পাঠশালায় যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম পুরোন বছরের সাথে সাথে নিজের রুমখানাও বদলে ফেললাম। ৫২২ নম্বর রুম থেকে আমার নতুন ঠাঁই হল ৫২১ এ। রুমটার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটা একেবারে বাথরুমের সাথে লাগোয়া। এতে একটা সুবিধা হয়েছিলো যে বাইরের সবাইকে বলে বেড়াতাম আমাদের রুমের সাথে একেবারে এটাচ্ড বাথরুম আছে! ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে আমাদেরকে প্রতি রুমে চারজন করে থাকতে হোত। সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর এক রুমে তিন জন থাকার পারমিশন পাওয়া গেল। সে হিসেবে ৫২১ এ চার জন ছিলো যাদের দুইজন সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতেই অন্যরুমে চলে যায়। তাছাড়া আমারো সমস্যা হচ্ছিল, কারন ৫২২ এ আমার ডিপার্টমেন্টের কেবল মাত্র আমি ছিলাম। ফলে দেখা যেত আমাকে পরীক্ষার আগে প্রায়ই অন্যরুমে পড়া বুঝতে ছুটতে হত। তাই দিপু আর মিফতাহ যখন ওদের ৫২১ নম্বর রুমে আমাকে থাকার কথা বল্লো, একেবারে কোন কিছু চিন্তা না করেই রাজী হয়ে গেলাম। ভাগ্যিস হয়েছিলাম, নাহলে আমি আমার জীবনের খুব কাছের দুজন বন্ধুকে কখনোই পেতাম না।
ফাইনাল ইয়ারে আমরা তিনজন রুম পালটে তিন তলার ৩১৫ নম্বর রুমে চলে আসি। তার আগ পর্যন্ত বাথরুমের পাশের এই রুমটাতেই দুই বছর কাটিয়ে দেই। পাশে বাথরুম থাকাতে কখনোই কোন সমস্যা হয় নাই… কেবল মাত্র একবার ছাড়া, যেবার বাথরুমের টয়লেটগুলো ওভারফ্লো করেছিলো! আরেকটা ব্যাপার, কোন এক অজ্ঞাত কারনে প্রায়ই মাঝরাতের পর চামচিকা ঢুকে পড়ত আমাদের রুমে। এত রুম থাকতে আমাদের রুমেই কেন বারবার ঢুকত কে জানে?
এই রুমে আমার সাথী হল দিপু আর মিফতাহ। আমাদের ব্যাচ যতদিন পাঠশালায় ছিল ততদিন সম্ভবত সবচেয়ে দুই জনপ্রিয় চরিত্র ছিল এই দুইজন। এখনো সবাই একনামে এই দুজনকে চেনে। আমাদের তিনজনের মধ্যে প্রচুর মিল ছিলো। তিনজনই বকবক করতে পছন্দ করতাম। তিনজনেরই বাসা ছিল একই জায়গায়। আমাদের গ্রামের বাড়িও ছিল একই জেলায় – ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়। আমাদের রুমের নামই হয়ে গিয়েছিলো বিবাড়ীয়া এক্সপ্রেস! বলতে ভুলে গেছি, আমাদের তিনজনই একই ল্যাব গ্রুপে ছিলাম।
মিফতাহ’র যে গুনটা সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলো সেটা হলো, সে যেকোন ঘটনা এত দারুন করে বলতে পারত যে বোঝা মুশকিল সে ওই সময় ওই জায়গায় ছিলো কিনা কিংবা ওই ঘটনা আদৌ ঘটেছিলো কিনা। ব্যাপারটা কিছুটা চাপা মারার মত কিন্তু ঠিক চাপা না। তবে নিজের বাহাদুরির জন্য কখনো এসব বলত না। ও ছিল কিছুটা আরামপ্রিয়। সকালের ক্লাস গুলোতে ওকে তেমন একটা পাওয়া যেতনা, ঘুমের জন্য। তবে শনিবার ছিলো ব্যতিক্রম, কারন ওই দিন