১।
তোমরা হয়তো ইঞ্জিনিয়ার সগির উদ্দিনকে চিনবেনা। এই মানুষটাকে না চেনাটা দোষের কিছু না, সত্যি বলতে কী – ওনাকে অনেকেই চিনেনা। আমিও চিনতামনা। আমি যে খুব বেশি মানুষকে চিনি তা অবশ্য না। অনেক সময় নিজের আত্মীয় স্বজনদেরই ঠিকঠাক মত চিনতে পারিনা। তাই কোন বিয়ে বা মুসলমানী টাইপের দাওয়াতে যখন সব আত্মীয়রা এক হয়, তখন আমাকে অপদস্থ করার জন্য তারা এক নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠে। চারপাশে সবাই আমাকে কীভাবে কীভাবে যেন ঘিরে ধরে ফেলে, যেন আমি কেটে পড়তে না পারি। তারপর একজন একজন করে আমার কাছে আসে, আর জিজ্ঞেস করে – “আমাকে চেনো? বলতো আমি কে?”। তখন আমি তাকে প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে থাকি, এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি সেই কাজটা ঠিক করে করতে পারিনা। তখনই চারদিকে একটা হাসির রোল উঠে। সবাই মাথা নেড়ে একটাই কথা বলতে থাকে – “বলেছিলাম না পারবেনা!”
যাই হোক, আমার কথা বাদ। আমি বরং ইঞ্জিনিয়ার সগির উদ্দিনকে নিয়ে কথা বলি। সগিরউদ্দিনের সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার ব্যাপারটা মোটেও সাদামাটা ছিলনা। ভাইয়া-ভাবীকে নিয়ে ঢাকায় থাকার মত একটা বাসা খুঁজছিলাম। ভাইয়া চট্টগ্রামে চাকরি করত। তার ঢাকায় বদলি হয়ে যায়। তাই সবাইকে নিয়ে ঢাকায় থাকার মত বাসা খোঁজার জন্য আমাকেই ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হল। আমি অবশ্য বেকার মানুষ, ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে আছি। এই সময়ে ঢাকায় বাসা খুঁজতে যাবার আইডিয়াটা মন্দ লাগেনি। ঢাকায় এসে এক বন্ধুর বাসায় উঠলাম। প্রতিদিন সকাল বেলা নাস্তা খেয়ে রুটিন করে বিভিন্ন এলাকায় বাসা খুঁজতে বের হই। বাসা খুঁজতে গিয় টের পেলাম যে, মন মত বাসা পাওয়া বেশ ঝক্কির ব্যাপার। ঢাকার বাসাগুলো সব ছোট ছোট খুপরির মত। কোন বাসাই পছন্দ হয়না। আর যদি বাসা পছন্দ হয়ও, বাসা ভাড়ার দাম পছন্দ হয়না। আবার সব পছন্দ হলে বাড়িওয়ালা পছন্দ হয়না। মহা ঝামেলার ব্যাপার!
মহা ঝামেলার এই ব্যাপার মাথায় নিয়ে, একদিন লালমাটিয়া এলাকায় বাসা খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে বিকাল বেলায় লালমাটিয়ার মাঠে হাত পা ছড়িয়ে বসে ছিলাম। যখন মন উদাস উদাস লাগে তখন এই কাজটা আমি প্রায়ই করি। বসে থাকলে কেন জানি মন উদাস ভাবটা চলে যায়। মাঠে বসে বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলা দেখছি। দেখতে যে খুব ভাল লাগছিল তা না, বরং বেশ ভয় ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি বল আমার মাথায় পড়ল। এ জন্য সারাক্ষণ বলের দিকে চোখ রেখে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন হাবিজাবি চিন্তা করছিলাম। এমন সময় হুড়মুড় করে কী যেন একটা আমার উপর পড়ে গেল! শুধু পড়েই ক্ষান্ত হয়নি, আমাকে ভিজিয়েও দিল। হঠাৎ এরকম আচমকা আক্রমনে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। মনে হল সারা শরীরে আঠাল কিছু একটার স্রোত বয়ে গেছে। বুদ্ধি ফেরত আসতেই চারদিকে তাকিয়ে দেখি বাচ্চা ছেলেপিলেরা আমার দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে হাসছে। বাচ্চারা খুব নিষ্ঠুর হয়। আমি আঠালো পদার্থে মাখামাখি হয়ে আছি, আর এরা সেটা নিয়ে হাসাহাসি করছে! কী পাষন্ড! এর মধ্যে আঠালো পদার্থটার কিছু অংশ বেয়ে বেয়ে মুখে গেল। বাহ, বেশ মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। আমি একটু চেটে পুটে খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি।
এমন সময় কে যেন বলে উঠল – “ধূর! দিলেন তো কোকালপাইজুর কন্ট্রোলারটা নষ্ট করে! এখন এটাকে বাড়ি নিয়ে যাব কিভাবে?”
তাকিয়ে দেখি উস্কোখুস্কো কাঁচাপাকা চুলের এক লোক আমার ছড়িয়ে বসা দু’পায়ের উপর চিৎপটাং হয়ে পড়ে থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে এই কথা বলছেন। লোকটার চোখে চিকন ফ্রেমের একটা চশমা, আর সারা মুখে হালকা হালকা দাড়ি রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কয়েকদিন ধরে ইচ্ছে করে দাড়ি কাটেনি। পায়ের উপর একটা পূর্ণবয়স্ক লোক চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকলে কী করতে হয়, তা নিয়ে আমার কোন ধারণা নেই। তাই কী করব বুঝতে পারছিলাম না। লোকটা দেখলাম এরই মধ্যে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। তার এক হাতে আবার একটা মোবাইল ফোনের মত কী যেন একটা যন্ত্র। সেটা উঁচিয়ে মনে হল আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবারও ঝগড়া করতে চাচ্ছেন। অভিজ্ঞতা বলে, এরকম ঝগড়াঝাঁটিতে যে বেশি জোরে হইচই করতে পারে, সে-ই বেশি ফায়দা তুলতে পারে। ঝগড়া ঝাঁটির সেই সূত্র মেনে আমিও সমান তালে চেঁচিয়ে বললাম – “আপনার কোক আর পিয়াজু নষ্ট হয়েছে দেখে এভাবে চেঁচাচ্ছেন আর আমার উপর কিসব আঠা ফেলে যে পুরো জামাকাপড় নষ্ট করে ফেললেন! তার কী হবে?”
লোকটা মনে হল থতমত খেয়ে গেল। বলল – “কোক আর পিয়াজুর কথা কখন বললাম?”
“আপনিই তো বললেন – কোক আর পিয়াজুর কন্ট্রাক্ট নষ্ট হয়ে গেছে।”
“ওহ! ওটা কোকালপাইজুর কন্ট্রোলার।” এই বলে আমার দিকে মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। মনে হল ঐ মোবাইল ফোন টাইপের জিনিসটার কথাই বলছে। কিন্তু মোবাইল ফোন থেকে তরল বের হয় আমি জানতামনা। তাই আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – “এটা থেকেই আঠা-আঠা জিনিস বের হয়েছে? আর আমার জামা কাপড় নষ্ট করেছে?”
দেখলাম ভদ্রলোক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। আমার জামা কাপড়ের আঠাল জিনিসটা দেখে মিন মিন করে বললেন – “ওটা আসলে আইসক্রিম।”
“ফাজলামি করেন? আইসক্রিম এইরকম পানি পানি হয়? আইসক্রিম ঠান্ডা আর শক্ত মতন হয়।” – আমার ঝাঁঝ তখনও কমেনি।
“ওটা আসলে ঘন্টাখানেক আগে আইসক্রিম ছিল। এখন বলতে পারেন ওয়াটারক্রিম হয়ে গেছে।” এই বলে লোকটা আশপাশে তাকাতে লাগল। তারপর কাছে ধারে পড়ে থাকা একটা বাক্স কুড়িয়ে এনে আমার দিকে এগিয়ে দিল। এক ঝলক দেখেই বুঝলাম যে বাক্সটা আইসক্রিমের বাক্স। আমি সন্দেহের চোখে লোকটার দিকে তাকালাম। লোকটা বোঝানো শুরু করল – “এক বাক্স আইসক্রিম কিনেছিলাম খাবার জন্য। কিন্তু কোকালপাইজুকে কন্ট্রোল করতে গিয়ে খাবার কথা ভুলে গেছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে কোকালপাইজুকে কন্ট্রোল করতে করতে হাঁটছিলাম। এদিকে আইসক্রিম গলে পানি হয়ে গেল। তারপর আপনি এসে আমাকে ফেলে দিলেন…”
“আমি আপনাকে ফেলে দিলাম মানে? আপনিই তো এসে হুড়মুড় করে আমার উপর পড়লেন!”
লোকটা মনে হল কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তারপর বেশ জোর গলায় বলল – “আপনি মাঠের উপর বসে থাকবেন কেন? মাঠ কি বসার জায়গা? মাঠে লোকজন খেলাধূলা করে। বসার জায়গা হচ্ছে চেয়ার সোফা কিংবা মাঠের পাশের গ্যালারি। নিতান্তই বসতে হলে পার্কে গিয়ে বসেন, মাঠে বসবেন কেন?”
