শুভ জন্মদিন আইওটু!

আজকে বিখ্যাত ১২ই জানুয়ারি। তারিখটা বিখ্যাত কারণ এরকমই এক ১২ই জানুয়ারির শীতের সকালে, দৌড় শুরু করে আইইউটির আইওটু (বা আইইউটিয়ান্স-জিরো-টু) ব্যাচটি। অন্য ব্যাচগুলো হেঁটে হেঁটে শুরু করেছিল কিনা জানা নেই, কিন্তু আমরা (বিশেষ করে আমি) আক্ষরিক অর্থেই দৌড় দিয়ে শুরু করেছিলাম আমাদের আইইউটি জীবন! সে বছরের জানুয়ারির ১২ তারিখের সকালবেলাটা ছিল পুরো কুয়াশাঢাকা একটা সকাল। এত ঘন কুয়াশা ছিল যে জানালা দিয়ে বাইরে অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল, ফলে ঘুমের রেশ কাটিয়ে যখন বুঝতে পারলাম যে সকাল বেশ কিছু আগেই হয়ে গিয়েছে তখনই শুরু হল দৌড়ঝাঁপ। আমার মত আশপাশের রুমগুলোর ছেলেপেলের মাঝেও দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই দৌড়ঝাঁপ দিয়েই আইইউটি জীবন শুরু!

IUT Bangladesh

সেই যে শুরু হল, এরপর কালে কালে কেটে গেল অনেকটা সময়। সেই সময় শুধুই সমৃদ্ধ হবার সময়। পেলাম দিপু-মিফতাহ’র মত অসাধারণ দুই রুমমেট-বন্ধু। পাশেই ছিল শাহান, সাদ, ইমন, সর্প, শাদিদ, সিনা, তাসনিম, বলদা, বিলাই, মীম, ব্যাঙ, লালের মত চমৎকার কিছু প্রতিবেশী। সেই সাথে ছিল জাপানী, ষান্ডা, ঘাসা, বগলা, এঁইরঁকি, লাল-রকি, গুখা, আফসানা, পাঁচু-জামিল, ওয়ালা-জামিল, কোকেন, হাফব্লাড-আশেক, পাখি, কাদু, পাগলা-সবুজ, আঁতেল-সবুজ, কাউয়া, বন্ধু, গাবড়, ম্যাচো, দাদা, চুনু, চিকি, মহেষ, আব্বু, ভাতিজা, সখিনা, গরীব-আজমান, বদু, রাতুল, মোয়াক্ষার, পারু, শাকিল, রায়হান, মালেক, ভাই-তুষার, কপি-জাকি, হাসান-ভাই, ফুয়াদ, মিষ্টি, আলোকিত-সাজেদ, হ্যান্ডসাম-সাদাত – আরো কত জন! সবার নাম-ধাম লিখতে গেলে এই লেখাটাই বিশাল একটা রোলকল খাতা হয়ে যাবে! খুব মিস করি সেই জীবনটাকে, যেই জীবনটাতে সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই কোনমতে জামাকাপড় পাল্টে ক্লাসে গিয়ে চোখ কষ্ট করে খোলা রেখে লেকচার শুনতে হত, ১৫ মিনিটের ক্লাসব্রেকে ক্যান্টিনে গিয়ে সকালের নাস্তা সারা হত, ক্লাসের ফাঁকে রেলিংএ পা ঝুলিয়ে আড্ডা মারা হত, কম্পিউটার ল্যাবে গিয়ে ইমেইল চেক করা হত, লাঞ্চের পর বিছানায় চিৎপটাং ঘুম দেয়া যেত, বিকালে সবাই দলবেঁধে একসাথে হাঁটাহাঁটি করা হত, শাহী মামা’র দোকানে পুরি-সিঙ্গারা খাওয়া হত, রাতের ডিনার সেরে আইইউটিকে (প্রায়) একটা চক্কর দিয়ে হাঁটা হত, তারপর রুমে ফিরে আজাইরা গ্যাঁজানো হত, কখনো কখনো সবাই মিলে ছাদে গিয়ে পানির ট্যাংকের উপর বসে থাকা হত, বোনাস হিসেবে বিলাইয়ের গান শোনা হত – আরো কত কী! সেই জীবনটাতে রঙের ছড়াছড়ি অনেক বেশি ছিল। সেইসব দিনগুলোর সাথে তুলনা করলে এখনকার জীবন অনেক বেশি পানসে লাগে। রঙিন ঐ জীবনটার শুরু হয়েছিল সেই বারই জানুয়ারিতে।

এখনো যখন পেছনে ফিরে দেখি, মিস্তিরি হবার প্রত্যয়ে শুরু করা সেই দিনটা আজও প্রেরণা যোগায়। এ দিনটা ছিল আমাদের শুরুর বিন্দু, আমাদের নতুন জীবনের সূচনা লগ্ন, জিরোটু ব্যাচের জন্মক্ষণ, আমাদের ব্যাচের জন্মদিন, আমাদের জন্মদিন! শুভ জন্মদিন আইইউটিয়ান্স-জিরো-টু ব্যাচ। কেমন আছিসরে সবাই? তোদের অনেকের সাথেই সেভাবে যোগাযোগ নেই, অনেকেই আমার মত দেশের বাইরে, অনেকে একলা থেকে দোকলা হয়ে তেকলা-চাকলাও হয়ে গিয়েছিস, তারপরও যে যেখানেই থাকিস না কেন সবার প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে শুভ কামনা রইল।

শুভ জন্মদিন দোস্তরা!

