুরু করে তাহলে তো মুশকিল :S
@maqtanim:disqus ভাই চিংড়ি এতো পছন্দ যে ফড়িং নাচনের বদলে চিংড়ি নাচন শুরু হইলো?
দেশে পুনরায় স্বাগতম।
দেশের মানুষ কেবল হর্ণি নয় বেশ ‘হট”ও আছে বটে, বাসে দুইদিন যাতায়াত করলেই নমুনা পেয়ে যাবেন 😛
দেশে আসছেন যখন তখন দেখা করবো। ভাইয়ের বাসা কি ধানমন্ডির দিকে? এক শনিবার অফিস শেষে দেখা করা যেতে পারে। আমার অফিস ঢানমন্ডি ৮ এ ব্রনক্স এন্ড ক্যাফে-র বিল্ডিং এর চতুর্থ+পঞ্চম তলায়।
আর ডিএসএলআর কেনার শখ অনেকদিনেরই কেবল টাকা ছিলো না, এখন টাকা জমাচ্ছি শীঘ্রই কিনবো। কিন্তু যদি সবাই ভাব নেবার জন্য ক্যামেরা কেনা শুরু করে তাহলে তো মুশকিল :S
চিংড়ি আর ফড়িং একই কথা – শুধু একটা’র পাখা আছে আরেকটার নাই, একটা পানিতে থাকে আরেকটা আকাশে উড়ে। 😛
দেখা হবে ইনশাল্লাহ। 🙂
ভাইয়া, আপনি ঢাকায়। আপনার সাথে দেখা করব। ১৬ তারিখে চলে আসেন সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিব।
এ সপ্তাহে সম্ভবত ঢাকার বাইরে থাকব, তাই হয়তো আসা হবেনা। 🙁
তানিম ভাই… বাংলাদেশের এত সুন্দর বর্ণনা আমি নিজেও জানতাম না। প্লেনে চড়ে ছিলাম অনেক ছোট বেলায়। দেশে ফিরেছেন জেনে খুশি লাগলো। :)অন্যান্য বন্টু ভাইয়েদের সাথে দেখা করতে ইচ্ছা করে না? যদি পারেন আমাদের জন্য একটু সময় বের করবেন। এই পোস্টে রিপ্লাই দেলে হবে বা টুইট করবেন। একবার দর্শণ দিলে অনেক খুশি হবো।
অবশ্যই দেখা হবে। তবে দিনক্ষণ ঠিকঠাক বলতে পারছিনা। ব্যস্ততা একটু কমলেই সম্ভব হবে। (সবাই যে হারে দেখা করতে চাচ্ছে, সবার সাথে যে কেমনে দেখা করব এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে!)
Khub bhalo laglo lekhata pore. Welcome back!
অনেকদিন পর তোমার কমেন্ট পেলাম। কই আছো এখন? কি করছ?
মাতৃভূমি কার না ভাল লাগে! কিন্তু আপনার মত এত সুন্দর লেখা কয়জনই বা লিখতে পারে! খুবই ভাল লাগল। দেশে যখন এসেছেন আমাদের টাঙ্গাইলে আসার দাওয়াত রইল।
ধন্যবাদ।
এত দাওয়াত পাচ্ছি, কই যে রাখি! 🙂 দাওয়াতের জন্য অনেক ধন্যবাদ। টাঙ্গাইল গেলে অবশ্যই দেখা করব ইনশাল্লাহ।
স্বদেশে স্বাগতম 🙂
ধন্যবাদ! 🙂