আইইউটিতে যখন প্রথম গেলাম তেমন কাউকেই তখন চিনিনা। নটরডেমের কয়েকজন পরিচিত বন্ধু ছিল… এইযা। এদিকে বাসায় আম্মু চিন্তায় অস্থির! ছেলে প্রথমবারের মত হোস্টেলে থাকতে যাচ্ছে, রুমমেট হিসেবে কারা পড়ে, ওদের পাল্লায় পড়ে ছেলে আবার উচ্ছন্নে যায় কিনা – এইরকম হাজারো চিন্তা! অন্যদিকে আবার বিভিন্ন পরিচিত মানুষজন হোস্টেলে থাকলে ছেলেপেলে কিরকম খারাপ হয় তার একেরপর এক উদাহরন দিয়ে যাচ্ছে রাতদিন।
যাই হোক সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আমার ঠাঁই হলো সাউথ হলের ৫২২ নম্বর রুমে। এই লেখার শুরুতে “প্রথম প্রজন্ম” কথাটা লিখলাম এই কারনে যে আইইউটি জীবনে আমি রুম বদলেছি মোট তিনবার আর রুমমেট পেয়েছি টোটাল দুই সেট। আইইউটিতে প্রথম বছরে আমার প্রথম রুম আর প্রথম রুমমেটদের নিয়ে এই লেখাটা। দ্বিতীয় প্রজন্মের রুমমেটদের কাহিনী আসছে পরের লেখায়।
প্রথম যার কথায় আসছি সে মানুষ হিসেবে ছিলো একদম সাদাসিধা আর মেধাবী। কলেজ লাইফ থেকেই ওকে চিনতাম। ভদ্র শান্তশিষ্ট মানুষ। সহজে কারও উপরে রাগ করেনা। সারাক্ষন ওর পড়া নিয়ে থাকে। একদম সাধারন একটা মানুষ বলতে যা বুঝায়। ও ছিলো সিআইটিতে। প্রায়ই দেখা যেত পরীক্ষার আগের রাতে ওর কাছে ছেলেপেলের ভীড় লেগে যেত। ভাল স্টুডেন্টদের লাইফ যেমন হয় আরকি! নিজের পড়ার খবর নাই, অন্যদের পড়িয়েই রাত কাবার। অবশ্য এখনো ও অন্যদের পড়ায় মানে পাঠশালায় (আইইউটি) টিচারগিরি করে। আরেকজন যে ছিলো সেও নটরডেমে আমার সাথে একই গ্রুপে ছিলো। তবে ওর আসল নাম জেনেছি আইইউটিতে আসার পর। নটরডেমে সবাই ওকে ডেঙ্গু নামে চিনতো। এই নামেরও এক ইতিহাস আছে। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই ওর ডেঙ্গু হয় আর ডেঙ্গু জ্বর তখন সবেমাত্র বাংলাদেশে আমদানী হয়েছে। তো বেচারা First Come First Serve অবস্থায় পড়ে গেলো। সম্ভবত ওই ছিলো নটরডেমে প্রথম ডেঙ্গু ধরা পাবলিক। সেই থেকে ওর নাম ছিল “ডেঙ্গু”। তো এই ডেঙ্গু প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে মশারির ভিতর কিসব বিদঘুঁটে সব শব্দ করে ঘুমাতে যেত। মোটামুটি যখন ওই শব্দের সাথে মানিয়ে নিয়েছি তখন একদিন শুনি ও বুয়েটে চলে যাচ্ছে। ও আমাদের সাথে ছিলো প্রায় দুই সপ্তাহ। ৫২২ নম্বর রুম থেকে ডেঙ্গু বিদায় নেবার পর ওর জায়গায় আসলো এক দার্শনিক। এই দার্শনিকের কথায় একটু পরে আসছি। তার আগে আরেক রুমমেটের সাথে পরিচয় করানো দরকার।
