বাংলার জনগন আসলে ফুটবলকেই প্রথম ভালবেসেছিল, কিন্তু পরে পারিবারিক চাপে পড়ে ক্রিকেটকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।
চারপাশে বিশ্বকাপ উন্মাদনা দেখে তাই-ই মনে হয়। সুন্দরবনের জনবিরাণ কিছু এলাকা ছাড়া বাংলাদেশে এই মুহুর্তে কোন খোলা জায়গা নাই। যেদিকেই তাকান, দেখবেন চারপাশে বিভিন্ন দেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। বিভিন্ন দেশ বললে অবশ্য কিছুটা ভুল হবে। বলা উচিত সাদা-আকাশী আর হলুদ-সবুজ পতাকায় চারদিক ছেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ইতালি-জার্মানি আর হালের ক্রেজ স্পেনের কিছু পতাকাকে সংখ্যালঘু হিসেবে উড়তে দেখা যায়। শুধু কি পতাকা, লোকজনের জামার রং পর্যন্ত পাল্টে গেছে। শুধু অল্পবয়সী ছেলেপেলেরাই নয়, বরং প্রচুর সংখ্যক আঙ্কেল-আন্টিকেও চারপাশে হলুদ-আকাশী জার্সি পড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে! আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। আর বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক যদি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হয়, তাহলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৮ কোটি (আমার বিশ্বাস সংখ্যাটা আরও বেশিই হবে, কোন এক অদ্ভুত কারণে বাংলার সিংহভাগ জনগন ৩০ বছর ধরে কোন বিশ্বকাপ না জেতা এই দলটিকে অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে যায়)। অর্থাৎ বিশ্বে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বেশি সাপোর্টার আর্জেন্টিনার বাইরের আরেকটা দেশে! পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন হয় বলে আমার জানা নেই। এরই নাম বাংলাদেশ! আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ফুটবল নিয়ে চার বছর পর পর এক মাসের জন্য আমাদের দেশে যে ভয়ানক মাতামাতি হয়, তা ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার চেয়ে কোন অংশে তো কম নয়ই, বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা অনেক বেশি। শুধু একটাই আফসোস, বিশ্ব আমাদের ঘুর্ণিঝড়প্রবন, দরিদ্র, নদীমাতৃক দেশ হিসেবে জানে, কিন্তু পরম ফুটবলপ্রেমী জাতি হিসেবে চেনেনা।
খুব ছোটবেলায় যে খেলা দেখে বড় হয়েছি – সেটা হল ফুটবল। আশির দশকে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানে সেইরকম একটা বড় ব্যাপার ছিল। যুদ্ধাংদেহী উৎসব শুরু হয়ে যেত সেসময়। পাড়ার এক দল ছেলে যদি আবাহনীর নীল-সোনালী পতাকা নিয়ে মিছিল বের করে, তবে তার কয়েক মিনিটের মাথায় পাশের গলি থেকে মোহামেডানের সাদা-কালো পাতাকার মিছিল বের হয়ে যেত। রাস্তার এক মাথায় ছেলে পুলে হয়ত চ্যাঁচাচ্ছে, “মোহামেডান – গোবরের বাগান”। রাস্তার অন্য মাথায় ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে, “আবাহনী – গোবরের খনী”! চারদিক ছেয়ে যেত আাবাহনী-মোহামেডানের পতাকায় আর স্লোগানে। মনে পড়ে, বড় মামা এসে গল্প করত, স্টেডিয়ামে জায়গা না পেয়ে কিভাবে মোহামেডানের সমর্থক হয়েও আবাহনীর গ্যালারিতে বসে চুপচাপ খেলা দেখত। মোহামেডান গোল দিচ্ছে, অথচ মুখ দিয়ে আওয়াজ করা যাচ্ছেনা, আওয়াজ করলেই মার! সেসয়মকার একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভিতে ঘটা করে প্রচার করা হত সেসব ম্যাচ। প্রায়ই শোনা যেত, গ্যালারিতে দু’দলের সমর্থকদের সংঘর্ষ বেঁধে লোকজন হাসপাতালে!
স্বপ্ন দেখতাম, কায়সার হামিদ তাঁর ঝাকরা চুল ঝাঁকিয়ে একের পর এক গোল দিয়ে যাচ্ছে। আর তাকে পাল্লা দিয়ে মাঠে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে সালাহউদ্দিন আর আসলাম। ঐ দিকে গোলপোস্টে গোলকিপার পনির বসে বসে মাছি মারছে। কী করবে বেচারা, তার কাছে যে বলই আসেনা! বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলতে নেমে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইটালির খেলোয়াড়রা নাকানি চুবানি খাচ্ছে। চুবানি খাবেই বা না কেন? বাংলাদেশের পক্ষে যে জুয়েল রানা, মাসুদ রানা, সাব্বির, জনি, রুপু, মুন্নারা খেলছে যে!