অকাট্য যুক্তি। এর জবাব আমার কাছে নেই। আসলেই তো, মাঠ হচ্ছে খেলার জায়গা। আমি বসে বোধহয় বেশ অন্যায় করে ফেলেছি। লোকটা যাতে বুঝতে না পারে যে আমি অন্যায় করে ফেলেছি সেজন্য কথা ঘোরাবার জন্য বললাম – “আপনার কোক-পিয়াজু না কী যেন বললেন, সেটা কী জিনিস?”
লোকটা মনে হয় বেশ বিরক্ত হল আমার কথায়। ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – “আপনাকে কেন বলব? আপনি কে?”
আমি ভালো মানুষের মত মুখ করে বললাম – “আমি আদনান। চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। ঢাকায় থাকার জন্য একটা বাড়ি খুঁজছি।”
এমন সময় ঠিক আমাদের সামনে কী যেন একটা আকাশ থেকে হুড়মুড় করে মাঠের উপর পড়ল। মাঝ আকাশ থেকে বৃষ্টির পানি আর পাখির টয়লেট ছাড়া অন্য কিছু পড়লে আমার খুব অবাক হবার কথা ছিল, কিন্তু কেন যেন তেমন একটা অবাক হলাম না। বরং আমি খুব উৎসুক হয়ে জিনিসটাকে আরও কাছ থেকে দেখতে গেলাম। জিনিসটা দেখে আমার কাছে যন্ত্র বলেই মনে হল, সেটা থেকে বিভিন্ন তার বেড়িয়ে রয়েছে। যন্ত্রটার মধ্যে আবার ফ্যানের মত পাখাও লাগানো রয়েছে। লোকটা একবার আমাকে দেখলো, আরেকবার মাঠের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া যন্ত্রটার দিকে তাকালো। তারপর উপুর হয়ে বসে মাঠে পড়ে থাকা যন্ত্রটার বিভিন্ন অংশ বিশেষ গোছাতে শুরু করল। দেখে বুঝলাম যে এটাই আসলে সেই কোকপিয়াজু। তবে মনে হল লোকটা আমার শেষ কথাগুলো শুনতেই পায়নি। তাই আরেকটু জোরে গলায় বললাম – “আমি আদনান। আমি ঢাকায় এসেছি বাড়ি খুঁজতে”। লোকটা আমার দিকে বেশ বিরক্তভাবে তাকিয়ে বলল – “একবার তো শুনলাম, আবার বলছেন কেন?”
অদ্ভুত তো! লোকটার কোন ভদ্রতা জ্ঞান নাই নাকি? বললাম – “ইয়ে আপনার পরিচয় তো জানা হল না।”
লোকটা ততক্ষণে সবকিছু গুছিয়ে একটা ব্যাকপ্যাকের মধ্যে ভাঙ্গা যন্ত্রপাতির সব কিছু ভরে ফেলেছে। আমাকে পাত্তা না দিয়ে ব্যাগের মুখ আটকাচ্ছানে। আমি আবারও বললাম – “এটাই কি আপনার কোক-পিয়াজু?”
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “আপনি ইকবাল রোডের দিকে বাসা খুঁজতে পারেন। ঐখানে বেশ কয়েকটা বাসায় ভাড়ার নোটিশ ঝুলছে।” বাহ! কী কথার কী জবাব! জিজ্ঞেস করলাম কোক-পিয়াজুর কথা, আর উনি বলছেন বাসা ভাড়া কই পাওয়া যায় সেই কথা। রেগে মেগে কিছু একটা বলতে গিয়ে খেয়াল করলাম, লোকটা তো আসলেই ভাল কথা বলেছে। আমি ইকবাল রোডের দিকে কখনও বাড়ি খোঁজাখুঁজি করিনি। লালমাটিয়ার এই দিকটাতে কেন যে যাওয়া হয়নি, তাই-ই চিন্তা করছিলাম।
সবকিছু ব্যাগের মধ্যে ভরে লোকটা গুটিগুটি পায়ে আমার কাছে এল। ইতস্তত করে বলল – “আমার নাম সগিরউদ্দিন”। এতটুকু বলে লোকটা উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটা শুরু করল।
২।
সগিরউদ্দিন নামের লোকটার সাথে যে আবারও দেখা হবে সেটা কখনোই চিন্তা করিনি। লোকটার কথা মত দু’দিন পর আমি ইকবাল রোডে গেলাম বাড়ি খুঁজতে। দেখলাম সত্যি সত্যি বেশ কয়েকটা বাড়ির সামনে “বাড়ি ভাড়া হইবে” ধরণের নোটিশ ঝুলছে। মানুষ কেন যে সাধু ভাষায় নোটিশ লেখে – আমি বুঝিনা। সাধু ভাষায় কোন লেখা দেখলেই স্কুলের বাংলা স্যারের রাগী-রাগী চেহারার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে। সাধু আর চলিত ভাষা মিলিয়ে কিছু লিখলেই স্যার বেদম পিটাতেন!
যাই হোক, ইকবাল রোডে আমার কাজ ভাড়ার জন্য বাসা দেখা। আমি নিবিষ্ট মনে কাজে যোগদান করলাম। বাসাগুলোতে গিয়ে বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে ভাড়ার দাম শুনে চোখ কপালে উঠে গেল। অ্যাত্ত দাম! একেকটা বাসায় যাই, আর ভাড়ার দাম শুনে মান সম্মান নিয়ে কেটে পড়ি। এভাবে দামের জন্য ইকবাল রোডে বাসা ভাড়া নেবার চিন্তা যখন একেবারেই বাদ দেব ভাবছি, এমন সময় একটা দোতলা বাসার গেটের উপর “বাড়ি ভাড়া হইবে” নোটিশটা চোখে পড়ল। নোটিশটা কাঁচা হাতের লেখা, মনে হচ্ছে ছোট কোন বাচ্চাকে দিয়ে কাগজে লিখিয়ে গেটের সামনে টানিয়ে দেয়া হয়েছে। বাসাটাকে অবশ্য আড়াই তলাও বলা যেতে পারে, কারণ ছাদে কিছু ছোট ছোট ঘরও দেখা যাচ্ছে। তবে দূর থেকে বাসাটা দেখে বেশ ভাল লেগে গেল। বাসাটার সামনে একটু খোলা জায়গা রয়েছে। বাসার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি, গাছের ছায়ায় এক মাঝবয়সী টেকো লোক আারামে চোখ বুজে চেয়ারে বসে ঢুলছে। লোকটার টাকে একটা মাছি বসে আছে, অথচ তা নিয়ে তার কোন ভ্রুক্ষেপ রয়েছে বলে মনে হলনা। লোকটা সমানে চোখ বুজে ঢুলছে। খুব খেয়াল করলে নাক দিয়ে হালকা নাক ডাকার একটা শব্দও শোনা যাচ্ছে। এই অবস্থায় মনে হয় কাউকে বিরক্ত করা ঠিক না। একবার স্কুলে অংক স্যার আমাদের অংক করতে দিয়ে চেয়ারে বসে ঢুলছিলেন। ঢুলতে ঢুলতে তাঁর নাক দিয়েও হালকা শিষের মত শব্দ বেরোচ্ছিল। ক্লাসে সবাই অংক না করে কলম-ফাইট খেলছিল। আর আমি অংক করে খাতা জমা দেবার জন্য স্যারের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে স্যারকে ডাক দিলাম। অমনি স্যার ধড়মড় করে উঠে বসলেন। লাল লাল চোখে আমাকে কিছুক্ষণ দেখে স্যার বুঝতে পারলেন যে তাঁর এই উপাদেয় ঢুলুনির ব্যাঘাত আমিই ঘটিয়েছি। তারপর পকেট থেকে বেত বের করে সে কী মার দিলেন! এরপর থেকে কেউ ঢুললে তাকে আমি পারতপক্ষে বিরক্ত করিনা।
গাছের ছায়ায় ঢুলন্ত সেই লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিলাম যে কীভাবে এই লোকের সাথে কথা বলা যায়। এরই মধ্যে দেখি লোকটা চোখ মেলে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রয়েছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমিও তার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। কী বলব কিছু বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ লোকটা বলে উঠল – “মজা নেন? আমার সাথে মজা নেন?”
আমি আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কী বলে লোকটা! আমি তার থেকে মজা নেব কিভাবে? উনি মজা বিলিয়ে যাচ্ছিলেন নাকি? লোকটা দেখি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার টার দেবে কীনা চিন্তা করছি। মারধোর শুরু করলে কোন দিক দিয়ে পালাব সেটা দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। লোকটা আরও জোরে বলে উঠল – “আমার কথা কানে লন না ক্যান? কান কি আটকায়া রাখসেন? দুইটা থাবড়া দিয়া কি কান খুইল্ল্যা দিমু?”
থাবড়াথাবড়ির কথায় আমি বেশ আঁতকে উঠলাম। ভয়ার্ত আর দুর্বল গলায় বললাম – “দেখুন, আপনি এখানে ঢুলছিলেন। ঢোলাঢুলি নিশ্চয়ই মজার কোন ব্যাপার না। তাছাড়া আপনি কাউকে মজা দিচ্ছিলেনও না। তাহলে কিভাবে আমি আপনার কাছ থেকে মজা নিব? আসলে আমি এসেছিলাম এই বাড়ির ভাড়া …”
লোকটা আমার কথা শেষে করতে দিলনা, হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিল। তারপর পিচিক করে মাটিতে একদলা থুতু ফেলে তার টেকো মাথায় হাত বুলাল। তারপর হাতটা আমার সামনে এনে ধরল। দেখলাম লোকটার হাতের মধ্যে টুথপেস্টের মত সাদা কিছু একটা লেগে রয়েছে। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝতে না পেরে আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা টুথপেস্ট মাখানো হাতটা আমার দিকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল – “এইডা কি করলেন? ভাবসেন কিসুই টের পাইনা? আমি হইলাম আক্কাস দারোয়ান। ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া আমি চোর ধইরা ফেলি, আর আপনে তো নাদান শিশু। আমার লগে মজা নেন? আমার মাথায় ছ্যাপ ফেলেন! কত্ত বড় সাহস …”
“ছ্যাপ? ছ্যাপ কি?” – আমি অবাক।
“ছ্যাপ চিনেননা? মস্করা করেন?”। তারপর লোকটা একদলা থুতু মাটিতে ফেলে মুখ খিঁচিয়ে বলল – “এইডা হইল গিয়া ছ্যাপ!”