জালের জগতে প্রথম ঠিকানা

এই লেখাটা প্রথম লিখি সচলায়তনের জন্য। তারপর মনে হল কিছু কিছু জায়গা আরো চমৎকার করে লেখা যায়। তাই ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে লেখাটার এই ব্লগে আগমন।

জালের জগতের সাথে প্রথম মোলাকাত ইন্টার পরীক্ষা দেবার ঠিক আগে আগে। সময়টা ছিলো ২০০২ এর শুরু’র দিকে। আমার জালের জগত সম্পর্কে জ্ঞান তখন খুবই করূণ। ইন্টারে রচনা কমন ফেলার জন্য যতটুকু জানা দরকার তার চেয়ে বেশি না। এই জগতের মাজেজা আমার কাছে তাই সম্পূর্ণ অচেনা। এক বন্ধু তখন এমএসএন ম্যাসেঞ্জারে চুটিয়ে প্রেম করছে কানাডা প্রবাসী (আদৌ কানাডা প্রবাসী কি না কে জানে!) এক মেয়ের সাথে। বন্ধুর সাথে সেই মেয়ের ছবি দেখতে গিয়ে আমার জালের জগতে হাতে খড়ি। তো আমার এই হাতেখড়ির পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি- আমার বন্ধুর না ওর বান্ধবীর (আরো সহজ করে বললে একজন নরের নাকি নারীর) সেটা এখনো আমাকে বেশ ভাবায়। যাই হোক আমার মত নাদান তখনো এই জগতের মহীমা বুঝতে পারেনাই!

মহীমা বুঝতে পারি যখন আমার প্রথম ইমেইল এড্রেসটা খুলি। কী ফটাফট এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চিঠি চলে যায়! জালের জগতে আমার প্রথম ঠিকানা তৈরি করি আইইউটিতে ভর্তি হবার পর। এই ঠিকানা খুলতে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। একে তো ইন্টারনেট কী তা জানিনা তার উপর ইমেইল কেমন করে ব্যবহার করে সেটা সম্পর্কেও অজ্ঞ।

আইইউটিতে ভর্তি হবার পর একদিন আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের সবাইকে একটা এপ্লিকেশন ফর্ম দিয়ে জানানো হলো যে আমাদের সবার নামে স্টুডেন্ট ইমেইল একাউন্ট খোলা হবে, সবাই যেন নিজেদের পছন্দের নাম জমা দেয়। আগেই বলেছি আমি ছিলাম নাদান। তো নাম যেহেতু চাইলো আমি তাই বাবা-মা’র দেয়া আমার ঊনিশ অক্ষরের (আন্ডারস্কোরসহ একুশ অক্ষর) বিশাল নামটাই দিয়ে দিব বলে ঠিক করলাম। এরই মধ্যে একদিন আবিষ্কার করলাম পোলাপান সব কাব্যিক নাম দিচ্ছে। কী বাহার সেই সব নামের! স্বপ্নীল, দলছুট, নীলআকাশ। আবার মারমার কাটকাট নামও ছিলো বেশ কয়টা; যেমন ডেথবয়, হেলকীপার, ফায়ার অফ ফিউরি। একজনতো ম্যাট্রিক্স মুভি দেখে সেই ছবির নায়ক চরিত্র নিও’র নাম দিয়েছিল নিজের একাউন্টে। আমার মত আরেকজন নাদান আবার তার প্রেমিকার নামে নিজের একাউন্ট খুলে বসেছিলো!

এতসব নামের বাহার দেখে আমি বুঝলাম যে স্মার্ট হতে আমার এখনও অনেক দেরী। কী আর করা, আমার ইমেইলের নামতো বদলাতে হবে। স্টাইলিশ নাম দিতে হবে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার ঊনিশ অক্ষরের নামের মধ্যে মোট তিনটা অংশ, যার মধ্যে শেষ অংশের বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় “যার কোন ক্ষয় নাই”। ডিকশনারি নিয়ে বসলাম এর ইংলিশ প্রতিশব্দ বের করার জন্য। শেষমেষ বের করে ফেললাম। নামটা জমাও দিয়ে দিলাম। আমার প্রথম ইমেইল নিকটা ছিল “ইটারনাল” [ETERNAL]। সেই অনুযায়ী জালের জগতে আমার প্রথম ঠিকানাটা ছিলো eternal@iut-dhaka.edu . বিভিন্ন ল্যাব রিপোর্ট কিংবা এসাইনম্যান্ট দেবার কাজেই কেবল এই ঠিকানাটা ব্যবহার করতাম। পাঠশালার চার বছর এই ঠিকানা আমার সাথে ছিলো। পাঠশালার পাট চুকে যাবার সাথে সাথে এই ঠিকানাটাও বিলীন হয়ে যায়।

ল্যাব রিপোর্ট কিংবা এসাইনম্যান্ট জমা দেয়া ছাড়া অন্য কোন কাজে এই ঠিকানাটা খুব একটা ব্যবহার করতামনা, কারন কদিন পরেই হটমেইল আর ইয়াহু’র খোঁজ় পেয়ে গেলাম। এর পর কত জায়গায় কত নামে ঠিকানা খুলেছি তার ইয়েত্তা নাই। অবশ্য সার্বজনীন ঠিকানায থিতু হতেও খুব একটা সময় লাগেনি। কিন্তু ঐ প্রথম ঠিকানাটা কখনোই ভুলতে পারিনা।

