ইঞ্জিনিয়ার সগির উদ্দিন

১।

তোমরা হয়তো ইঞ্জিনিয়ার সগির উদ্দিনকে চিনবেনা। এই মানুষটাকে না চেনাটা দোষের কিছু না, সত্যি বলতে কী – ওনাকে অনেকেই চিনেনা। আমিও চিনতামনা। আমি যে খুব বেশি মানুষকে চিনি তা অবশ্য না। অনেক সময় নিজের আত্মীয় স্বজনদেরই ঠিকঠাক মত চিনতে পারিনা। তাই কোন বিয়ে বা মুসলমানী টাইপের দাওয়াতে যখন সব আত্মীয়রা এক হয়, তখন আমাকে অপদস্থ করার জন্য তারা এক নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠে। চারপাশে সবাই আমাকে কীভাবে কীভাবে যেন ঘিরে ধরে ফেলে, যেন আমি কেটে পড়তে না পারি। তারপর একজন একজন করে আমার কাছে আসে, আর জিজ্ঞেস করে – “আমাকে চেনো? বলতো আমি কে?”। তখন আমি তাকে প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে থাকি, এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি সেই কাজটা ঠিক করে করতে পারিনা। তখনই চারদিকে একটা হাসির রোল উঠে। সবাই মাথা নেড়ে একটাই কথা বলতে থাকে – “বলেছিলাম না পারবেনা!”

যাই হোক, আমার কথা বাদ। আমি বরং ইঞ্জিনিয়ার সগির উদ্দিনকে নিয়ে কথা বলি। সগিরউদ্দিনের সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার ব্যাপারটা মোটেও সাদামাটা ছিলনা। ভাইয়া-ভাবীকে নিয়ে ঢাকায় থাকার মত একটা বাসা খুঁজছিলাম। ভাইয়া চট্টগ্রামে চাকরি করত। তার ঢাকায় বদলি হয়ে যায়। তাই সবাইকে নিয়ে ঢাকায় থাকার মত বাসা খোঁজার জন্য আমাকেই ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হল। আমি অবশ্য বেকার মানুষ, ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে আছি। এই সময়ে ঢাকায় বাসা খুঁজতে যাবার আইডিয়াটা মন্দ লাগেনি। ঢাকায় এসে এক বন্ধুর বাসায় উঠলাম। প্রতিদিন সকাল বেলা নাস্তা খেয়ে রুটিন করে বিভিন্ন এলাকায় বাসা খুঁজতে বের হই। বাসা খুঁজতে গিয় টের পেলাম যে, মন মত বাসা পাওয়া বেশ ঝক্কির ব্যাপার। ঢাকার বাসাগুলো সব ছোট ছোট খুপরির মত। কোন বাসাই পছন্দ হয়না। আর যদি বাসা পছন্দ হয়ও, বাসা ভাড়ার দাম পছন্দ হয়না। আবার সব পছন্দ হলে বাড়িওয়ালা পছন্দ হয়না। মহা ঝামেলার ব্যাপার!

মহা ঝামেলার এই ব্যাপার মাথায় নিয়ে, একদিন লালমাটিয়া এলাকায় বাসা খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে বিকাল বেলায় লালমাটিয়ার মাঠে হাত পা ছড়িয়ে বসে ছিলাম। যখন মন উদাস উদাস লাগে তখন এই কাজটা আমি প্রায়ই করি। বসে থাকলে কেন জানি মন উদাস ভাবটা চলে যায়। মাঠে বসে বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলা দেখছি। দেখতে যে খুব ভাল লাগছিল তা না, বরং বেশ ভয় ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি বল আমার মাথায় পড়ল। এ জন্য সারাক্ষণ বলের দিকে চোখ রেখে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন হাবিজাবি চিন্তা করছিলাম। এমন সময় হুড়মুড় করে কী যেন একটা আমার উপর পড়ে গেল! শুধু পড়েই ক্ষান্ত হয়নি, আমাকে ভিজিয়েও দিল। হঠাৎ এরকম আচমকা আক্রমনে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। মনে হল সারা শরীরে আঠাল কিছু একটার স্রোত বয়ে গেছে। বুদ্ধি ফেরত আসতেই চারদিকে তাকিয়ে দেখি বাচ্চা ছেলেপিলেরা আমার দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে হাসছে। বাচ্চারা খুব নিষ্ঠুর হয়। আমি আঠালো পদার্থে মাখামাখি হয়ে আছি, আর এরা সেটা নিয়ে হাসাহাসি করছে! কী পাষন্ড! এর মধ্যে আঠালো পদার্থটার কিছু অংশ বেয়ে বেয়ে মুখে গেল। বাহ, বেশ মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। আমি একটু চেটে পুটে খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি।
Continue reading ইঞ্জিনিয়ার সগির উদ্দিন

