“তাহলে লিখে দেই যে গরুর রং শ্যামলা?” – লোকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার আর মিরাজ মামার দিকে তাকিয়ে রইল। মিরাজ মামার ততক্ষণে ধৈর্য বলতে যে জিনিসটা থাকার কথা ছিল সেটা বাতাসে মিশে গেছে। ধৈর্যহারা মিরাজ মামাকে দেখতে তেলেগু সিনেমার হিরোদের মত লাগছিল – যারা এক ঘুষিতে মানুষ তো মানুষ, গাড়ি পর্যন্ত ভর্তা করে ফেলে। তেলেগু সিনেমার নায়কদের মতই মিরাজ মামা তখন কটমট করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি ব্যপারটাকে আয়ত্ত্বে আনার জন্য তাড়াতাড়ি বললাম – “জ্বী ভাই লিখে দেন – গরুর গায়ের রং শ্যামলা!”
আমার কথা শুনে লোকটা মহা উৎসাহে লিখে দিল যে গরুর গায়ের রঙ শ্যামলা। লোকটার উৎসাহ দেখে মিরাজ মামার মনে কি খেলা করছিল জানিনা, কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে কী কুক্ষণেই যে হাসিল দেবার জন্য এই লোকটার খপ্পরে পড়লাম!
এই কাহিনীর শুরু গতকালকে, ঈদের ঠিক দুইদিন আগে, যখন গাবতলী থেকে আমাদের আর মিরাজ মামার গরু দুটো কেনা হল। গরু কেনার পর গরু দুটোকে বাসায় নেবার জন্য নীল রংয়ের পিকআপ ভ্যান ঠিক করা হল। গরু দুটোকে পিকআপ ভ্যানে তুলে ফেলার পর ছোটমামা আর আব্বুকে পিকআপের সামনে রেখে আমি আর মিরাজ মামা ছুটলাম হাসিলের কাউন্টারের দিকে। কয়েক মিনিটের ব্যাপার। হাসিলের টাকা দেয়া হয়ে গেলেই গরু দুটো নিয়ে পিকআপ ভ্যান ছুটবে ধানমন্ডির দিকে। একটা গরু নামবে মিরাজ মামার বাসায়, আরেকটা আমাদের বাসায়।
হাট থেকে বের হবার মুখে কাছাকাছি ছিল ৪ নম্বর হাসিল ঘর। দু’জনেই চলে গেলাম সেখানে। লম্বা টানা টেবিলে বসে অনেক কর্মচারী হাসিলের টাকা নিচ্ছেন, গুণছেন তারপর রশিদ ধরিয়ে দিচ্ছেন। কয়েক মিনেটের কাজ। আমি আর মামাও এক কর্মচারীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মামা বললেন – “ভাই, দুইটা গরুর জন্য আলাদা হাসিলের রশিদ দেন।”
লোকটা মনে হল একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল। চোক পিটপিট করে বলল – “দুইটা আলাদা গরুর জন্য একটা রশিদ দিব?”
আমি তাড়াতাড়ি বললাম – “নাহ, ভাই। দুইটা গরু আলাদা, একটা আমার আরেকটা আমার মামার। ওদের হাসিলও তাই আলাদা কাগজে হবে। বুঝলেন?”
লোকটা আরও বিভ্রান্ত হয়ে গেল – “মানে আপনারা দুইজন মানুষ, দুইটা গরু কিনসেন। দুইটা গরুর জন্য আলাদা হাসিল একটা কাগজে লিখে দেব। তাইতো!”
নাহ লোকটাকে বুঝাতে পারিনাই ব্যপারটা। মিরাজ মামা ব্যাপারটা বোঝাবার বলল – “দুইটা গরু, দুইটা হাসিল, দুইটা কাগজে হবে – বুঝলেন?”
লোকটা মনে হল এবার বুঝতে পারল। সে ঘাড় নেড়ে বলল – “দুইটা আলাদা হাসিল – এইবার বুঝলাম!” তারপর মামার গরুর দাম জিজ্ঞেস করে একটা লম্বা লিস্টি দেখে বলল – “আপনার হাসিল তিন হাজার পাঁচশ তিরিশ টাকা। তিরিশ টাকা পলিথিনের জন্য।”
“পলিথিন!” – আমি আর মামা দু’জনেই অবাক। “পলিথিন কেন কিনব?”
“সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম। প্রতিটা গরু-ছাগলের সাথে তিরিশ টাকা দিয়ে একটা করে পলিথিন নিতে হবে।”
“পলিথিন নিবনা। বাসায় প্রচুর পলিথিন রয়েছে।” – আমার সোজাসাপ্টা কথা।
“পলিথিন না নিলে হাসিল দিতে পারবনা, এইটাই এইবারের নিয়ম।” – লোকটার নির্লিপ্ত জবাব।
মহা ভ্যাজাল দেখি! মামা অবশ্য ভ্যাজালে গেলেন না। উনি সব মেনে নিয়েই চার হাজার তিরিশ টাকা দিয়ে দিলেন কাউন্টারের লোকটাকে। টাকা পেয়ে লোকটাকে আবার বিভ্রান্ত মনে হল – একবার টাকার দিয়ে তাকাচ্ছে আরেকবার মামার দিকে তাকাচ্ছে। তারপর একসময় বলল – “আপনি এত টাকা দিলেন কেন?”