এই বান্দা ছিলো আমাদের তুলনায় বিশালদেহী। গলার আওয়াজও ছিলো মাশাল্লাহ… ওই গলার আওয়াজ ছাপিয়ে কথা বলা আর বাংলাদেশ রেলওয়ের চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনের ছাদে বসে ফোনে কথা বলা প্রায় একই জিনিস। সত্যি বলতে কি ও রুমে ছিল বলে আমাদের বেশ সাহস লাগতো। একদিনের ঘটনা। তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছিলো। স্টুডেন্ট সেন্টারে ভীড়ের ঠেলায় ঢোকাই যেতনা! এদিকে আবার দুইটা টেলিভিশনই স্টুডেন্ট সেন্টারে। আমার ‘দশাসই’ রুমমেট তখন বিশ্বকাপ মহামারিতে চরমভাবে আক্রান্ত। ঝোকের চোটে নিজের বাসা থেকে টেলিভিশন নিয়ে আসলো সে। সেটা রাখা হলো আমাদের রুমে। কেবল মাত্র আমাদের চারজনের ওই টিভিতে খেলা দেখার কথা থাকলেও মোটামুটি আমাদের ইয়ারের সবাই চলে আসতো খেলা দেখতে। সবার সাথে আমার এই রুমমেটের ভাল ভাব থাকলেও কয়েকজনের সাথে খিটমিট ছিলো। তো দেখা গেলো এক সন্ধ্যায় খেলা দেখতে সেসব খিটমিটদের একজনের আমাদের রুমে আগমন। একে দেখেই ‘দশাসই’ এত ক্ষেপে গেল যে ওর গলার আওয়াজ শুনে নীচতলা থেকে সিনিয়র ভাইরা সব ছুটে উপরে এল কী হয়েছে তা দেখতে! এই বান্দা আবার মাঝে মাঝে ঘুমের মাঝে নাকে হাল্কা হিমেশ রেশামিয়া টাইপ সুর তুলতো। ওর সুরে তেমন জোর ছিলোনা (এইটা অবশ্য জেনেছি আসল হিমেশের ‘নাক’ শোনার পর!) অনেকটা মশার পিনপিন শব্দ। এবার আসি দার্শনিকের কথায়। এই দার্শনিক আমাদের রুমে আসলো ‘ডেঙ্গু’ বিদায় নেবার পর। ‘ডেঙ্গু’ বিদায় হবার সময় ওর যাবতীয় সম্বল (লেপ, তোষক, বালিশ, বিছানার চাদর এইসব হাবিজাবি যা ও আমাদের পাঠশালা থেকে নিয়েছিল) ফেরৎ দিয়ে দিলো। ফলে আমাদের রুমটাতে চারটা খাটের মধ্যে একটাকে পুরোপুরি জীর্ণ মনে হচ্ছিলো। সেদিন ক্লাস থেকে ফিরে এসে দেখি সেই জীর্ণ খাটে একটা তোষক আর দুইটা বালিশ পড়ে আছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি তোষকের উপর বিছানার চাদর, লেপ, কম্বল এইসব পড়ে আছে। ব্যাপার কী! ‘ডেঙ্গু’ ফিরে এল নাকি! ব্যাপারটা পরিষ্কার হল যখন আমি বাথরুম থেকে গোসল সেরে রুমে ফিরলাম তখন। এসে দেখি সেই জীর্ণ খাট তার দৈন্য চেহারা থেকে একেবারে সুপুরুষ হয়ে গেছে, আর সেই খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে আরেক পুরুষ, মানে সেই দার্শনিক পুরুষ আরকি! সেই থেকে দার্শনিকের ৫২২ এ থাকা শুরু। এই দার্শনিক সবসময় ভাবুক মনে কেবল কী যেন চিন্তা করে। প্রায়ই সময় সে খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে ওর বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে হাতে কলম নিয়ে খেলা করতো আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে কী যেন ভাবতো। তো দেখা যেত যে এই দার্শনিকের কাছে প্রায় সব কিছুরই একটা উত্তর থাকত, সেটা পড়াশুনা নিয়েই হোক অথবা ভবিষ্যৎ জীবন। যেকোন কথা শুনে সে একটা সূক্ষ্ম হাসি দিত। হাসিটা বেশ বিভ্রান্তিকর ছিল, ছোট বাচ্চাদের অর্থহীন কথা শুনলে বড়রা যেমন হাসি দেয় অনেকটা সেরকম। তবে পড়ালেখায় ছেলের মাথা ভালো ছিল। আমার সন্দেহ ছিলো ও বুঝি মাঝে মাঝে কবিতা টবিতা লিখতো (যদিও কখনো প্রমান পাই নাই)। পুরো ২০০৩ সাল আমি ৫২২ নম্বর রুমে এই তিনজনের সাথে ছিলাম। সত্যি বলতে কি বেশ ভাল ছিলাম। ওই তিনজন রুমমেট হিসেবে খুবই দারুন ছিল। ২০০৩ এর শেষ দিকে সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে আমি ৫২২ ছেড়ে ৫২১ এ আসি। রুম বদলাবার কারন অবশ্য অন্য। ৫২২ এ একমাত্র আমিই ছিলাম ইলেক্ট্রিক্যালের ছাত্র। তাই দেখা যেত পরীক্ষার বেশ ঝামেলায় পড়তে হত। তাই এমন একটা রুম চাচ্ছিলাম যেখানে আমি আমার ডিপার্টমেন্টের কাউকে রুমমেট হিসেবে পাব। এ কারনেই আমার ৫২২ ছেড়ে ৫২১ এ আসা।
পড়তেছি কিন্তু ! 😀
পড় পড়…
হুমম। রাতুল? কোন রাতুল? তাবলীগের রাতুল নাকি? সে তো কলেজ থেকে আমার ভাল বন্ধু! যাই হোক, মনে হচ্ছে, নটরডেম কলেজে এই ব্লগার আর আমার ব্যাচ একই। ২০০২ HSC. ঘটনাগুলো মজার নিঃসন্দেহে। কিন্তু বড্ড তাড়াহুড়ো করে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে! আরেকটু রয়েসয়ে গল্প জমিয়ে পাঠককে খাওয়ালে কেমন হয়? অবশ্য এই বোধ পাঠকের অক্ষমতার কারণেও হতে পারে।
হুমম… একই ব্যাচ। সাত নম্বর গ্রুপে ছিল আমার ঠাঁই।প্রথমবার ধন্যবাদ দিচ্ছি লেখার ধার বাড়ানোর উপায় বলার কারনে। দ্বিতীয়বার ধন্যবাদ দিচ্ছি লেখা নিয়ে আসল কথা বলার কারনে। লেখাগুলো একটু দৌড়ের উপর আছে সেটা বুঝতে পারছিলাম। অবশ্য নব্য লেখকদের ধার তেমন থাকেনা বললেই চলে। তাই তাদের সব লেখাই হয় আবজাব। 😀 লেখক হিসেবে আমি নব্যদেরও নব্য। তাই লেখারা দৌড়ালেও তাদের ধরে থামাতে পারছিনা। চেষ্টা করব পরের লেখাগুলো জমিয়ে লিখতে।
ভাইয়া আপনি কি এখনও IUT তে আছেন?
আপনার ফোন নং আমার খুব দরকার।
ই-মেইল করে পাঠানো যাবে প্লিজ?
ronyiuteee@yahoo.com
ভাইয়া,আমিও ৫২১ এ দুই বছর ছিলাম। 3rd & 4th year…আপনার লেখাতা পড়ে রুম টাকে অসম্ভব মিস করছি। recently ছেড়ে আসছি তাই। আমি CIT;07এর.