আমাদের পাঠশালার ভোজনখানার সকালের মেনু ছিল গরম গরম তেহেরি। অকাটমূর্খ ছাড়া ওই জিনিস কেউ মিস করেনা। ওর আরেকটা মহা গুণ হলো মাথায় একবার কিছু ঢুকলে অন্তত দুইদিন ওই জিনিস ছাড়া ও আর কিছু ভাবতে পারতোনা। তবে দুই দিন পর সব আবার আগের মত! একবার মাথায় চাপলো কবিতা লিখবে, ব্যস আর যায় কোথায়… খাতা -টাতা খুলে কবিতা লেখা শুরু করলো। তিনদিন পর মনে হল কবিতা লেখা পোষাবেনা, উপন্যাস লিখা দরকার… সাথে সাথে আরেকটা খাতার আগমন , এবার উপন্যাসের পালা! আরেকবার মাথায় চাপলো সকালে উঠে জগিং করবে, যেমন কথা তেমন কাজ, প্রতিদিন ভোরে শখের বিছানা ছেড়ে জগিং এর জন্য উঠত। এভাবে চললো প্রায় দুই দিন। তবে সবচেয়ে বেশিদিন যেটা টিকেছিলো সেটা হল দাবা খেলা। হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই কোথা থেকে এক দাবার বোর্ড জোগাড় করে নিয়ে আসলো। তারপর একে একে সবাইকে দাবার চ্যালেঞ্জ দিত। কেউ না চ্যালেঞ্জ না নিলে প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে বসাতো দাবা খালানোর জন্য। মনে আছে, একবার রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আমার চোখের সামনে যে দৃশ্য ছিল তা হল ও আর রায়হান গভীর চিন্তা মগ্ন হয়ে দাবা খেলছে। এ দেখতে দেখতেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। প্রায় ছয় ঘন্টা পর ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি একই দৃশ্য! ছয় ঘন্টা ধরে দুজনে দাবা খেলছে, তাও আবার পুরোরাত না ঘুমিয়ে! ফাইনাল ইয়ারে ওর পাঠশালার ভেতর সাইকেল চালানোর খুব শখ হল। সেই শখ মেটাতে ও ঢাকায় এসে সাইকেল কিনলো, সেটা কে ঢাকা টু গাজীপুর বাসের ছাদে তুলে সোজা পাঠশালায় নিয়ে আসলো। তবে ঐ বস্তু চালাতে গিয়ে আমার বেশ বাজে অভিজ্ঞতা চছে। পাঠশালায় আনার পর সেটা চালাতে গিয়ে আমি একেবারে রাস্তার উপর ধপাস্ করে ফ্ল্যাট!
এবার আসা যাক দিপুর কথায়। এই ছেলে আবার মিফতাহ’র মত না। মিফতাহকে যত সহজে বর্ণনা করা গেলো, একে আবার তত সহজে করা সম্ভব না। দিপুকে কোন ছাঁচে ফেলা মুশকিল। এই বান্দা’র পড়াশুনায় মাথা যথেষ্ট ভাল (যদিও সে কখনো ওর মাথার পঞ্চাশ পার্সেন্টও ব্যবহারকরে নাই)। ওর পড়াশুনার স্টাইল ছিল কিম্ভুত। মাঝে মধ্যেও বিছানায় এমনভাবে শুয়ে পড়াশুনা করত যে দেখে বোঝার উপায় নাই ও পড়ছে না ঘুমাচ্ছে! ওর পড়াশুনার প্রিয়জায়গা ছিল ওর টেবিল (চেয়ার না কিন্তু) যেটার উপর প্রায়ই সে একেবারে দুপা তুলে আসন করে বসতো। একবার দেখি ও বাথরুমে গিয়ে পড়ছে। জিজ্ঞেস করায় বললো ওর নাকি বাথরুমের নিশব্দতায় খুব ভালো পড়া হয়! প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার জন্য ও ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতো। সকালে এলার্ম বেজেই চলত, কিন্তু