রুমমেট সমাচারঃ দ্বিতীয় প্রজন্ম

পাঠশালায় যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম পুরোন বছরের সাথে সাথে নিজের রুমখানাও বদলে ফেললাম। ৫২২ নম্বর রুম থেকে আমার নতুন ঠাঁই হল ৫২১ এ। রুমটার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটা একেবারে বাথরুমের সাথে লাগোয়া। এতে একটা সুবিধা হয়েছিলো যে বাইরের সবাইকে বলে বেড়াতাম আমাদের রুমের সাথে একেবারে এটাচ্ড বাথরুম আছে! ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে আমাদেরকে প্রতি রুমে চারজন করে থাকতে হোত। সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর এক রুমে তিন জন থাকার পারমিশন পাওয়া গেল। সে হিসেবে ৫২১ এ চার জন ছিলো যাদের দুইজন সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতেই অন্যরুমে চলে যায়। তাছাড়া আমারো সমস্যা হচ্ছিল, কারন ৫২২ এ আমার ডিপার্টমেন্টের কেবল মাত্র আমি ছিলাম। ফলে দেখা যেত আমাকে পরীক্ষার আগে প্রায়ই অন্যরুমে পড়া বুঝতে ছুটতে হত। তাই দিপু আর মিফতাহ যখন ওদের ৫২১ নম্বর রুমে আমাকে থাকার কথা বল্লো, একেবারে কোন কিছু চিন্তা না করেই রাজী হয়ে গেলাম। ভাগ্যিস হয়েছিলাম, নাহলে আমি আমার জীবনের খুব কাছের দুজন বন্ধুকে কখনোই পেতাম না।

ফাইনাল ইয়ারে আমরা তিনজন রুম পালটে তিন তলার ৩১৫ নম্বর রুমে চলে আসি। তার আগ পর্যন্ত বাথরুমের পাশের এই রুমটাতেই দুই বছর কাটিয়ে দেই। পাশে বাথরুম থাকাতে কখনোই কোন সমস্যা হয় নাই… কেবল মাত্র একবার ছাড়া, যেবার বাথরুমের টয়লেটগুলো ওভারফ্লো করেছিলো! আরেকটা ব্যাপার, কোন এক অজ্ঞাত কারনে প্রায়ই মাঝরাতের পর চামচিকা ঢুকে পড়ত আমাদের রুমে। এত রুম থাকতে আমাদের রুমেই কেন বারবার ঢুকত কে জানে?

এই রুমে আমার সাথী হল দিপু আর মিফতাহ। আমাদের ব্যাচ যতদিন পাঠশালায় ছিল ততদিন সম্ভবত সবচেয়ে দুই জনপ্রিয় চরিত্র ছিল এই দুইজন। এখনো সবাই একনামে এই দুজনকে চেনে। আমাদের তিনজনের মধ্যে প্রচুর মিল ছিলো। তিনজনই বকবক করতে পছন্দ করতাম। তিনজনেরই বাসা ছিল একই জায়গায়। আমাদের গ্রামের বাড়িও ছিল একই জেলায় – ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়। আমাদের রুমের নামই হয়ে গিয়েছিলো বিবাড়ীয়া এক্সপ্রেস! বলতে ভুলে গেছি, আমাদের তিনজনই একই ল্যাব গ্রুপে ছিলাম।

মিফতাহ’র যে গুনটা সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলো সেটা হলো, সে যেকোন ঘটনা এত দারুন করে বলতে পারত যে বোঝা মুশকিল সে ওই সময় ওই জায়গায় ছিলো কিনা কিংবা ওই ঘটনা আদৌ ঘটেছিলো কিনা। ব্যাপারটা কিছুটা চাপা মারার মত কিন্তু ঠিক চাপা না। তবে নিজের বাহাদুরির জন্য কখনো এসব বলত না। ও ছিল কিছুটা আরামপ্রিয়। সকালের ক্লাস গুলোতে ওকে তেমন একটা পাওয়া যেতনা, ঘুমের জন্য। তবে শনিবার ছিলো ব্যতিক্রম, কারন ওই দিন আমাদের পাঠশালার ভোজনখানার সকালের মেনু ছিল গরম গরম তেহেরি। অকাটমূর্খ ছাড়া ওই জিনিস কেউ মিস করেনা। ওর আরেকটা মহা গুণ হলো মাথায় একবার কিছু ঢুকলে অন্তত দুইদিন ওই জিনিস ছাড়া ও আর কিছু ভাবতে পারতোনা। তবে দুই দিন পর সব আবার আগের মত! একবার মাথায় চাপলো কবিতা লিখবে, ব্যস আর যায় কোথায়… খাতা -টাতা খুলে কবিতা লেখা শুরু করলো। তিনদিন পর মনে হল কবিতা লেখা পোষাবেনা, উপন্যাস লিখা দরকার… সাথে সাথে আরেকটা খাতার আগমন , এবার উপন্যাসের পালা! আরেকবার মাথায় চাপলো সকালে উঠে জগিং করবে, যেমন কথা তেমন কাজ, প্রতিদিন ভোরে শখের বিছানা ছেড়ে জগিং এর জন্য উঠত। এভাবে চললো প্রায় দুই দিন। তবে সবচেয়ে বেশিদিন যেটা টিকেছিলো সেটা হল দাবা খেলা। হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই কোথা থেকে এক দাবার বোর্ড জোগাড় করে নিয়ে আসলো। তারপর একে একে সবাইকে দাবার চ্যালেঞ্জ দিত। কেউ না চ্যালেঞ্জ না নিলে প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে বসাতো দাবা খালানোর জন্য। মনে আছে, একবার রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আমার চোখের সামনে যে দৃশ্য ছিল তা হল ও আর রায়হান গভীর চিন্তা মগ্ন হয়ে দাবা খেলছে। এ দেখতে দেখতেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। প্রায় ছয় ঘন্টা পর ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি একই দৃশ্য! ছয় ঘন্টা ধরে দুজনে দাবা খেলছে, তাও আবার পুরোরাত না ঘুমিয়ে! ফাইনাল ইয়ারে ওর পাঠশালার ভেতর সাইকেল চালানোর খুব শখ হল। সেই শখ মেটাতে ও ঢাকায় এসে সাইকেল কিনলো, সেটা কে ঢাকা টু গাজীপুর বাসের ছাদে তুলে সোজা পাঠশালায় নিয়ে আসলো। তবে ঐ বস্তু চালাতে গিয়ে আমার বেশ বাজে অভিজ্ঞতা চছে। পাঠশালায় আনার পর সেটা চালাতে গিয়ে আমি একেবারে রাস্তার উপর ধপাস্‌ করে ফ্ল্যাট!