“ভাংতি নাই” – মামার নির্লিপ্ত জবাব।
“তাহলে চার হাজার দিতেন, তিরিশ টাকা বাড়তি দিলেন কেন?” – লোকটার অবাক করা প্রশ্ন।
“যাতে আপনি সহজেই পাঁচশ টাকা ফেরত দিতে পারেন।”
“পাঁচশ টাকা ফেরত দেব?”
আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম লোকটা আসলে হিসেব বুঝতে পারছেনা। তিরিশ টাকা বাড়তি দেয়াতে তার সব হিসেব গড়বড় হয়ে গেছে। আমি শিক্ষক মানুষ। এত সহজে এই লোকটাকে ছেড়ে দিলাম না, বরং তাকে বেশ কষ্ট করেই হিসেবটা বুঝিয়ে দিলাম। একসময় মনে হল যে সে হিসেবটা বুঝতে পেরেছে। সে রশিদে লেখা শুরু করল।
“গরুর ক্রেতার নাম কি?”
“মিরাজ।” – মামার দ্রুত জবাব। লোকটা ঘ্যাশঘ্যাশ করে নামটা লিখে ফেলল।
“কই যাবে?”
“ধানমন্ডি”।
লোকটা ভ্রু কুঁচকে তাকাল – “ওটাতো থানার নাম বললেন, পুরা ঠিকানা বলেন।”
এত ঢিমে তালে হাসিলের কাজ দেখে মামার মেজাজ ততক্ষণে গরম হয়ে উঠেছে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম – “লিখেন ধানমন্ডি ১৫।”
লোকটা লিখে চলল। মামা এ পাশ থেকে ফোড়ন কেটে বলল – “থানা লিখলেন। জেলাও লেখেন। জেলা ঢাকা।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল – “জ্বি ভাল কথা বলেছেন। এই যে লিখে দিচ্ছি।” বলেই ঘ্যাশঘ্যাশ করে লিখে ফেলল ঠিকানা।
“গরুর বিক্রেতার নাম কি?”
“করিম” – মামা ঝটপট মাথা থেকে একট নাম ঝেড়ে দিল।
“আগে পড়ে কিছু নাই? মোহাম্মদ করিম কিংবা করিম মিয়া?”
“না ভাই, কিছু নাই। শুধু করিম।”
“কোত্থেকে আসছে?”
“কুষ্টিয়া।” – বানিয়ে বানিয়ে আমি বললাম।
“গরুর গায়ের রঙ?”
“ধুসর।” আমি ঝটপট জবাব – “ ছাইও বলতে পারেন।”
লোকটা আবারও বিভ্রান্ত – “গরুর রং কি ছাই হয়?”
“জ্বি হয়। কালো আর সাদার মাঝামাঝি একটা রং।” – আমি যথাসাধ্য বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটা মনে হয় বুঝতে পারছেনা।
লোকটা বলল – “শ্যামলা বলা যায়?”
মামা ততক্ষণে রাগে ফেটে পড়ছে। দাঁত চিবিয়ে মামা বলল – “হয়, আমি ছাই রংয়ের গরুই কিনেছি। শ্যামলা লিখবেন কেন?”
“ছাই রংয়ের গরু তো হয়না , আমি বরং শ্যামলা লিখি। কী বলেন?” – লোকটা এখনও বিভ্রান্ত। “তাহলে লিখে দেই যে গরুর রং শ্যামলা?” – লোকটা আমাদের দিকে তাকাল।
মিরাজ মামার ততক্ষণে ধৈর্য বলতে যে জিনিসটা থাকার কথা ছিল সেটা বাতাসে মিশে গেছে। ধৈর্যহারা মিরাজ মামাকে দেখতে তেলেগু সিনেমার হিরোদের মত লাগছিল – যারা এক ঘুষিতে মানুষ তো মানুষ, গাড়ি পর্যন্ত ভর্তা করে ফেলে। তেলেগু সিনেমার নায়কদের মতই মিরাজ মামা তখন কটমট করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি ব্যপারটাকে আয়ত্ত্বে আনার জন্য তাড়াতাড়ি বললাম – “জ্বী ভাই লিখে দেন – গরুর গায়ের রং শ্যামলা!”
আমার কথা শুনে লোকটা মহা উৎসাহে লিখে দিল যে গরুর গায়ের রঙ শ্যামলা। মামার গরুর জন্য রশিদ লেখা শেষ, এবার আমার গরুর জন্য রশিদ লেখার পালা।
লোকটা আমার দিকে তাকাল। গরুর দাম জানতে চাইল। দাম শুনে লোকটা আবার সেই হাসিলের লিস্টি দেখে জানাল যে আমার হাসিল হচ্ছে আড়াই হাজার পাঁচশ তিরিশ টাকা। আমি তৈরি হয়েই ছিলাম, লোকটা বলা মাত্রই তিন হাজার তিরিশ টাকা বের করে দিয়ে বললাম – “এইবার তিরিশ টাকার হিসেব বুঝলেন তো?”