এইবার বুঝতে পারলাম – লোকটা ভেবেছে সাদা আঠালো এই পদার্থটা আমার থুতু। আমি যথা সম্ভব শান্তভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম – “দেখুন ভাই ওটা আমি করিনি। আর আমি আপনার টাকে … সরি … মাথায় থুতু ফেলবই বা কেন?”
“তাইলে এইটা কোত্থাইক্যা পড়ল? আসমান ফাইড়্যা?”
অকাট্য যুক্তি! আমি ছাড়া আক্কাস দারোয়ানের সামনে কেউ নেই, আর আক্কাস দারোয়ানের মাথায় আঠাল পদার্থ। আমি ছাড়া আর কারও দিকে সন্দেহ যাবার কথা না। সন্দেহ কাটাবার জন্য মিনমিন করে বললাম – “আমার মনে হয় জিনিসটা থুতু না।”
“তাইলে কি? মুতু?”
লোকটা তো মহা বিটকেলে। যে জিনিস টয়লেটে সারতে হয়, সেটা আমি কেন শখ করে উনার মাথায় করতে যাব? লোকটা তখনও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছে। হাতে লেগে থাকা জিনিসটা ভাল করে দেখার জন্য আমি মাথা এগিয়ে দেখতে গেলাম। সাথে সাথে নাকে বিদঘুটে একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। গন্ধটা নাকে ঢুকে মাথাটা যেন পরিস্কার হয়ে গেল। হঠাৎ করেই বুঝে ফেললাম যে জিনিসটা কি। কেস সল্ভ করার পর শার্লক হোমস টাইপের একটা হাসি দিয়ে লোকটাকে বললাম – “ওটা আসলে পাখির টয়লেট। আপনি যখন গাছের ছায়ায় ঢুলছিলেন, তখন নিশ্চয়ই গাছের উপর থেকে কোন পাখি আপনার মাথায় টয়লেট করে দিয়েছে।”
লোকটা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। আমি আবারও তাকে বললাম – “আপনি গন্ধটা শুঁকে দেখেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন ঘটনাটা কি। মানুষের থুতুতে নিশ্চয়ই এত তীব্র গন্ধ থাকবেনা। কী বলেন?”
লোকটা গন্ধটা শুঁকে আরও বিভ্রান্ত হয়ে গেল। একবার আমার দিকে আরেকবার হাতে মাখানো সাদা পদার্থের দিকে তাকাতে লাগল। এরপর টানা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সে ব্যাপারটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা। অনেকক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর, কিছু একটা বলার জন্য লোকটা মুখ খুলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ভেতর থেকে কেউ একজন তাকে ডেকে উঠল – “আক্কাস মিয়া! কই আছ? জলদি আস। আমার সল্ডার গানটা কোথায় রেখেছ? আর্মেচারের ওয়াইন্ডিংটা আবার সল্ডার করতে হবে।”
ডাক শুনে আক্কাস মিয়া দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। ডাক শুনে আমিও ভড়কে গেলাম। কারণ শেষের কথাগুলোর কিছুই আমি ঠিকমত বুঝতে পারিনি। আক্কাস মিয়া চলে যাওয়ায়, বাড়ি ভাড়া নিয়ে কথা বলার আর কেউ রইল না। ভাবলাম বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই ভেতরে রয়েছেন, তার সাথেই বরং কথা বলে দেখি।
বাগান পেরিয়ে বাড়ির ভেতর গিয়ে দেখি দোতলা যাবার সিঁড়ির গোড়ায় এক লোক উপুড় হয়ে বসে বিদঘুটে একটা যন্ত্র নিয়ে কাজ করছে। আমার পায়ের আওয়াজে লোকটা পেছন ফিরে তাকালো। আগেই বলেছি, সাধারণত আমি লোকজনকে চিনতে পারিনা। কিন্তু আজকে মহা আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল। চিকন ফ্রেমের চশমা পড়া কাঁচাপাকা চুলের এই লোকটাকে হঠাৎ করেই চিনে ফেললাম। এ তো সেই লোক! সেদিন লালমাটিয়া মাঠে যে আমার উপর আইসক্রিম ফেলে দিয়েছিল! সেদিন অবশ্য লোকটার মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি ছিল, কিন্তু আজকে পুরো দাড়ি কামানো – একেবারে ক্লিন শেভড। লোকটার নাম মনে করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকি। কিন্তু কোনভাবেই লোকটা নাম মনে আসছেনা। নামটা পেটে আসছে তো মুখে আসছেনা। কিন্তু লোকটার সাথে তো কিছু বলা দরকার, নাহলে খুবই অভদ্রতা দেখায়।
আমি শুকনো একটা হাসি হেসে বললাম – “কেমন আছেন? আমি আদনান। চিনেছেন আমাকে?” মনে মনে আশা ছিল লোকটা এর জবাবে তার নাম আমাকে জানাবেন।
কিন্তু আমার কথায় লোকটা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর বেশ বিরক্ত হয়ে বলল – “দুদিন আগেই তো আপনাকে দেখলাম। আমার কোকালপাইজুর কন্ট্রোলারটা নষ্ট করেছিলেন আটচল্লিশ ঘন্টাও তো হয়নি। এত তাড়াতাড়ি আপনাকে ভুলি কিভাবে? আমি কি গোল্ডফিশ নাকি?”
গোল্ডফিশের নিশ্চয়ই স্মৃতি বিষয়ক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু আমি আর সে ব্যাপারটা টেনে আনলাম না। হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকলাম লোকটার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আজকের দিনের দ্বিতীয় আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটল। আমি লোকটার নামটাও মনে করে ফেললাম! এই লোকটার নাম সগিরউদ্দিন! নামটা মনে করতে পেরে নিজের মধ্যে একধরণের উৎফুল্লভাব জেগে উঠল। কিন্তু সগিরউদ্দিন সেই উৎফুল্লভাব দেখলেন বলে মনে হলনা, বরং তাকে বেশ বিরক্তই মনে হল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমাকে বললেন – “বাড়িতে ঢুকে এসে ঘুমন্ত দারোয়ানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন কেন? ঘুমন্ত মানুষ কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবার জিনিস?”
আমি বেশ অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম – “আমি যে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা আপনি কিভাবে জানলেন?”
ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আমার বাসার চারপাশে সিসি ক্যামেরা আছে। তার একটাতে দেখলাম আপনি সন্দেহজনকভাবে ঘুমন্ত দারোয়ানের দিকে একভাবে তাকিয়ে আছেন … ”
এই সেরেছে! আমাকে আবার চোর-ছ্যাচড় হিসেবে সন্দেহ করেনি তো? তাড়াতাড়ি ভুল ভাঙ্গাবার জন্য বললাম – “ওহ … গেট দিয়ে ঢুকে দেখি কেউ নেই, শুধু একজন গাছের ছায়ায় ঢুলছে। বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারে …”
আমার কথা শেষ হবার আগেই বাড়ির ভেতর থেকে দারোয়ান আক্কাস মিয়ার গলা শোনা গেল। কোন কারণে সে উত্তেজিত হয়ে সগিরউদ্দিনকে ডাকছে। সেই ডাক শুনে, সগিরউদ্দিন আমার বাকি কথা ফেলে রেখে বাড়ির দিকে জোরে জোরে হাঁটা শুরু করে দিল। সগিরউদ্দিনের সাথে আমার কথা শেষ হয়নি। তাই আমিও তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। একতলার বারান্দার কাছে যেতেই দেখলাম আক্কাস মিয়া খুবই উত্তেজিতভাবে কিছু একটা বলছে। মনে হল কোন কিছুতে সে ঘাবড়ে গেছে। আক্কাস মিয়া ঘাবড়ে গিয়ে উত্তেজনার চোটে কী বলছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে সগিরউদ্দিন মনে হয় বুঝতে পারলেন। কারণ দেখলাম তার নিজের চেহারাও উদ্বেগে পাল্টে গেছে। সব কিছু শুনে সগিরউদ্দিন বাড়ির ভেতরে গেলেন। তার পেছন পেছন আক্কাস মিয়াও ভেতরে গেল। আমি কি করব বুঝতে না পেরে পেছন পেছন আমিও ঢুকে পড়লাম।
বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চোখ কপালে উঠে গেল। সারা ঘর ছোট বড় নানা রকমের যন্ত্রপাতিতে ঠাসা! যে রুমে ঢুকলাম মনে হল তা ড্রয়িং রুম। সাধারণ মানুষের বাসা-বাড়িতে যেখানে সোফা আর টেবিল থাকে, সেখানে সগিরউদ্দিনের ড্রয়িংরুমে বসার জন্য রয়েছে গাড়ির কয়েকটি সিট আর টেবিলের জায়গায় রয়েছে অদ্ভুত একটা জিনিস, যার উপরের অংশটা সমতল কিন্তু চারপাশ দিয়ে বিভিন্ন তার বেরিয়ে আছে। জিনিসটাকে টেবিলের চেয়ে যন্ত্রপাতি বলেই বেশি মনে হয়। যন্ত্রের মত টেবিলটার ঠিক পাশেই পুরো দেয়াল জুড়ে বিশাল একটা বইয়ের শেল্ফ রয়েছে। পুরো শেল্ফটিতে অসংখ্য বইয়ের পাশাপাশি অসংখ্য যন্ত্রপাতিও রয়েছে। একটু উঁকি দিয়ে কয়েকটি বইয়ের নাম দেখলাম। বইগুলোর খটমটে যান্ত্রিক নাম দেখে প্রথমবারের মত বুঝলাম যে সগিরউদ্দিনের চারপাশে এত যন্ত্রপাতি থাকার আসল কারণ। বই থেকে সগিরউদ্দিনের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম উনি ড্রয়িংরুম পার হয়ে ভেতরের আরেকটি রুমে চলে যাচ্ছেন। পেছন থেকে আমি সগিরউদ্দিনকে ডেকে বললাম, “আপনি বুঝি ইঞ্জিনিয়ার?”