এবার আসা যাক দিপুর কথায়। এই ছেলে আবার মিফতাহ’র মত না। মিফতাহকে যত সহজে বর্ণনা করা গেলো, একে আবার তত সহজে করা সম্ভব না। দিপুকে কোন ছাঁচে ফেলা মুশকিল। এই বান্দা’র পড়াশুনায় মাথা যথেষ্ট ভাল (যদিও সে কখনো ওর মাথার পঞ্চাশ পার্সেন্টও ব্যবহারকরে নাই)। ওর পড়াশুনার স্টাইল ছিল কিম্ভুত। মাঝে মধ্যেও বিছানায় এমনভাবে শুয়ে পড়াশুনা করত যে দেখে বোঝার উপায় নাই ও পড়ছে না ঘুমাচ্ছে! ওর পড়াশুনার প্রিয়জায়গা ছিল ওর টেবিল (চেয়ার না কিন্তু) যেটার উপর প্রায়ই সে একেবারে দুপা তুলে আসন করে বসতো। একবার দেখি ও বাথরুমে গিয়ে পড়ছে। জিজ্ঞেস করায় বললো ওর নাকি বাথরুমের নিশব্দতায় খুব ভালো পড়া হয়! প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার জন্য ও ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতো। সকালে এলার্ম বেজেই চলত, কিন্তু ওর ঘুম থেকে উঠার সামান্যতম লক্ষণ দেখা যেতনা। আমাকে বা মিফতাহকেই সকালে সাধের বিছানা ছেড়ে ওই এলার্ম বন্ধ করতে হত! কোন রুমে একটু আড্ডার গন্ধ পেলেই হত, দিপু নিমিষেই সেখানে হাজির। যেকোন আড্ডায় ও ছিলো মধ্যমণি। ও যে কারো কথা বলার ধরন নিঁখুতভাবে নকল করতে পারতো। আমাদের তিনজনের মধ্যে একমাত্র দিপুই মূভি খুব একটা দেখতোনা (যদিও আমাদের মত খুব কার্টুন দেখত)। তবে ও ভোজন রসিক। বলতে দ্বিধা নাই ওর পাল্লায় পড়ে ফার্মগেটের ওভারব্রিজের তলায় বিসমিল্লা’র হালিম থেকে শুরু করে এলিফ্যান্ট রোডের মালঞ্চ বা ধানমন্ডির স্টারের বোরহানী কোন কিছুই বাদ দেইনাই। বন্ধুদের জন্য দেদারসে টাকা পয়সা খরচ করে ও। ওর মত রসিক মানুষও আমি খুব একটা দেখি নাই। যেকোন পরিস্থিতিতে যে কাউকে হাসানোর ক্ষমতা একমাত্র ওরই আছে। স্বিদ্ধান্ত দিতে ওর কম সময় লাগতো আবার সেটা বদলাতেও বেশি সময় লাগতনা। সেকেন্ড ইয়ারের একটা ঘটনা, মিড সেমিস্টার পরীক্ষা ওর ভাল হয়নি, মন খুব খারাপ। প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে, ও আমাদের পূরো রুমে বিভিন্ন স্লোগান লিখে পোস্টারিং করে ফেললো। পোস্টারের ভাষাও দেখার মত, একেটাতে একেক ধরনের লেখা। ।কোনটা উৎসাহমূলক -“এইবার পড়তে হবে”, “কোন সাব্জেক্টকে ছাড়ন নাই”, “এই পরীক্ষা তো পরীক্ষা নয় আরো পরীক্ষা আছে, এই পরীক্ষারে নিব আমি সেই পরীক্ষারও কাছে”; আবার কোনটা হয়ত তিরস্কারমূলক -“দিপু, এইবার না পড়লে তোরে খাইসি”, “ফাউল কামে আর কত, এইবার পড়ায় মন দাও”। ভয়ের ব্যাপার, অবস্থা তো বেগতিক। আমরা ভাবলাম ছেলে না আবার পরে পরীক্ষার দুঃখে অন্যকিছু করে বসে। এক সময় পরীক্ষা শেষ হল। খাতা দেয়া যখন শুরু হল তখন দেখা গেল ও যত খারাপ খারাপ করবে ভেবেছিলো আসলে তত খারাপ হয়নাই পরীক্ষা। পরীক্ষা যখন খারাপ হয়নাই তাহলে পোস্টারের দরকার কী! একটা একটা করে সাব্জেক্টের খাতা দেয়া হতে থাকল আর আমাদের রুম থেকেও পোস্টার কমতে থাকলো। একসময় দেখা গেলো সব পোস্টারই হাওয়া হয়ে গেছে!