তারপর কী যেন হল! বাংলাদেশে হঠাৎ করে ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে গেল। ফুটবলকে যেন জোর করে তাড়িয়ে দেয়া হল। ক্রিকেট হয়ে গেল “প্রায়” জাতীয় খেলা। তাই বলে কি ফুটবলকে বাংলার মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পেরেছে কেউ? পারেনি। আর পারেনি বলেই চার বছর পরপর একটা মাসের জন্য বাংলার মানুষ ফুটবল ছাড়া অন্য সব খেলাকে ভুলে যায়। এমনকি খেলাটি যদি ক্রিকেটও হয়। তার উদাহরণ হচ্ছে, গত কালকের বাংলাদেশ-ভারত ওয়ানডে ম্যাচটি। ঢাকার মাটিতে হওয়া এই ম্যাচটি নিয়ে কারও সেভাবে কোন উৎসাহ ছিলনা, বরং অনেকেই সন্ধ্যাবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছে ভোর চারটায় উঠে আর্জেন্টিনা-বসনিয়া ম্যাচটি দেখার জন্য। এ জন্যই বলেছিলাম যে – মন থেকে যে প্রেম সেটা বাংলার মানুষ আসলে ফুটবলকেই দিয়েছে, কিন্তু চারপাশে লোকজনের চাপে পড়ে ক্রিকেটকে নিয়েই সংসার করতে হচ্ছে।
কিন্তু অধিক প্রেমে বাংলার মানুষ আবার তাল-বেতাল হয়ে পড়ে। তাল-বেতালের কারণেই বাংলার আকাশে এখন নানা দেশের পতাকা উড়ছে। পৃথিবীর আর কোনও দেশ নিজ দেশের স্বাধীন আকাশে অন্য দেশের পতাকা উড়ায় বলে কখনো দেখিনি বা শুনিনি। অনলাইন জগতও বাদ যায়না। ফেসবুকে এখন না পতাকার ভীড়ে ঢোকাই যায় না। প্রোফাইল পিকচার আর কভারফটোতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানী-ইতালী-স্পেনের পতাকা শোভা পাচ্ছে। ফেসবুকে যে ছেলেটা বা মেয়েটা ষোলই ডিসেম্বর, ছাব্বিশে মার্চ বা একুশে ফেব্রুয়ারিতে নিজের প্রোফাইলপিক বা কভারফটোতে বাংলাদেশের পতাকা না দিয়ে বরং যারা দেয় তাদেরকে একদিনের এই “বাংলাদেশী ভাব” দেখানোর জন্য কটাক্ষ করে, সেই ছেলেটি বা মেয়েটি এখন যখন তার প্রোফাইল পিকে অন্য দেশের পতাকা প্রদর্শন করে, তখন মনে দুঃখ লাগে বইকি! কই, ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়তো বাংলার আকাশ বাংলাদেশের পতাকায় ছেয়ে যায়না। তবে কেন অন্য দেশের পতাকায় আমাদের আকাশ ছেয়ে যাবে? অনেকে অবশ্য বিশাল বড় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা পতাকার মাথায় বাংলাদেশের মাইক্রোস্কোপিক একটা পতাকা টানিয়ে রাখে। অনেকটা দেশের জন্য দায়সারার মত। ব্যাপারটা আর কারও কাছে খারাপ লাগে কীনা জানিনা, কিন্তু আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। তাই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ না খেলায় প্রিয় দল হিসেবে ব্রাজিলকে সাপোর্ট দিলেও, সেটাকে কখনোই ব্রাজিলের পতাকা উড়াবার মত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে যাইনা। কখনও সেই পর্যায়ে যাবার সাধও হয়না। জানিনা, কবে লোকজনের এই তাল-বেতাল অবস্থা বন্ধ হবে! সম্ভবত যখন বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে তখন হয়তো বা বন্ধ হবে। ব্রাজেন্টিনাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে ভাববার সময় বুঝি এবার চলেই এসেছে।
বাংলার জনগন আসলে ফুটবলকেই প্রথম ভালবেসেছিল, কিন্তু পরে পারিবারিক চাপে পড়ে ক্রিকেটকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। …. 🙂 ব্যাপক হইছে … Best Web Design & Development Of Bangladesh.