সগিরউদ্দিন ভয়াবহভাবে চমকে উঠলেন, মনে হল যেন আমার গলা না, কোন ভূতের গলা শুনেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, “আপনি এখানে কেন? আপনি এখনও যাননি?”
“বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারে তো কথা বলা হয়নি তাই …” – আমি বলার চেষ্টা করলাম।
“কার বাড়ি ভাড়া? কোন বাড়ি?” – বাড়ি ভাড়ার কথা শুনে সগিরউদ্দিন যেন অবাক হলেন বেশ।
“এই বাড়ি। ঐ যে, গেটের সামনে বড় করে লেখা ছিল – বাড়ি ভাড়া হইবে…”
সগিরউদ্দিন প্রথমে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর যেন হঠাৎ করে সব বুঝতে পারলেন – “ওহ! ওটা কোন দুষ্ট ছেলেপেলের কাজ। আমার বাসার সামনে বাড়ি ভাড়ার নোটিশ টানিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু আপনি সেটা বুঝলেন না কেন?”
এতক্ষণে বুঝলাম বাড়ি ভাড়ার নোটিশটা কেন বাচ্চাদের কাঁচা হাতের লেখা মনে হয়েছিল। ওটা আসলেই কোন বাচ্চার হাতের লেখা ছিল। তবে সগিরউদ্দিনের শেষ কথাটায় আমি বেশ অবাক হলাম – “কী বুঝলামনা?”
“এই যে, নোটিশটা আমি লিখিনাই” – সগিরউদ্দিন বললেন।
আমি আরও অবাক – “আমি কিভাবে বুঝব যে কোনটা আপনার লেখা আর কোনটা দুষ্ট ছেলেপেলেদের লেখা?”
“আমি কি কোন নোটিশ সাধু ভাষা আর চলিত ভাষা মিশিয়ে লিখব নাকি? আমাকে দেখলে কি স্কুলের গাধা ছাত্র মনে হয়?”
আমি জোরে জোরে মাথা ডানে-বামে নাড়ালাম, কাঁচাপাকা চুলের সগিরউদ্দিনকে দেখলে মোটেও স্কুলের গাধা ছাত্র মনে হয়না। কিন্তু আমার এখন এসব শোনার সময় নেই। আমার বাড়ি ভাড়া নেয়া দরকার। আমি আবারও বললাম, “কিন্তু আমি ভেবেছিলাম যে আপনার বাড়িটা ভাড়া হবে…”
কিন্তু সগিরউদ্দিনের বাড়ি ভাড়া নিয়ে কথা বলার কোনই আগ্রহ নেই। আমাকে বলল – “ওটা তো দুষ্ট ছেলেপেলেদের কাজ। কিন্তু আমার বাড়ি ভাড়া দেবার মোটেও ইচ্ছা নেই। আপনি বরং চলে যান।”
কী অদ্ভুত! মুখের উপর আমাকে চলে যেতে বলছে! এ কেমন লোক? অন্য কোন সময় হলে আমিও মুখ ঝামটা দিয়ে চলে আসতাম। কিন্তু বাড়িটা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল, তাই সহজে আসতে পারছিলাম না। আমি গলায় মধু ঢেলে তাকে বললাম – “আপনার তো আড়াইতলা বাড়ি। একটা তলা ভাড়া দিলে মাসে মাসে কিছু টাকা উঠে আসত…”
“আপনার কি মনে হয় আমি টাকার কাঙ্গাল?” – সগিরউদ্দিন ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন।
আমি মিন মিন করা শুরু করলাম – “না… মানে… ইয়ে…”
এমন সময় ভেতরের কোন একটা রুম থেকে বেশ বড়সর বিকট একটা শব্দ হল। শব্দটা শুনে মনে হল কেউ একজন ভেতরের রুমে ঢেঁকুর তুলল। তবে ঢেঁকুরের আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে যে সেটা মানুষ না হয়ে কোন দৈত্যের ঢেঁকুর হবে। সগিরউদ্দিন সেই ঢেঁকুরের শব্দে ঘাবড়ে গেলেন। ভেতর থেকে আক্কাস মিয়া আবার উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি শুরু করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এল। সগিরউদ্দিন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – “আপনি এখন চলে যান, আমি বাড়ি ভাড়া দেবনা। আর বেশিক্ষণ থাকলে বিপদ হতে পারে।”
আমি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তাতে আমার ফোন নাম্বার লিখে সগিরউদ্দিনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম – “তারপরও যদি মত পাল্টান তাহলে আমাকে একটা ফোন দিয়ে…”
সগিরউদ্দিন যেন আমাকে বের করে দিতে পারলেই বাঁচেন। আমার কোন কথাই শুনছেননা। আমার দেয়া কাগজটাকে পকেটে পুরে আবরও বললেন – “আপনি চলে যান তো, বিপদ হবে।”
কী চাঁছাছোলা ব্যবহার লোকটার! বাসায় আসলাম কিছু তো খেতে বললই না, বরং এখন বেরিয়ে যেতে বলছে। ওর বিপদের গুষ্ঠি কিলাই! আমি আর কিছু না বলে হন হন করে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
৩।
এখনও বাড়ি ভাড়া করতে পারিনি শুনে সেদিন রাতে ভাইয়া ফোনে কিছুক্ষণ ঝাড়ি দিল। অবশ্য ভাইয়ারইবা দোষ কী! ভাইয়ারও ঢাকায় বদলি হবার সময় ঘনিয়ে আসছে, আর এদিকে আমি এখনও একটা বাসা ঠিক করতে পারিনি। সারা রাত চিন্তাভাবনা করে দেখলাম যে সগিরউদ্দিনের বাসাটাই আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটাই – সগিরউদ্দিনের বাসাটা ভাড়ার জন্য না। দেখে তো মনে হয়েছিল লোকটা একা একাই থাকে, বাসা ভাড়া দিলে বরং তার লাভই হত। সময়ও বেশি নাই যে অন্য বাসা দেখব। আরও খানিক্ষণ চিন্তা করে ঠিক করলাম যে সকালে আবার যাব সগিরউদ্দিনের কাছে। দেখি কোন ভাবে পটিয়ে পাটিয়ে বাসা ভাড়া নেয়া যায় কীনা!