পাঠশালার শেষ দিনটি পর্যন্ত আমরা একসাথে ছিলাম। হোস্টেলে অনেক রুমে রুম্মেটদের মধ্যে ঝগড়া এমনকি মারামারিও পর্যন্ত দেখেছি। কত রুমে রুম্মেটদের মাঝে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নাটক দেখেছি। কিন্তু আমাদের তিনজনের মধ্যে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও কোন ঘাপলা হয়নি। তিন বছরের মধ্যে বরং আমাদের বন্ধুত্ব আরো মজবুত হয়েছে, যেটা এখনো হয়ে চলেছে। আমার রুম্মেট ভাগ্য আসলেই ঈর্ষা করার মত।

রুমমেট সমাচারঃ প্রথম প্রজন্ম

আইইউটিতে যখন প্রথম গেলাম তেমন কাউকেই তখন চিনিনা। নটরডেমের কয়েকজন পরিচিত বন্ধু ছিল… এইযা। এদিকে বাসায় আম্মু চিন্তায় অস্থির! ছেলে প্রথমবারের মত হোস্টেলে থাকতে যাচ্ছে, রুমমেট হিসেবে কারা পড়ে, ওদের পাল্লায় পড়ে ছেলে আবার উচ্ছন্নে যায় কিনা – এইরকম হাজারো চিন্তা! অন্যদিকে আবার বিভিন্ন পরিচিত মানুষজন হোস্টেলে থাকলে ছেলেপেলে কিরকম খারাপ হয় তার একেরপর এক উদাহরন দিয়ে যাচ্ছে রাতদিন।

যাই হোক সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আমার ঠাঁই হলো সাউথ হলের ৫২২ নম্বর রুমে। এই লেখার শুরুতে “প্রথম প্রজন্ম” কথাটা লিখলাম এই কারনে যে আইইউটি জীবনে আমি রুম বদলেছি মোট তিনবার আর রুমমেট পেয়েছি টোটাল দুই সেট। আইইউটিতে প্রথম বছরে আমার প্রথম রুম আর প্রথম রুমমেটদের নিয়ে এই লেখাটা। দ্বিতীয় প্রজন্মের রুমমেটদের কাহিনী আসছে পরের লেখায়।

প্রথম যার কথায় আসছি সে মানুষ হিসেবে ছিলো একদম সাদাসিধা আর মেধাবী। কলেজ লাইফ থেকেই ওকে চিনতাম। ভদ্র শান্তশিষ্ট মানুষ। সহজে কারও উপরে রাগ করেনা। সারাক্ষন ওর পড়া নিয়ে থাকে। একদম সাধারন একটা মানুষ বলতে যা বুঝায়। ও ছিলো সিআইটিতে। প্রায়ই দেখা যেত পরীক্ষার আগের রাতে ওর কাছে ছেলেপেলের ভীড় লেগে যেত। ভাল স্টুডেন্টদের লাইফ যেমন হয় আরকি! নিজের পড়ার খবর নাই, অন্যদের পড়িয়েই রাত কাবার। অবশ্য এখনো ও অন্যদের পড়ায় মানে পাঠশালায় (আইইউটি) টিচারগিরি করে। আরেকজন যে ছিলো সেও নটরডেমে আমার সাথে একই গ্রুপে ছিলো। তবে ওর আসল নাম জেনেছি আইইউটিতে আসার পর। নটরডেমে সবাই ওকে ডেঙ্গু নামে চিনতো। এই নামেরও এক ইতিহাস আছে। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই ওর ডেঙ্গু হয় আর ডেঙ্গু জ্বর তখন সবেমাত্র বাংলাদেশে আমদানী হয়েছে। তো বেচারা First Come First Serve অবস্থায় পড়ে গেলো। সম্ভবত ওই ছিলো নটরডেমে প্রথম ডেঙ্গু ধরা পাবলিক। সেই থেকে ওর নাম ছিল “ডেঙ্গু”। তো এই ডেঙ্গু প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে মশারির ভিতর কিসব বিদঘুঁটে সব শব্দ করে ঘুমাতে যেত। মোটামুটি যখন ওই শব্দের সাথে মানিয়ে নিয়েছি তখন একদিন শুনি ও বুয়েটে চলে যাচ্ছে। ও আমাদের সাথে ছিলো প্রায় দুই সপ্তাহ। ৫২২ নম্বর রুম থেকে ডেঙ্গু বিদায় নেবার পর ওর জায়গায় আসলো এক দার্শনিক। এই দার্শনিকের কথায় একটু পরে আসছি। তার আগে আরেক রুমমেটের সাথে পরিচয় করানো দরকার।