ওর ঘুম থেকে উঠার সামান্যতম লক্ষণ দেখা যেতনা। আমাকে বা মিফতাহকেই সকালে সাধের বিছানা ছেড়ে ওই এলার্ম বন্ধ করতে হত! কোন রুমে একটু আড্ডার গন্ধ পেলেই হত, দিপু নিমিষেই সেখানে হাজির। যেকোন আড্ডায় ও ছিলো মধ্যমণি। ও যে কারো কথা বলার ধরন নিঁখুতভাবে নকল করতে পারতো। আমাদের তিনজনের মধ্যে একমাত্র দিপুই মূভি খুব একটা দেখতোনা (যদিও আমাদের মত খুব কার্টুন দেখত)। তবে ও ভোজন রসিক। বলতে দ্বিধা নাই ওর পাল্লায় পড়ে ফার্মগেটের ওভারব্রিজের তলায় বিসমিল্লা’র হালিম থেকে শুরু করে এলিফ্যান্ট রোডের মালঞ্চ বা ধানমন্ডির স্টারের বোরহানী কোন কিছুই বাদ দেইনাই। বন্ধুদের জন্য দেদারসে টাকা পয়সা খরচ করে ও। ওর মত রসিক মানুষও আমি খুব একটা দেখি নাই। যেকোন পরিস্থিতিতে যে কাউকে হাসানোর ক্ষমতা একমাত্র ওরই আছে। স্বিদ্ধান্ত দিতে ওর কম সময় লাগতো আবার সেটা বদলাতেও বেশি সময় লাগতনা। সেকেন্ড ইয়ারের একটা ঘটনা, মিড সেমিস্টার পরীক্ষা ওর ভাল হয়নি, মন খুব খারাপ। প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে, ও আমাদের পূরো রুমে বিভিন্ন স্লোগান লিখে পোস্টারিং করে ফেললো। পোস্টারের ভাষাও দেখার মত, একেটাতে একেক ধরনের লেখা। ।কোনটা উৎসাহমূলক -“এইবার পড়তে হবে”, “কোন সাব্জেক্টকে ছাড়ন নাই”, “এই পরীক্ষা তো পরীক্ষা নয় আরো পরীক্ষা আছে, এই পরীক্ষারে নিব আমি সেই পরীক্ষারও কাছে”; আবার কোনটা হয়ত তিরস্কারমূলক -“দিপু, এইবার না পড়লে তোরে খাইসি”, “ফাউল কামে আর কত, এইবার পড়ায় মন দাও”। ভয়ের ব্যাপার, অবস্থা তো বেগতিক। আমরা ভাবলাম ছেলে না আবার পরে পরীক্ষার দুঃখে অন্যকিছু করে বসে। এক সময় পরীক্ষা শেষ হল। খাতা দেয়া যখন শুরু হল তখন দেখা গেল ও যত খারাপ খারাপ করবে ভেবেছিলো আসলে তত খারাপ হয়নাই পরীক্ষা। পরীক্ষা যখন খারাপ হয়নাই তাহলে পোস্টারের দরকার কী! একটা একটা করে সাব্জেক্টের খাতা দেয়া হতে থাকল আর আমাদের রুম থেকেও পোস্টার কমতে থাকলো। একসময় দেখা গেলো সব পোস্টারই হাওয়া হয়ে গেছে!
পাঠশালার শেষ দিনটি পর্যন্ত আমরা একসাথে ছিলাম। হোস্টেলে অনেক রুমে রুম্মেটদের মধ্যে ঝগড়া এমনকি মারামারিও পর্যন্ত দেখেছি। কত রুমে রুম্মেটদের মাঝে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নাটক দেখেছি। কিন্তু আমাদের তিনজনের মধ্যে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও কোন ঘাপলা হয়নি। তিন বছরের মধ্যে বরং আমাদের বন্ধুত্ব আরো মজবুত হয়েছে, যেটা এখনো হয়ে চলেছে। আমার রুম্মেট ভাগ্য আসলেই ঈর্ষা করার মত।
আহারে!! কী সুন্দর দিনগুলো ছিলো!!
হুমমম… ভয়াবহ মিস করি দিনগুলোকে! 🙁
মিফতাহ ভাইয়ের মুখে শোনা কথাগুলিই আবার মিলিয়ে নিলাম। স্টকহোমে মিফতাহ ভাই এর দিন শেষে মন খারাপ করা একটা চা না হলে চলতই না আমাদের!