তখন ক্লাশ সিক্সে পড়ি, কিশোর বয়স। কমিক্সের পাশাপাশি তিনগোয়েন্দা পড়া শুরু করেছি মাত্র। একদিন ক্লাশে মুশফিকের কাছে একটা বই দেখলাম, নাম “দুষ্ট ছেলের দল”, লেখকের নাম পরিচিত জাফর ইকবাল! পরিচিত এই হিসেবে যে আমি জাফর ইকবাল কে চিনতাম, আসলে একজন জাফর ইকবালকেই আমি চিনতাম, সে লোক সিনেমার হিরো ছিলো! আমি তো অবাক, সিনেমার হিরোরা বই লিখতে পারে বলে আমার কোন ধারনা ছিলোনা, তাও আবার কিশোর উপন্যাস! মূশফিক জিজ্ঞেস করলো যে বইটা আমি পড়ব নাকি! আমি তখন কিশোরদের বই বলতে চিনি তিনগোয়েন্দা, গোয়েন্দা রাজু, ফেলুদা, শঙ্কু – এইসব। তখন আমার প্রিয় লেখক ছিল সত্যজিত রায় (এখনো আছে!)। সেই লোকের গল্প, উপন্যাস, ছড়া, আঁকাআঁকি- সবকিছুতেই আমি মুগ্ধ! তাই কোথাকার কোন সিনেমাওয়ালা বই লিখেছে, সেটা পড়ার কোন উৎসাহ আমার মধ্যে হলনা। আমি না বলে দিলাম। মুশফিক দমবার পাত্র না, সে বুঝাতে লাগলো এই লোক হুমায়ুন আহমেদের আপন ভাই। হুমায়ুন আহমেদকে সবাই খুব পছন্দ করলেও কেন জানি আমি পছন্দ করিনা, আমার মতে তার সবচেয়ে দারুন সৃষ্টি হচ্ছে “বোতল ভূত” (যে বইটা পড়ে আমি হোমিওপ্যাথিকের শিশিতে কাগজ পোড়ানো ধোঁয়া ভরে সত্যি সত্যি পকেটে ভরে হাঁটতাম)। তাই হুমায়ুন আহমেদের ভাই শুনে মনটা আরো দমে গেল!
মাসখানেক পরের কথা। ছোটবেলায় চিটাগাং নিউমার্কেটে গেলে মিনিমাম একটা বই কেনা ছিল আমার রুটিন ওয়ার্ক। আম্মুর সাথে নিউমার্কেট গিয়ে সেই রুটিন কাজের অংশ হিসেবে বইয়ের দোকানের সামনে যখন গেলাম তখন দেখি দোকানি “দুষ্ট ছেলের দল” ঝুলিয়ে রেখেছে। কী মনে হল কে জানে, ঐ বইটা কিনে ফেললাম। বাসায় আসার পর যখন বইটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললাম তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় আরেকটা নতুন নাম ঢুকে পড়েছে – মুহম্মদ জাফর ইকবাল!
সেই কিশোর বেলা থেকে শুরু করে এখনো আমি আর আমার বোন অধীর আগ্রহে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকি। বইমেলাকে আমরা দুইজন বইয়ের লিস্টি করতাম। জানি বোদ্ধাজনেরা নাক সিঁটকাবেন, তারপরো বলি, প্রতি বইমেলায় আমাদের বই লিস্টে এই মানুষটার নতুন বইগুলো হায়েস্ট প্রায়োরিটি পায়। কৈশোর পার হয়ে এসেছি অনেক আগেই, তারপরো এই মানুষটার কিশোর উপন্যাসগুলো এখনো পড়ি।
এই মানুষটাকে সবাই “স্যার” বলে ডাকে। কাউকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে শুনলেই মনে হয় লোকটা বুঝি আমার অনেক ‘পর’ হয়ে গেল। স্যার শব্দটার মাঝে আমি বন্ধুত্বপূর্ণ আপন কোন সম্পর্ক কোনকালেই খুঁজে পাই নাই। চাচা, মামা বা নিদেনপক্ষে আংকেল বলে ডাকলেও এর চেয়ে অনেক কাছের মনে হয়। আমার খুব ইচ্ছা প্রিয় এই মানুষটাকে চাচা, মামা বা আংকেল বলে ডাকার, তাঁর সাথে সামনাসামনি বসে কথা বলার। দুইটা সুযোগই অবশ্য এসেছিলো, কিন্তু কাজে লাগাতে পারিনি। আইইউটিতে এক কনফারেন্সে এই মানুষটা এসেছিল। এত সামনে থেকে দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম, এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম যে কখন শাহান আমাকে এই লোকের সাথে দাঁড় করিয়ে ফটাফট ছবি তুলে ফেললো আমি টেরই পাইনি। যখন উনি চলে গেলেন তখন টের পেলাম যে আমার কথা বলার সুযোগটা লাথি মেরে নিজেই সরিয়ে দিয়েছি! হয়তো আবার দ্বিতীয় কোন সুযোগ হবে।
এ বছরের বইমেলায় বই কেনার পর আমার বোন জানালো আমাদের এই প্রিয় লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সবার পকেটে ঢুকিয়ে দেবার মত একটা দুরূহ কাজ করে ফেলেছে! ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামে একটা পকেট বই লিখেছেন যার কোন ক্রয়মূল্য নাই অর্থ্যাৎ বিনামূল্যের একটা ইতিহাস বই; উদ্দেশ্য – দেশের মানুষ যাতে দেশের ইতিহাসের একটা দিকনির্দেশনা পায়। শুধু তাইনা, গত ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এই বই ইন্টারনেটে বিনামূল্যে শেয়ারও করা হয়েছে, যাতে করে যে কেউ যে কোন জায়গা থেকে এই বইটা ডাউনলোড করে পড়তে পারে। কী আছে এই বইতে! আসলে বলা উচিৎ কি নেই! প্রচুর রেফারেন্স দিয়ে লেখা বাইশ পৃষ্ঠার এই বইটা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম কিন্তু তথ্যবহূল ইতিহাস বই। বইটা কেউ ডাউনলোড করতে চাইলে এইখান থেকে করতে পারবেন। বইটি এরই মধ্যে এই বইমেলায় সবচেয়ে বিক্রিত বইয়ের রেকর্ড করেছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমার প্রিয় মানুস।
Likha pore bhalo laglo…Uni amaro ekjon khub pochonder ekjon lekhok……………
আমার ভার্সিটির টিচার। আমারো খুব ভাললাগে