এই বান্দা ছিলো আমাদের তুলনায় বিশালদেহী। গলার আওয়াজও ছিলো মাশাল্লাহ… ওই গলার আওয়াজ ছাপিয়ে কথা বলা আর বাংলাদেশ রেলওয়ের চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনের ছাদে বসে ফোনে কথা বলা প্রায় একই জিনিস। সত্যি বলতে কি ও রুমে ছিল বলে আমাদের বেশ সাহস লাগতো। একদিনের ঘটনা। তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছিলো। স্টুডেন্ট সেন্টারে ভীড়ের ঠেলায় ঢোকাই যেতনা! এদিকে আবার দুইটা টেলিভিশনই স্টুডেন্ট সেন্টারে। আমার ‘দশাসই’ রুমমেট তখন বিশ্বকাপ মহামারিতে চরমভাবে আক্রান্ত। ঝোকের চোটে নিজের বাসা থেকে টেলিভিশন নিয়ে আসলো সে। সেটা রাখা হলো আমাদের রুমে। কেবল মাত্র আমাদের চারজনের ওই টিভিতে খেলা দেখার কথা থাকলেও মোটামুটি আমাদের ইয়ারের সবাই চলে আসতো খেলা দেখতে। সবার সাথে আমার এই রুমমেটের ভাল ভাব থাকলেও কয়েকজনের সাথে খিটমিট ছিলো। তো দেখা গেলো এক সন্ধ্যায় খেলা দেখতে সেসব খিটমিটদের একজনের আমাদের রুমে আগমন। একে দেখেই ‘দশাসই’ এত ক্ষেপে গেল যে ওর গলার আওয়াজ শুনে নীচতলা থেকে সিনিয়র ভাইরা সব ছুটে উপরে এল কী হয়েছে তা দেখতে! এই বান্দা আবার মাঝে মাঝে ঘুমের মাঝে নাকে হাল্কা হিমেশ রেশামিয়া টাইপ সুর তুলতো। ওর সুরে তেমন জোর ছিলোনা (এইটা অবশ্য জেনেছি আসল হিমেশের ‘নাক’ শোনার পর!) অনেকটা মশার পিনপিন শব্দ। এবার আসি দার্শনিকের কথায়। এই দার্শনিক আমাদের রুমে আসলো ‘ডেঙ্গু’ বিদায় নেবার পর। ‘ডেঙ্গু’ বিদায় হবার সময় ওর যাবতীয় সম্বল (লেপ, তোষক, বালিশ, বিছানার চাদর এইসব হাবিজাবি যা ও আমাদের পাঠশালা থেকে নিয়েছিল) ফেরৎ দিয়ে দিলো। ফলে আমাদের রুমটাতে চারটা খাটের মধ্যে একটাকে পুরোপুরি জীর্ণ মনে হচ্ছিলো। সেদিন ক্লাস থেকে ফিরে এসে দেখি সেই জীর্ণ খাটে একটা তোষক আর দুইটা বালিশ পড়ে আছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি তোষকের উপর বিছানার চাদর, লেপ, কম্বল এইসব পড়ে আছে। ব্যাপার কী! ‘ডেঙ্গু’ ফিরে এল নাকি! ব্যাপারটা পরিষ্কার হল যখন আমি বাথরুম থেকে গোসল সেরে রুমে ফিরলাম তখন। এসে দেখি সেই জীর্ণ খাট তার দৈন্য চেহারা থেকে একেবারে সুপুরুষ হয়ে গেছে, আর সেই খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে আরেক পুরুষ, মানে সেই দার্শনিক পুরুষ আরকি! সেই থেকে দার্শনিকের ৫২২ এ থাকা শুরু। এই দার্শনিক সবসময় ভাবুক মনে কেবল কী যেন চিন্তা করে। প্রায়ই সময় সে খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে ওর বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে হাতে কলম নিয়ে খেলা করতো আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে কী যেন ভাবতো। তো দেখা যেত যে এই দার্শনিকের কাছে প্রায় সব কিছুরই একটা উত্তর থাকত, সেটা পড়াশুনা নিয়েই হোক অথবা ভবিষ্যৎ জীবন। যেকোন কথা শুনে সে একটা সূক্ষ্ম হাসি দিত। হাসিটা বেশ বিভ্রান্তিকর ছিল, ছোট বাচ্চাদের অর্থহীন কথা শুনলে বড়রা যেমন হাসি দেয় অনেকটা সেরকম। তবে পড়ালেখায় ছেলের মাথা ভালো ছিল। আমার সন্দেহ ছিলো ও বুঝি মাঝে মাঝে কবিতা টবিতা লিখতো (যদিও কখনো প্রমান পাই নাই)। পুরো ২০০৩ সাল আমি ৫২২ নম্বর রুমে এই তিনজনের সাথে ছিলাম। সত্যি বলতে কি বেশ ভাল ছিলাম। ওই তিনজন রুমমেট হিসেবে খুবই দারুন ছিল। ২০০৩ এর শেষ দিকে সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে আমি ৫২২ ছেড়ে ৫২১ এ আসি। রুম বদলাবার কারন অবশ্য অন্য। ৫২২ এ একমাত্র আমিই ছিলাম ইলেক্ট্রিক্যালের ছাত্র। তাই দেখা যেত পরীক্ষার বেশ ঝামেলায় পড়তে হত। তাই এমন একটা রুম চাচ্ছিলাম যেখানে আমি আমার ডিপার্টমেন্টের কাউকে রুমমেট হিসেবে পাব। এ কারনেই আমার ৫২২ ছেড়ে ৫২১ এ আসা।

আমরা সবাই রকি!