৪।
সকালবেলা আবার গেলাম সগিরউদ্দিনের ইকবাল রোডের বাসায়। বাসার সামনের গেট মনে হল ভেতর থেকে বন্ধ। কয়েকবার আক্কাস মিয়ার নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু কোন জবাব পেলাম না। কী করা যায় ভাবছি! এমন সময় দেখি গেটের পাশে ঝোপের মধ্যে একটা মই পড়ে আছে। যে করেই হোক বাড়ির ভেতর ঢুকতে হবে, বাসা ভাড়ার কথা বলার জন্য। তাই সামনেপিছে বেশি চিন্তা না করে মইটাকে গেটের সাথে লাগিয়ে মই বেয়ে উঠে গেটের ঐ পাশে চলে গেলাম। মই থেকে মাটিতে পা রেখে, ঐ পাশ থেকে মইটাকে গেটের উপর দিয়ে এই পাশে টেনে আনলাম। বাড়ির ভেতর সবকিছু কেমন যেন শুনশান মনে হচ্ছে। আগের দিন গাছের ছায়ায় বসে থাকা আক্কাস মিয়াকে দেখলাম না। সবাই ঘুম নাকি! আমি যদি এই সময়ে গিয়ে বাড়ির কলিংবেল চাপি তাহলে কি সগিরউদ্দিন মাইন্ড করবেন। এইসব চিন্তা করতে করতে বাগানের মধ্যে দিয়ে আমি ধীরে ধীরে সগিরউদ্দিনের আড়াইতলা বাড়ির দিকে এগুতে থাকি। হঠাৎ শুনলাম বিকট স্বর করে কেউ একটা ঢেঁকুর তুলল।
অ্যাত্ত জোরে শব্দটা হল যে আমি চমকে উঠলাম। মনে হল আমার আশপাশেই শব্দটা হল। শব্দটা কোত্থেকে এসেছে তা দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির পাশের পেয়ারা গাছটার দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। পেয়ারা গাছটার নিচে ছায়ার মধ্যে একটা জ্বলজ্যান্ত হাই-কমোড আমার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে আছে। ‘চোখ’ বলছি, কারণ কমোডটার দু’পাশে চোখের মত দুটো চকচকে গোল জিনিসকে দেখে আমার ঠিক চোখ বলেইই মনে হল, যেমনটা থাকে গাড়ির হেডলাইট। অবশ্য পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা জিনিসটাকে প্রথম দেখায় কেউ কমোড হিসেবে চিনতে পারবেনা। কমোডটার পুরো শরীর থেকে বিবিন্ন যন্ত্রপাতি আর তার বেরিয়ে আছে। আমাকে দেখে কমোডটা ঠিক জলহস্তীর বিরাট মুখের মতই উপরের ঢাকনাটা হা করে খুলল। তারপর বন্ধ করল। তারপর আবার খুলল। এবার একটা বিকট ঢেঁকুরের আওয়াজ করল। তারপর কমোডের ঢাকনা বন্ধ করে চকচকে গোল চোখের মত জিনিস দুটো দিয়ে আবার আমার দিকে তাকাল, অন্তত আমার কাছে মনে হল যে আমার দিকে তাকল।
আমি জীবনে কখনও এরকম অবস্থায় পড়িনি। এরকম অবস্থায় পড়লে কী করতে হয় তাও বুঝতে পারছিনা। আমি কমোডটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এভাবে কতক্ষণ সময় গেল জানা নেই। একসময় দেখলাম কমোডটা আমার দিকে গুটি গুটি করে এগুতে লাগল। শিকারের দিকে বাঘ যেভাবে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়, অনেকটা ঠিক সেরকম। তাহলে কমোডটা কি আমাকে আক্রমণ করবে? আক্রমণ করে বিশাল ঢাকনা দিয়ে আমাকে খেয়ে ফেলবে? আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। আমি স্পষ্টই টের পাচ্ছিলাম যে, আতঙ্কে আমার চোখ ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। সামনে সবকিছু আবছা আবছা দেখছি। শেষপর্যন্ত একটা কমোডের কাছে আমাকে জীবন দিতে হবে?
এমন সময় উপর থেকে কেউ একজন মনে হল ডাকল – “এই যে ভাই! এই যে! এই দিকে আসেন।” আমি উপরে তাকালাম। দেখলাম আমি যে আম গাছটার নিচে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেই গাছের এক ডালে বসে সগিরউদ্দিন আমাকে ডাকছেন। সগিরউদ্দিন গাছে কেন – এই চিন্তাটা আমার মাথায় আসার কথা ছিল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেটা আসেনি। তার বদলে কিভাবে এই গাছে উঠব সেই চিন্তাটা আমার মাথায় এল। দেখলাম সগিরউদ্দিন আবারও হাত দিয়ে কি যেন ইশারা করছেন। মনে হল গাছে উঠতে ইশারা করছেন।
আমি জীবনে কখনও গাছে উঠিনি। ইশ্, যদি মইটাকে গেটের কাছে ফেলে না আসতাম তাহলে মই বেয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু এখন এসব নিয়ে চিন্তা করলে চলবে না। গাছে না উঠলে হিংস্র কমোডের হাতে প্রাণ যাবে। আমি বেশি চিন্তা না করে চোখ বুজে গাছের কান্ড খিমচে ধরে হাচড় পাচড় করে গাছ বেয়ে উঠার চেষ্টা করতে থাকি। একসময় মনে হলে কেউ একজন আমাকে ধরে টেনে তুলল। চোখ খুলে আবিষ্কার করলাম যে, আমি আসলে চোখ বুজে হাচড়ে পাচড়ে গাছ বেয়ে অনেকটুকু উঠে গিয়েছিলাম। কিছুদূর উঠার পর সগিরউদ্দিনের হাতের নাগালে আসতেই উনি খপ করে আমাকে ধরে টেনে তুলেন।
গাছের ডালে ঠিকমত পা মেলে বসলাম। গাছে উঠতে পেরে মনে হল একটা ফাড়া কেটে গেল। ফাড়া কেটে যাবার খুশিতে বেশ খুশি খুশি গলায় সগিরউদ্দিনকে বললাম – “আমাকে চিনতে পেরেছেন?” আমাকে দেখে খুশি হওয়া তো দূরের কথা উল্টো বিরক্ত হয়ে সগিরউদ্দিন বললেন – “একই প্রশ্ন বারবার করেন কেন? আপনাকে ভুলব কেন? আমার ব্রেইন কি গোল্ড ফিশের নাকি?”
আমি আর গোল্ডফিশকে টেনে আনতে চাইলাম না। শুকনো গলায় বললাম – “ধন্যবাদ গাছে টেনে উঠানোর জন্য।”
সগিরউদ্দিন ভ্রু কুঁচকে বললেন – “আপনি এখানে কি করছেন? আপনাকে না কালকে চলে যেতে বললাম। আর মই ছাড়া গাছে উঠতে গেছেন কেন?”
“মই?” – আমি বেশ অবাক হলাম – “এই অল্প সময়ে মই কোথায় পাব?”
“কেন মই তো গাছের নিচেই রয়েছে” – এই বলে সগিরউদ্দিন গাছের নিচে উঁকি দিলেন। উঁকি দিয়ে বুঝলেন যে গাছের নিচে কোন মই নেই। সাথে সাথে সগিরউদ্দিন চড়া গলায় ডাক দিলেন – “আক্কাস মিয়া! গাছে উঠার মই কোথায়?”
দেখলাম আমাদের ঠিক পাশের কাঠাল গাছের একটা ডাল থেকে আক্কাস মিয়া মাথা বের করল। “আপনে গাছে উঠার পরই মইটা গেটের বাইরে ফালায়া আসছি।” এখন বুঝলাম কেন গেটের সামনে মইটা পড়ে ছিল!
সগিরউদ্দিন বেশ বিস্মিত হলেন – “কেন? গেটের বাইরে মই ফেলেছ কেন?”
“যাতে আপনের রাক্ষুইস্যা কমোডটা গাছ বাইয়া উঠতে না পারে।”
আমি বেশ অবাক হলাম – কমোড গাছও বাইতে পারে! কিন্তু আমার চেয়ে সগিরউদ্দিন মনে হয় বেশি অবাক হয়েছেন। সগিরউদ্দিন সেই অবাক হওয়া স্বরেই আক্কাস আলীকে বললেন – “ঐটার পায়ে চাকা লাগানো, ঐটা কিভাবে খাড়া মই বেয়ে গাছে উঠবে? কোন গাড়িকে বিল্ডিংয়ের দেয়াল বেয়ে কখনও উঠতে দেখেছ?” আক্কাস মিয়া মাথা নাড়ল – না সে দেখে নাই।
এই সময় আবারও বিকট ঢেঁকুরের শব্দ শোনা গেল। উঁকি দিয়ে দেখি কমোডটা তখনো গাছের নিচে ঘুরাঘুরি করছে। নিচের জিনিসটা কি আসলেই কমোড? সগিরউদ্দিনের কথা থেকে তো মনে হল ওটা কমোড। কিন্তু কমোডের এই দশা কেন? মানুষের বাসায় কমোডকে বাথরুমে এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছি। আর সগিরউদ্দিনের বাসায় কমোডকে বাগানে দাপিয়ে বেড়াতে দেখছি – কী ভয়াবহ!
কিন্তু এই ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাব কিভাবে? গাছ থেকে নামবই বা কখন? সারা জীবন কি কমোডের ভয়ে গাছেই বসে থাকতে হবে? আর থাকতে না পেরে সগিরউদ্দিনকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম – “নিচের ঐ জিনিসটা কি?”
“দেখতেই তো পাচ্ছেন কমোড!” – সগিরউদ্দিনের বিরক্তিভরা জবাব। কাহিনী কি? এই লোক কি আমাকে দেখলেই বিরক্ত হয়, নাকি আমার সামনে বিরক্ত হবার ভাণ করে। লোকটার উপর মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একটু কড়া ভাষাতেই বললাম – “সেতো আমিও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই জিনিস বাথরুমে না থেকে বাগানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কেন?”
“ওর স্টোরেজ ট্যাংকটা খালি।” আমার কড়া গলা শুনে সগিরউদ্দিন একটু নরম হলেন।
“কিসের ট্যাংক খালি?”
“যেখানে সবকিছু জমা হয় সেই ট্যাংক খালি। বলতে পারেন ট্যাংকটা হচ্ছে ওটার পেট। ওর পেট এখন খালি। এই জন্য ঘোরাঘুরি করছে।”
“পেট খালি! মানে এটার কি ক্ষিদে পেয়েছে?” – আমি পুরোপুরি বিস্মিত। একটা কমোড ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বাগানে খাবারের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে – ব্যাপারটা হজম করা বেশ কষ্টকর।
“হু, বলতে পারেন ক্ষিদে পেয়েছে” – সগিরউদ্দিন বলতে লাগলেন – “কাল সন্ধ্যায় মুরগী খাবার পর পেটে আর কিছু যায়নি তো, তাই সকাল থেকে খাবার খুঁজছে।”
কমোড কিভাবে মুরগী খায়, কেনই বা মুরগী খায় – সগিরউদ্দিনের সাথে আমি আর সে প্রসঙ্গে গেলাম না। লোকটার সবকিছুই গোলমেলে। তারচেয়ে সগিরউদ্দিনকে ক্ষুধা সংক্রান্ত খুবই সাধারন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম – “তাহলে খাবার দিচ্ছেন না কেন?”