লোকটা মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে। তারপর নাম আমার নাম জিজ্ঞেস করল। মিরাজ মামা ঝটপট আমার ডাকনাম বলে দিল – “তানিম।”
“তামিম?” – লোকটা মনে হল ঠিকভাবে শুনেনি তাই আবার জিজ্ঞেস করল।
“না, তানিম।” – মিরাজ মামা আবার বলল।
“তামিম?” – লোকটা একই প্রশ্ন আবার করল।
মিরাজ মামা ক্ষেপে যায় কীনা, সেই ভয়ে আমি তাড়াতাড়ি বললাম – “জ্বি ভাই, আপনি যেটা বলছেন সেটাই ঠিক, ঐটাই লিখেন।”
লোকটা বিভ্রান্ত হয়ে মিরাজ মামাকে দেখিয়ে বলল – “কিন্তু উনি তো বললেন অন্য নাম।”
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম – “না ভাই, আপনি যা বলছেন, উনি সেটাই বলেছেন। চারপাশে অ্যাত্ত শব্দ ঠিকমত শোনা যায় নাই।” এমনিতেই সময় নষ্ট হচ্ছে, তারউপর নাম ঠিক করতে গিয়ে আরও সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই। ভুল নামই সই। উনি হৃষ্টচিত্তে আমার ভুল নামখানা লিখলেন। তারপর ঠিকানা জানতে চাইলেন। তাকে বললাম আগের ঠিকানাটাই লিখেন। লোকটা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল – “আপনারা একই জায়গায় থাকেন?” আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এসব তুচ্ছ কারণে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন কারণ নেই। যে কাজ এক মিনিটে হবার কথা সেটা ইতিমধ্যেই পনের মিনিটে চলে গেছে, ঐ দিকে গরু নিয়ে পিকআপ ভ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আব্বু আর ছোটমামার কী অবস্থা কে জানে!
“গরু বিক্রেতার নাম?” – লোকটা জানতে চাইল।
“ভাই, ঐ একই লোক, কুষ্টিয়ার করিম।” – পটাপট বললাম।
লোকটা আমাদের দিকে তাকাল – “দুই জনে একই জায়গায় থাকেন, আবার একই লোকের কাছ থেকে গরু কিনসেন। বাহ বাহ।”
এতে বাহ বাহ হবার কি আছে জানিনা, কিন্তু আমি আর কথা বাড়ালামা না। মিরাজ মামা অনেকক্ষণ চুপচাপ লোকটার সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছে। মামা যাতে ক্ষেপে না উঠে সে জন্য লোকটা কিছু বলার সাথে সাথেই আমি জবাব দিয়ে দিচ্ছি।
“গরুর রঙ?” – লোকটা জিজ্ঞেস করল।
“একই রং, শ্যামলা।”
লোকটা এবার মারাত্মকবাবে বিভ্রান্ত হয়ে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল – “ভাই আপনারা থাকেন একই জায়গায়, একই লোকের কাছ থেকে একই রঙয়ের গরু কিনসেন। আপনারা আলাদা আলাদা রশিদ করতেসেন কেন?”
এবার আমার ধৈর্যহারা হবার পালা। আমি রেগেমেগে কিছু একটা বলতে যাব এই সময় দেখি মিরাজ মামা লোকটার কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে বলল – “আমি আপনার কাছে পাঁচশ পাই, আর আমার ভাইগ্না পায় পাঁচশ। মানে মোট এক হাজার টাকা পাই। এই এক হাজার আমি নিয়ে নিলাম, আর আমার ভাইগ্নাকে পাঁচশ টাকা আমি দিয়ে দিলাম। সব ঠিক আছে?”
মিরাজ মামা এত দ্রুত টাকার ব্যালান্স করে ফেলল যে লোকটা আমাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার চেহারা দেখেই বুঝলাম, অংকটা তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছেনা। আমি মামাকে বললাম – “ওকে এক হাজার টাকার নোটটা দিয়ে দেন। নাইলে ওর হিসেবে প্যাঁচ লেগে যাবে।”
মিরাজ মামা পুরাই ক্ষেপচুরিয়াস – “নাহ, এই লোক আগে এই অবস্থায় পুরা হিসাব বুঝবে, তারপর আমি এখান থেকে যাব। সময় যখন নষ্ট হলই, তখন আর কয়েক মিনিট নষ্ট হলেও কিছুই হবেনা।”
লোকটা অবশেষে হিসেবটা অবশ্য বুঝে ফেলল। কিভাবে বুঝল তা জানিনা, কিন্তু বুঝে ফেললো। অবশেষে রক্ষা পেলাম। এক মিনিটের কাজ আধা ঘন্টায় শেষ করে আমরা মামা-ভাগ্নে দৌড়ে পিকআপের কাছে চলে গেলাম। গরু নিয়ে বাসায় যেতে হবেনা!
যাই হোক, রাত পোহালেই ঈদ। সবাইকে ঈদ মুবারাক!