রকিকে (এঁই রঁকি) চেনেনা অথচ ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আইইউটিতে ছিল এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। যারা আইইউটিতে থাকতো না তারাও রকি’র বিভিন্ন কীর্তির সাথে কমবেশি পরিচিত। আজকের এই লেখাটা রকি কে নিয়ে। যারা রকি’র সাথে পরিচিত না তাদের জন্য সাবধানবাণী “রকিকে বেশি জানতে নেই, বেশি জানতে গেলে নিজেই রঁকিতে পরিনত হবার সম্ভাবনা প্রবল।” আর রঁকিতে পরিনত হলে জীবন কেমন ঝুঁকিময় হতে পারে তার অতি ক্ষুদ্র একটা উদাহরন এই লেখাটা!


আমাদের আইইউটিতে অন্যতম মজার আড্ডাটা হয় রাতের বেলায়, রাত বলতে আমি আসলে মাঝরাতের পরের সময়কে বুঝাচ্ছি। আইইউটিতে রাত শুরুই হয় ঠিক মাঝরাতের পর। সেই আড্ডার পরিধি প্রায়ই আইইউটি পার হয়ে পাশের হোটেলগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। তো মাঝ রাতের পর হোটেলে গিয়ে পরোটা-ভাজি খাওয়াটা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে তখন। হঠাৎ আমাদের হ্ল প্রভোস্ট নতুন নিয়ম করলেন। রাত দশটার পর বাইরে যাওয়া বন্ধ। কেউ যদি যেতে চায় তবে গেইটের সিকিউরিটি মামাদের কাছে নাম-ধাম লিখে বাইরে যেতে হবে। নতুন নিয়ম হজম করাটা আমাদের জন্য বেশ কষ্টের। আগেই বলেছি, বাইরে খেতে যাওয়াটা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। একেতো বাঙ্গালী তার উপর আবার আইইউটিয়ান। আমাদের অভ্যাস পরিবর্তন করার চেয়ে বরং ক্যালকুলেটর দিয়ে সুপার কম্পিউটার এর কাজ করা অনেক সহজ। উপায় একটা বের করতেই হবে। যাই হোক যথারীতি রাতের বেলা গেলাম গেইটের কাছে। এখন বের হবার পালা। দেখলাম মামা আমাদের দিকে একটা খাতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সেই রেজিস্ট্রি খাতা যার মধ্যে নাম, স্টুডেন্ট আইডি, রুম নম্বর, বের হবার সময়, ঢোকার সময় এইসব হাবিজাবি লিখতে হবে। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিলো, যদি বাইরে কোন ঝামেলা হয় তাহলে তো নাটস্‌ এন্ড পাটস্‌ (আমাদের দুই হল প্রভোস্ট) পুরা ধুয়ে ফেলবে। কী করা যায়! যেভাবেই হক নিজেদের নাম দেয়া যাবেনা। সাথে ছিল দিপু। বুদ্ধি করলাম যে নিজেদের নাম না দিয়ে বরং রকি’র নাম দিই। এতে ঝামেলা বলতে গেলে একদমই নাই। তো গেলাম রেজিস্ট্রি খাতায় রকির প্রক্সি দিতে। নাম লিখতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হবার দশা। আমার আগেই রকি কমপক্ষে বিশবার এই গেইট দিয়ে আসাযাওয়া করেছে, অন্তত রেজিস্ট্রি খাতা তাই বলে। রেজিস্ট্রি খাতার এক পৃষ্ঠাতেই প্রায় বিশবার রকির নাম লেখা, যদিও হাতের লেখা বিশ রকমের! বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই বোঝার কথা, আমাদের বুদ্ধি অনেক আগেই অন্য পোলাপান আবিষ্কার করে ফেলেছে!

এই আইন যতদিন ছিলো ততদিন রকি ছিলো রেজিস্ট্রি খাতার হিট সেলিব্রিটি আইটেম। কী সিনিয়র কী জুনিয়র, সবাই তখন রকির ভক্ত। এই ভক্তদের বাঁধভাঙ্গা আবেগের সাক্ষী ছিলো ওই রেজিস্ট্রি খাতা। তাদের কল্যাণে প্রতিরাতেই রকির অজস্রবার আগমন-নির্গমন নিয়মিত ঘটনায় পরিনত হলো। রকির এই হিট ইমেজ ফ্লপ করতেই কিনা কে জানে বেশিদিন এই আইন টিকে নাই। তবে এইটা ঠিক যে এই আইন আমাদের সবাইকে আর কিছু না হোক, রকির কাতারে নিয়ে এসেছিলো! আমার সন্দেহ হয় রকি মনে হয় ওর ভক্তকূলের উন্মাদনার কিছুই জানেনা। এই লেখা পড়ে ও যদি কিছু জানে!