“সময় আর পেলাম কই? সকালবেলাতেই তো আক্রমণ করল। সেই জন্যই তো আমরা গাছে উঠে বসে আছি।”
আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। নিচে একটা ক্ষুধার্ত কমোড ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটা আবার ক্ষিদে মেটাবার জন্য মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে – নাহ আর চিন্তা করতে পারছিলাম না। নিজেকে ধাতস্থ করলাম। পুরো ব্যাপারটা গোড়া থেকে জানা দরকার। সগিরউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলাম, “লোকজনের কমোড টয়লেটের এক কোনায় থাকে, আপনারটা হেঁটে বেড়াচ্ছে কেন?”
“কমোডের কাছে হেঁটে যাওয়ার ঝামেলা বাঁচাতে কমোডকে হাঁটানো শিখিয়েছিলাম” – সগিরউদ্দিনের সরল স্বীকারোক্তি শুনে আমি তো থ! বলে কী লোকটা! কমোডের কাছে হেঁটে যাওয়া নাকি ঝামেলার! আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম সগিরউদ্দিনের দিকে। “কমোডের কাছে হেঁটে যাওয়া ঝামেলার?” – হতভম্ব হয়ে আমি সগিরউদ্দিনকে জিঞ্জেস করলাম। ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে।
“অবশ্যই কষ্টের” – সগিরউদ্দিন জোর গলায় বলতে লাগলেন – “আপনি যখন মনোযোগ দিয়ে কোন কাজ করতে যাবেন, দেখবেন তখনই আপনার শরীরের কোথাও না কোথাও চুলকাবে কিংবা আপনার প্রচন্ড বাথরুম পাবে।” আসলেই ঠিক। পরীক্ষার হলে অল্প সময়ের মধ্যে যখন খাতায় লিখে কোন কূলকিনারা পাওয়া যায়না তখনই প্রচন্ড টয়লেট ধরে। আমি একমত হয়ে মাথা নাড়লাম। সগিরউদ্দিন বলে চললেন – “মাসখানেক আগে যখন কোকালপাইজু’র কন্ট্রোল ইউনিটটা নিয়ে রিয়েলটাইম সিমুলেট করছিলাম, তখন এমন টয়লেট পেল যে বলার মত না …”। আমি মাঝপথে বাগড়া দিয়ে বললাম, – “আপনার ঐ কোকু … কোকু ..” বলতে গিয়ে আটকে গেলাম। কী উদ্ভট নাম যন্ত্রের! উচ্চারণ করতেই ট্রেনিং নিতে হয়। পরে নামটা পাশ কাটিয়ে বললাম – “মানে ঐ যন্ত্রটা ঠিক আছে? সেদিন মাঠের মাঝে আকাশ থেকে ভেঙ্গে পড়ল …”
সগিরউদ্দিন হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বওললেন – “সেদিনও বলেছিলাম ওটার নাম কোকালপাইজু। ওটা একটা ড্রোন …”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – “আপনি ড্রেনও তৈরি করেন?”। আসলেই ধাক্কা খাওয়ার মত খবর এটা। সগিরউদ্দিনের মত লোক ঢাকা শহরে ড্রেন বানাচ্ছে – ব্যপারটা বিশ্বাস করতে পারলাম না।
সগিরউদ্দিন বিরক্ত হয়ে বললেন – “ড্রেন বললাম কখন? আমি তো বললাম ড্রোন। দূর থেকে কন্ট্রোল করা যায় এরকম ছোট কোন প্লেন বা গাড়িকে ড্রোন বলে।” আমি আর কথা বাড়ালামনা, সব বুঝে ফেলার ভান করে মাথা নাড়লাম। সগিরউদ্দিন আবার বলা শুরু করলেন – “কই জানি ছিলাম? … ওহ … হ্যা … রিয়েলটাইম সিমুলেট করতে গিয়ে প্রচন্ড বাথরুম পেল। যদি বাথরুমে যাই, তাহলে সিমুলেশন ডেটা মিস করব। যদি বাথরুম না যাই তবে ল্যাবেই বাথরুম হয়ে যাবে। মহা সমস্যায় পড়ে … ”
আমি আবার বাগড়া দিলাম – “আপনার বুঝি ল্যাব আছে? শুনেছি সায়েন্স ল্যাবের মোড়ে যে ল্যাব আছে, সেখানে নাকি খাবারের ফরমালিন পরীক্ষা করে। আপনি কি ফরমালিন পরীক্ষা করেন ল্যাবে? আপনার ল্যাবে কি …।”
সগিরউদ্দিন হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন। বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন – “আমি ইঞ্জিনিয়ার। আমি খাবারের গুণাগুণ পরীক্ষা করিনা। আমি নতুন নতুন যন্ত্রপাতি বানাই। আর আপনি সব কথায় এত বাগড়া দেন কেন? হু … যা বলছিলাম … কাজের সময় বাথরুম যাওয়া খুব সমস্যার। তাই চিন্তা করলাম আমি উঠে না গিয়ে বরং বাথরুমকেই আমার কাছে নিয়ে আসি। সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তাই কমোডের নিচে ছোট ছোট চারটা চাকা বসিয়ে দিলাম আর ছোট একটা মাইক্রোকন্ট্রলার দিয়ে সাউন্ড অ্যাক্টিভিশনের একটা প্রোগ্রাম করে দিলাম। ফলে আমি যখনই হাততালি দেব তখনই কমোড আমার কাছে চলে আসবে। তাহলে আমি কাজ করতে করতেই টয়লেট সারতে পারব। আর টয়লেট করা শেষ হয়ে গেলে আবার হাততালি দিলে কমোডটা টয়লেটে তার জায়গায় ফিরে যাবে …”
আমি ভয়ে ভয়ে আবার বাগড়া দিলাম, “ইয়ে … আপনি তাহলে এখন হাত তালি দিন, তাহলেই তো কমোডটা আবার টয়লেটে চলে যাবে।”
সগিরউদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন – “এআই অ্যালগরিদমটা আপ্লোড না করলে ঠিকই টয়লেটে ফিরে যেত। কিন্তু এখন সম্ভব না।”
কোন কিছু আপ্লোড করা মানে নিশ্চয়ই সেটা ডাউনলোড করা যাবে। ইন্টারনেটে তো তাই দেখি, কোন কিছু আপ্লোড করা হলে তা আবার ডাউনলোড করা যায়। আমি খুবই উৎসাহী হয়ে বললাম – “আপনার ঐ আলুর দম না কি য়েন বললেন, সেটাকে ডাউনলোড করে ফেলেন, তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।”
বাচ্চারা কোন কিছু না বুঝলে বড়রা যেভাবে বাচ্চাদের দিকে তাকায়, সগিরউদ্দিন আমার দিকে ঠিক সেভাবে তাকালেন। তারপর আমাকে ন্যাদা বাচ্চাদের মত বোঝানো শুরু করলেন – “ওটা আলুর দম না, ওটা অ্যালগরিদম। এআই মানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর অ্যালগরিদম, মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই কমোডটার নিজের বুদ্ধি রয়েছে। সে সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর অ্যালগরিদম ডাউনলোড করে আমি করবইবা কি!”
“বুদ্ধিমান কমোড!” – আমি আাঁতকে উঠলাম। বলে কি লোকটা! একটা কমোড নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে? “কমোডকে বুদ্ধিমান করতে গেলেন কেন?” – আমি কিছুতেই কমোডের বুদ্ধিমত্তা মেনে নিতে পারছিলামনা।
“ধরেন আপনি ল্যাবে দুই হাতে কাজ করছেন, একহাতে একটা সোল্ডার গান, আরেক হাতে জেনারেটরের রোটর। এমনসময় টয়লেট চাপল, আপনি হাততালি দিয়ে কমোডকে ডাকবেন কিভাবে?” আমি চিন্তা করতে লাগলাম – দুইহাত ভর্তি জিনিস নিয়ে একজন মানুষের টয়লেট ধরাটা কি খুব ভয়াবহ ব্যাপার? দুহাতের জিনিসগুলো মাটিতে নামিয়ে রেখে টয়েলেটে গেলেই হয়। অবশ্য সগিরউদ্দিন যে মানুষ, তাতে হয়তো তার জন্য ব্যাপারটা ভয়াবহ হতে পারে।
“কী হল? কিছু বলছেন না যে? আপনি কমোডকে ডাকবেন কিভাবে?” – সগিরউদ্দিন আমার চিন্তা বাধ সাধলেন। কী জবাব দেব এর? আমি মাথা চুলকাতে লাগলাম। সগির উদ্দিন বললেন – “হ্যা … আপনি মাথা চুলকাবেন। কারণ আপনার কাছে এর কোন জবাব নেই। কিন্তু আমি চুলকাবনা। কারণ আমাকে টয়লেট করতে হবে। তাই আমি কমোডের ভেতর বুদ্ধি পুরে দিয়ে এটাকে পুরোপুরি অটোমেটিক করে ফেললাম! আমার শরীরের বিভিন্ন সেন্সিং ট্রান্সমিটার থেকে সিগনাল ট্রান্সমিট হয়ে কমোডের কাছে যাবে। সেসব সিগনাল অ্যানালাইসিস করে কমোডটা বুঝবে যে ককন আমার কমোডটাকে দরকার। সেটা বুঝে সে আমার কাছে চলে আসবে। হাত তালি দেবার আর প্রয়োজন নাই। ব্যস, সমস্যা সমাধান!” বলে সগিরউদ্দিন আমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি দিলেন।
আমি বললাম – “সমস্যার সমাধান যদি হয়েই থাকে তাহলে নিচে ওটা যে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমরা যে ভয়ে গাছে উঠে বসে আছি – এটা তাহলে কি?”
সগিরউদ্দিন উদাসভঙ্গীতে বললেন – “এটা নতুন সমস্যা। এটাও সমাধান করতে হবে।”
“কীভাবে?”
“জানিনা” – সগিরউদ্দিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“একটা কথা বলেন তো। আপনার কমোড হিংস্র হয়ে গেল কেন? সে কপাকপ করে সব খাওয়া শুরু করল কেন?”
সগিরউদ্দিন বলতে লাগলেন – “কমোডের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা ঢুকে যাবার পর পরই তার মধ্যে ক্ষিদের অনুভূতি তৈরি হয়। ফলে তার স্টোরেজ খালি হলেই সে সবকিছু খেয়ে ফেলতে চায়। একেবারে মানুষের মত ক্ষুধার অনুভূতি। আপনার ক্ষুধা লাগলে আপনার মনে হয় না যে, আপনি সামনে যা পাবেন তাই খেয়ে ফেলবেন? এই কমোডটারও এখন এই অবস্থা। আমার আ্যালগরিদমে কোন ভুল রয়ে গেছে মনে হচ্ছে।” সগিরউদ্দিন হতাশ হয়ে পড়লেন – সেটা অ্যালগরিদমে ভুল রয়েছে সে কারণেও হতে পারে আবার কমোডটা খেতে পারছেনা সে কারণেও হতে পারে।
আমি হতাশ সগিরউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলাম – “আর কমোডটার দুই পাশে চোখের মত ঐ জিনিসগুলো কি?”
“দুটো ওয়েবক্যাম লাগিয়ছিলাম, যাতে সে ইমেজ প্রসেস করে নিজের পথ নিজেই দেখে চলাফেরা করতে পারে।”
কী ভয়ানক! আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। ঐ দুটো আসলেই চোখ। আর সেই চোখ দিয়ে কমোডটা আমাকে পিট পিট করে দেখছিল। দৃঢ়্যটা চিন্তা করে আমার বুক শুকিয়ে গেল। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম – “কমোডটা যেহেতু একটা যন্ত্র, তাই কমোডটাকে কি কোন মতে অফ করা যায়না?”
“অবশ্যই করা যায়!”
“তাহলে অফ করছেননা কেন? সুইচ টিপে অফ করে দেন।”
সগিরউদ্দিন ইতস্তত করে বললেন – “আসলে ডিজাইনে বড়সড় একটা গোলমাল হয়ে গিয়েছে। এটাকে অফ করার কোন সুইচ রাখা হয়নি। সৌরশক্তিতে চালানোর জন্য এটার উপর সোলারপ্যানেল বসিয়েছিলাম। ফলে আমার চার্জ দেয়া লাগতনা। যখন চার্জের সময় হত, কমোডটা নিজে থেকেই বাইরে এসে রোদে দাঁড়িয়ে থাকত। চার্জ হয়ে গেলে আবার চলে যেত। আগে তো গন্ডগোল করেনি, তাই সুইচ রাখার প্রয়োজনবোধ করিনি।”
“তাহলে আপনি যে বললেন অফ করা সম্ভব!”
“যখন কমোডটার সব চার্জ ফুরিয়ে যাবে তখন ও অফ হয়ে যাবে।”
“কিভাবে সব চার্জ ফুরাবে?”
“রোদ না পেলেই ওটা চার্জ হতে পারবেনা। আর চার্জ না হলে একসময় সব চার্জ ফুরিয়ে যাবে। দেখছেন না বাইরে মেঘলা আবহাওয়া। এই আবহাওয়ায় ঠিক মত চার্জ হতে পারবেনা। তারপর রাতের বেলায়ও রোদ পাবেনা। এভাবে চললে আমার হিসেবে প্রায় তিনদিন পর এটার চার্জ ফুরিয়ে যাবে।”
আমি আঁতকে উঠলাম – “তিনদিন গাছে বসে থাকতে হবে? ঝড় বৃষ্টি হলে?”
“সমস্যা কি? গাছে থাকা কঠিন ব্যাপার নাকি? বানর, হনুমান, পাখি – কত রকম জীবজন্তু গাছে থাকে।” – সগিরউদ্দিন নির্লিপ্তভাবে বললেন – “আক্কাস মিয়াকে দেখেন, কিভাবে গাছে ঘুমাচ্ছে!”
তাকিয়ে দেখলাম আসলেই তাই। আক্কাস মিয়া গাছের ডালে পা ছড়িয়ে বসে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আমি তো আর আক্কাস মিয়া নই, কিংবা বানর-হনুমানও নই। যেভাবেই হোক কমোডকে অফ করে মাটিতে নামতে হবে। আমি মরিয়া হয়ে সগিরউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলাম – “কোন ভাবে এটা থেকে তাড়াতাড়ি চার্জ বের করে নেয়া যায়না? পাইপ থেকে পানি যেভাবে লিক করে, এটা থেকে চার্জ লিক করানো যায় না?”
“করানো যায়। অন্ধকারে যাতে সহজে চার্জ ড্রেইনেজ না হয় সেজন্য সোলার প্যানেলে রিভার্স বায়াসে অনেকগুলো ডায়োড বসিয়েছিলাম। সেগুলোকে খুলে ফেললেই তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ হয়ে যাবে।” – সগিরউদ্দিন নির্লিপ্তভাবে বলে গেলেন।
আমি সগিরউদ্দিনের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝিনি। কিন্তু কমোডের চার্জ শেষ করে একে বিকল করা যাবে শুনে গায়ে জোর ফিরে এল। আমি মরিয়া হয়ে বললাম – “তাহলে ডায়েট না ফায়েট কী বললেন… সেগুলোকে খুলে ফেলুন!”
সগিরউদ্দিন মাথা চুলকাতে চাুলকাতে বললেন – “ডায়েট না ডায়োড। কিন্তু ডায়োডগুলো কমোডের উপর লাগানো সোলারপ্যানেলের নিচে রয়েছে। ওগুলো খুলতে হলে কমোডের কাছে যেতে হবে। কাছে যাব কি করে?”
এতো মহা সমস্যা! কমোডের কাছে যাওয়াই তো ভয়াবহ একটা ব্যাপার। কোন কারনে যদি কমোডের তলা থেকে চাকাগুলো খুলে ফেলা যেত, তাহলে আর কমোড কাউকে দেখলে তেড়ে আসতে পারত না। তখন কমোডের কাছে গিয়ে সহজেই কাজ করা যেত। আমার মাথায় হঠাৎ করে একটা বুদ্ধি আসল। সগিরউদ্দিনকে বললাম – “যদি কমোডটাকে উল্টে ফেলে দেই। ধরেন যদি কোন গাড়িকে কাত করে উল্টে ফেলা হয়, তখন যতই চাকা ঘুরানো হোক না কেন – গাড়িটা কিন্তু নড়বেনা। কমোডটাকেও তো একই কাজ করতে পারি। তাহলেই কমোডটার চাকা কোন কাজে আসবেনা। তখন গিয়ে ডায়েটগুলো খুলে নেয়া যাবে।”
সগিরউদ্দিন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন – “দেখুন ওটা ডায়োড। ডায়েট নয়। আর আমার কোন ওয়্যারলেস কন্ট্রোলার নেই কমোডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। অবশ্য সনিকবুম তৈরি করে শব্দের তোড়ে ওটাকে উল্টে ফেলা সম্ভব। কিন্তু সনিকবুম জেনারেটরটা আমার ল্যাবে …”
এতো আরেক সমস্যা! এই লোকতো সহজে কোন কিছু বোঝেনা। আমি হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলাম – “ঐসব বুমটুম লাগবেনা। কাছে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে যদি কমোডটাকে উল্টে ফেলে দেয়া যায়।”
সগিরউদ্দিন শুকনো গলায় বললেন – “কাছে গেলেই যদি খেয়ে ফেলে?”
আমি অভয় দিলাম – “আপনার মইটা নিয়ে আসব। তারপর আপনি, আক্কাস মিয়া আর আমি – তিনজন মিলে মই দিয়ে ধাক্কা মেরে কমোডটাকে উল্টে দিতে পারি।”
সগিরউদ্দিন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন যে আমি কী বলতে চাচ্ছি। হাতে একটা কিল দিয়ে বললেন – “আসলেই তো সম্ভব! পাশাপাশি জায়গা বেশি লাগবে বলে চাকাটার প্লাটফর্ম কমোডের গা ঘেঁষে করেছিলাম। ফলে আড়াআড়িভাবে এটা ইমব্যালেন্স হয়ে আছে। তাই যেকোন এক পাশ থেকে ধাক্কা দিলেই এটা উল্টে পড়ে যাবে। চমৎকার! … আক্কাস মিয়া … আক্কাস মিয়া ওঠো …”
তারপরের কাহিনী বেশ ছোট। কমোডটা যখন আমাদের গাছ থেকে কিছুটা দূরে চলে গিয়েছে, সে সময় আমরা তিনজন চটপট করে গাছ থেকে নেমে গেটের কাছে চলে গেলাম। সেখান থেকে আমার ফেলে রাখা মইটাকে তিনজন একসাথে ধরলাম। তারপর সারি ধরে তিনজন দৌড়ে গিয়ে কমোডটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম। উল্টে থাকা কমোড থেকে সগিরউদ্দিন ডায়োডগুলো খুলে সেটাকে নিষ্ক্রিয় করে দিলেন।
কমোড নিষ্ক্রিয় হবার পর আমিও চলে আসি ওখান থেকে। সগিরউদ্দিনের বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকার ইচ্ছা হচ্ছিলনা, যা একটা দিন গেল!