ভূত ভূতং ভূতঔ

ঘটনার শুরু আইইউটি’র সাউথ হলের ৫২১ নম্বর রুমে। এক সন্ধ্যায় শাদিদ গল্পটা যখন বলা শুরু করলো তখন শ্রোতা কেবল আমি, দিপু আর মিফতাহ্‌; ৫২১ এর ত্রিরত্ন। গল্পটার কাহিনী অনেকটা এইরকম ছিল,“…রাতের বেলায় এক লোক পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি পড়ছিলো। কিছুদুর যাবার পর সে একটা গাড়িকে রাস্তায় মুখ থুবরে পড়ে থাকতে দেখলো। সাহস করে কাছে গিয়ে সে দেখল এক মহিলার লাশ গাড়িতে পড়ে আছে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, মহিলার পুরো শরীর ভর্তি গহনা! কেউ সেগুলোতে হাত দেয়নি পর্যন্ত। লোকটার মাথায় লোভ মাথাচাড়া দিয়ে ঊঠলো। সে একে একে সব গহনা খুলে নিলো। ঝামেলা বাঁধালো মহিলার ডান হাতের অনামিকার একটা আঙটি। কিছুতেই খুলা যাচ্ছেনা সেটা। লোকটাও ছাড়বার পাত্র নয়। সে পরে সেই অনামিকা কেটে আংটিটা নিয়ে যায়। … বিশ বছর পরের কথা… লোকটা এখন বিশাল বড়লোক। এক বৃষ্টির রাতে সে আবার সেই পথ দিয়ে আসছিলো। হঠাৎ গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। কাছাকাছি এক কুঁড়েতে সে গেলো পানি চাইতে। এক মহিলা ছিল সেই কূঁড়েতে। লোকটা পানি চাইলে সে ভেতর থেকে এক গ্লাস পানি এনে দিল। লোকটা তখন মহিলাকে বিশ বছর আগের সেই কাহিনী বলা শুরু করে। কাহিনী শেষ হলে মহিলা হঠাৎ করে তার ডান হাত বাড়িয়ে দেয় লোকটার দিকে, লোকটা আতংকের সাথে দেখলো মহিলাটার ডান হাতের অনামিকাটা কাটা…” – এটুকু বলে শাদিদ হঠাৎ অনামিকাটা ভাঁজ করে ওর ডান হাত বাড়িয়ে দেয় । এইরকম একটা ভয়ের গল্প শুনার সাথে সাথে এইরকম আচমকা ডান হাত বাড়িয়ে দেয়ায় আমাদের কলিজা পুরা ঠান্ডা হয়ে গেল। ভয় কাকে বলে টের পেয়েছিলাম সেইরাতে।

যাই হোক নিজেরা ভয় পেয়েছি ভালো কথা, তবে পোলাপানদের ভয় দেখানোর একটা উপায়তো পাওয়া গেল!


সাউথ হল, রুম নম্বর ৫১৩। এই রুমের অধিবাসী রাতুল, সাদাত আর আতিক। টার্গেট করলাম সাদাতকে ভয় দেখাব এই গল্পটা বলে। গেলাম ওদের রুমে। রাতুল ছিলনা। আতিক আর সাদাতকে পেলাম। সব আলো নিভিয়ে দিয়ে গল্পের আসর জমিয়ে ফেললাম। গল্প প্রায় শেষ পর্যায়ে… আচমকা ডান হাত বাড়িয়ে দেয়ার সময় আসলো… সাদাতের দিকে বাড়িয়েও দিলাম… কিন্তু এরপর যা ঘটলো তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ খাট থেকে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ পেলাম। আমি আর সাদাত দুজনেই মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম আতিক ভয় পেয়ে পড়ে গেছে। গল্পটা রঙ নাম্বারে চলে গেছে!

আলো জ্বালানো হলো। আতিককে শান্ত করা হলো। বেচারার বুকের ধুকপুকানি তখনো কমেনি। সাদাত বললো ও এই গল্পটা অন্যভাবে শুনেছে। শেষ অংশে নাকি বক্তা নিজের ডান হাত হঠাৎ বাড়িয়ে দিয়ে শ্রোতাকে বলে, “তুই এজন্য দায়ী!” বলতে বলতে সাদাত ব্যাপারটা করেও দেখাল। সে একটু বেশিই জোরে বলে উঠেছিল, কারন সাথে সাথেই আবার ধপ্‌ একটা আওয়াজ। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম আতিক ওর জায়গায় নাই, চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে!


সাউথ হল, রুম নম্বর ৫২১। নিজের রুমে এসে দিপু আর মিফতাহ্কে ৫১৩ তে ঘটে যাওয়া কাহিনী বলছি। এমন সময় দরজায় কেউ নক্‌ করল। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই ওপাশ থেকে কেউ চিৎকার করে বলে ঊঠলো, “তুই এজন্য দায়ী!” … কাজটা আতিকের। হঠাৎ বলে উঠায় ভয়ানক চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু চেহারা ভাবলেষহীন রেখে ওকে আমার চমকানোটা বুঝতে দেইনি। যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরেই ওকে বললাম, “কী ব্যাপার আতিক?” আতিক বেশ অবাক! আমি ভয়-টয় কিছু পাইনাই। বেচারা এসেছিল প্রতিশোধ নিতে। এমন সময় আমার পিছন থেকে আচমকা দিপু এসে আতিকের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে বললো, “তুই এজন্য দায়ী!” আমার চোখের সামনে আতিককে তৃতীয়বারের মতো ফ্ল্যাট হতে দেখলাম… তবে এবার ব্যালকনিতে!