৫।
বিকেলে আমার মোবাইলে একটা অদ্ভুত ম্যাসেজ আসল। ম্যাসেজটা এসেছে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে। ম্যাসেজটাতে কোন বর্ণ নেই বরং চারকোনা বাক্স দিয়ে ভর্তি। ম্যাসেজের নাম্বারে ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে কেউ একজন ফোন তুলে বলল – “হ্যালো আদনান ভাই কেমন আছেন?”
“ভালো আছি। আপনি কে বলছেন?”
“আমি সগিরউদ্দিন বলছিলাম। একটু বাসায় আসেন, জরুরি কথা আছে।” এই বলে উনি ফোন কেটে দিলেন। আমার ফোন নাম্বার পেল কোথায়? মনে পড়ল, প্রথমদিন তার বাড়িতে গিয়ে আমি নিজেই ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সগিরউদ্দিন তো কথা শেষ করেননি! কয়েকবার চেষ্টা করলাম সগিরউদ্দিনকে ফোনে পেতে, কিন্তু উনি ফোনই ধরছেননা। কী অদ্ভুত লোক রে বাবা! আবার কি ঝামেলা বাধিয়েছেন কে জানে! যাব নাকি যাব না – চিন্তা করতে করতে চলেই গেলাম তার বাসায়।
সগিরউদ্দিনের বাসায় আমাকে দেখেই আক্কাস মিয়া চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ঠকাস করে সালাম দিল। তারপর আমাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে রাখা গাড়ির চেয়ারে বসাল। কিছুক্ষণ পর সগিরউদ্দিন আসলেন। আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে বললেন – “আমি জানতাম আপনি রাজী হবেন।”
আমি অবাক – “কিসে রাজী হলাম?”
“কেন! বাড়ি ভাড়া নিতে! আপনাকে এসএমএস পাঠালাম না!”
“ঐ এসএমএসে কোন কিছু লেখা নাই। শুধু চারকোনা বাক্স রয়েছে।”
“ওহ! বুঝেছি। আপনার মোবাইলে বাংলা ফন্ট ইন্সটল করা নাই। আমি আবার বাংলায় এসএমএস লিখি। এই দেখেন এসএমএস টা।” – এই বলে সগিরউদ্দিন তার মোবাইলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। দেখলাম উনি আমাকে যে এসএমএস পাঠিয়েছেন তা হল – “ব্যবহার দুঃখিত। মত পরিবর্তন। ভাড়া হবে। জলদি আসুন।”
কী অদ্ভুত ভাষা! একেবারেই সংক্ষিপ্ত! সগিরউদ্দিনের এসএমএসটার মানে করলে দাঁড়ায় – “আগের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। আমি মত পরিবর্তন করেছি। আমি বাসা ভাড়া দেব। আমার বাসায় আসুন। আমরা ভাড়া নিয়ে কথা বলি।”
আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে সগিরউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললাম – “আপনি বাংলায় এসএমএস লেখেন কেন?”
“আমি ইংলিশে সংক্ষেপে লিখতে পারিনা। ইংলিশ গ্রামারে সংক্ষেপে লেখার কোন নিয়ম নাই। আর এত বড় এসএমএস লেখার সময় কই?”
“বাংলা কথাগুলোকেই ইংলিশে লিখতেন।”
“ওটা আমার পছন্দ না। আমাদের এত সুন্দর বর্ণমালা রয়েছে। সেটা ফেলে অন্য দেশের বর্ণমালা ব্যবহার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।” তারপর মোবাইল টিপে কি যেন বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন – “এইটা পড়ে দেখেন তো কিছু বোঝেন কী না। আক্কাস মিয়া আপনার মত বাংলাকে ইংলিশ অক্ষরে লিখে পাঠিয়েছিল।”
আমি এসএমএসটা পড়লাম। “rate dem vage krasi” – এতো দুর্বোধ্য ভাষা! আমি অসহায়ের মত সগিরউদ্দিনের দিকে তাকালাম। সগিরউদ্দিন মিটি মিটি হেসে বললেন – “কিছু বোঝেননি তাই না! আমিও প্রথমবার কিছু বুঝিনি। কয়েকবার পড়ে তারপর বুঝেছি। আক্কাস মিয়া যা লিখেছে, তা হল – রাতে ডিম ভাজি করেছি।”
সগিরউদ্দিন পকেটে মোবাইল ফোনটা ঢুকিয়ে বললেন – “আপনি সেদিন না থাকলে আমাকে তিনদিন গাছে বসে থাকতে হত। রোদে পুড়তে হত, বৃষ্টিতে ভিজতে হত। আপনি ছিলেন বলেই বুদ্ধিটা বের করলেন। আপনার মত বন্ধু হয়না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আপনার কাছে আমি বাসা ভাড়া দেব।”
এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত। এই রকম ইঞ্জিনিয়ারের সাথে একই বাড়িতে থাকা উচিত, নাকি মানে মানে কেটে পড়ে অন্য বাসা খোঁজা উচিত। এদিকে হাতেও সময় নেই যে আরেকটা বাসা খুঁজে বের করব। আর বাসা না পাওয়ায় ভাইয়াও বকাবকি করছে। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। চিন্তায় নানারকম যোগ বিয়োগ করছি। শেষমেষ সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আপাতত ভাইয়ার ঝাড়ি থেকে বাঁচার জন্য সগিরউদ্দিনের এই প্রস্তাবে রাজী হওয়া ছাড়া আমার হাতে আর কোন উপায়ও নেই, সময়ও নেই। সগিরউদ্দিনকে বললাম – “ঠিক আছে আমি রাজি।”
সগিরউদ্দিন আমাকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে তার সম্মতি জানিয়ে বলল – “তাহলে মালপত্র নিয়ে আসেন। আমি আক্কাস মিয়াকে দিয়ে উপরের ঘরগুলো পরিস্কার করিয়ে রাখব।”
এর মধ্যেই দেখলাম আক্কাস মিয়া নাস্তা নিয়ে এসেছে। প্লেট ভর্তি নাস্তা দেখে আগেরবার নাস্তা না দেবার দুঃখ ভুলে গেলাম। মালপত্র পরে আনা যাবে, আগে নাস্তা খেয়ে ফেলি। সগিরউদ্দিনের দিকে একটা সম্মতির হাসি দিয়ে আমি নাস্তা খেতে মন দিলাম।
৬।
এই হল সগির উদ্দিনের সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের কাহিনী। সেদিন বাড়ি ভাড়া নেবার সময় ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে সগিরউদ্দিন লোকটার জন্য আমার জীবনে ক্ষুধার্ত কমোডের মত আরও অনেক অ্যাডভেঞ্চার এসে যুক্ত হবে। সেসব অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী পরে একসময় বলা যাবে। পরিচয় পর্বের কাহিনী বরং এখানেই শেষ করি।
চমৎকার লেখা।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে আপনার দেখা সেই ইকবাল রোড, স্যার সৈয়দ রোড আর লালমাটিয়া আগের চেহারায় আর নেই। পাল্টে গিয়েছে বহুভাবে। তবে কিছু মাঠ হয়তোবা এখনো টিকে আছে, দখলের ভিড়ে মিলিয়ে যায়নি।
মনে হচ্ছে আপনার লেখায় জীবনের অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কিত হতে যাচ্ছে। অপেক্ষায় থাকলাম পরবর্তী পর্বের জন্য। 😉
লালমাটিয়ায় কিন্তু এখনও দুটো মাঠ রয়ে গেছে, যেখানে ছেলেপেলেরা দৌড়ঝাঁপ করে! ইকবাল রোড সেইরকম নেই, তবে খুঁজলে এখনও দু’তিনটা দোতলা বা এক তলা বাড়ি পাওয়া যায়! সত্যি বলছি কিন্তু! 🙂
ইচ্ছে হল তাই এটা লিখে ফেললাম। পরেরটা কবে হবে তাও জানিনা। তাই অপেক্ষায় থেকেননা। পস্তাবার চান্স বেশি! 😀
খুব সুন্দর রম্য ঘরানার সায়েন্স ফিকশন। নুরজাহান রোডে আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে বাসা নিয়েছে। বেশ কয়েকবার গিয়েছি। হাঁটাহাঁটি করতে করতে ইকবাল রোডেও গিয়েছি। মাঠটা বেশ সুন্দর। একটা লাইন বেশ মজা লেগেছে – “আমাকে দেখলে কি ইস্কুলের গাধা ছাত্র মনে হয়?”… হা হা!
সময় নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ! 🙂
স্যার আপনি অনেক ভালো লেখেন,পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম
স্যার আমার maximum D7 ক্যামেরা অটোমেটিক ঘুরাঘুরি করে কেন?
মোবাইল রিস্টার্ট দিয়েছি কিন্তু কোন কাজ হয় নি।
এটার কোন সমাধান আছে কি?