থিসিসনামা ৩: খরগোশের থিসিস

এক শেয়াল বেশ খোশমেজাজে বনের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দেখলো যে একটা খোরগোশ তার ল্যাপটপে খুটখাট করে কী যেন করছে। কৌতুহলী শেয়াল খরগোশের কাছে এগিয়ে গেল। উঁকি দিয়ে দেখল যে খরগোশ কী সব যেন লিখে যাচ্ছে। শেয়াল খরগোশকে জিজ্ঞেস করল – ‘কি করছিসরে তুই?’
খরগোশ ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল – ‘আমার থিসিস লিখছি।’
শেয়াল বলল – ‘কিসের উপর থিসিস লিখছিস? বিষয়বস্তু কি?’
খরগোশ ল্যাপটপে লিখতে লিখতে বলল – ‘আমার থিসিসের মূল বিষয় হচ্ছে খরগোশরা কিভাবে শেয়াল খায়।’
থিসিসের বিষয়বস্তু শুনে শেয়াল হতভম্ব হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল – ‘এ কী ধরণের গাঁজাখুরি থিসিস? কোন উজবুকও বিশ্বাস করবেনা যে খরগোশ শেয়াল খায়!’
এবার খরগোশ শেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘অবশ্যই খরগোশরা শেয়াল খায়। প্রমাণ চাও?’
মুচকি হাসি দিয়ে শেয়াল বলল – ‘অবশ্যই। ‘
খরগোশ ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে বলল – ‘তাহলে আমার সাথে গুহায় চল। সব ড্যাটা ঐখানে আছে।’
শেয়ালও রাজি হয়ে গেল। তারপর শেয়াল ও খরগোশ দু’জনে খরগোশের গুহার ভেতরে গেল। কিছুক্ষণ পর খরগোশটি গুহা থেকে একা বের হয়ে এল এবং আগের মতই তার ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পর ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল এক নেকড়ে। খরগোশকে ল্যাপটপের ব্যস্তভাবে কাজ করতে দেখে সেও থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল – ‘কীরে কি করছিস?’।
খরগোশ ব্যস্তসমস্ত হয়ে উত্তর দিল – ‘খরগোশরা কিভাবে নেকড়ে খায় সেটা নিয়ে একটা থিসিস লিখছি।’
শুনে নেকড়ে অট্টহাসিতে পেটে পড়ল। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল – ‘এইসব হাগড়পাগড় থিসিস কোনো সুপারভাইজার অ্যাক্সেপ্ট করবেনা।’
খরগোশ বেশ জোর দিয়ে বলল – ‘মোটেও হাগড়পাগড় কিছু না। তুমি দেখতে চাও? আমার কাছে তথ্য-প্রমাণ সবই আছে, দেখতে চাইলে আমার সাথে আমার গুহায় যেতে হবে।’
নেকড়ে রাজি হল। খরগোশ ও নেকড়ে দু’জনেই গুহার ভেতর গেল। কিছুক্ষণ পর খরগোশ একলা বের হয়ে এসে আবার তার ল্যাপটপে খুটখাট করে তার থিসিস লিখে চলল।

আরো কিছুক্ষণ পর আরেকটা খরগোশ যাচ্ছিল সেই একই পথ দিয়ে। ল্যাপটপে বুঁদ হয়ে থাকা খরগোশটিকে দেখে দ্বিতীয় খরগোশটি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল – ‘কি লিখছ তুমি?’
প্রথম খরগোশটি বলল – ‘খরগোশরা কিভাবে শেয়াল আর নেকড়ে খায় সেটার উপর থিসিস লিখছি।’
দ্বিতীয় খরগোশটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করল – ‘এটা কি করে সম্ভব?’
প্রথম খরগোশটি বলল – ‘খুব সম্ভব। আমার গুহায় চল, তাহলেই সবকিছু দেখতে পাবে।’
দ্বিতীয় খরগোশটি রাজি হয়ে প্রথম খরগোশটির পেছন পেছন তার গুহায় গেল। গুহায় গিয়ে তো দ্বিতীয় খরগোশের চোখ ছানাবড়া। সে দেখলো গুহার এক কোণায় শেয়ালের হাড়ের স্তুপ, আরেক কোণায় নেকড়ের হাড়ের স্তুপ হয়ে আছে। দুই হাড়ের স্তুপের মাঝে বসে এক সিংহ দাঁত খোঁচাচ্ছে আর ঢেঁকুড় তুলছে!


এই গল্পের নীতিকথাঃ
তুমি কি বিষয়ে থিসিস করছ সেটা মুখ্য নয়, কি উপায়ে তুমি উপাত্ত সংগ্রহ করছ সেটাও মুখ্য নয়। মূল ব্যাপার হচ্ছে থিসিস সুপার ভাইজার হিসেবে তুমি কাকে নিয়েছ?

থিসিসনামা ২: মফিজ ও হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

শীতকালীন ছুটিতে মফিজ প্রতিদিন ফুটবল খেলোয়াড়ের জার্সি পড়ে একটা হুইসেল আর কিছু পাখির খাবার নিয়ে ভার্সিটির খেলার মাঠে যেত। সেসময় মাঠে কেউ থাকতোনা। মফিজ অনেকটুকু সময় নিয়ে মাঠের উপর খাবারদানা ছড়িয়ে দিত, তারপর হুইসেল বাজিয়ে মাঠ থেকে চলে যেত।

শীতকালীন ছুটি শেষে ভার্সিটি খুলার পর আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল খেলার প্রথমদিন রেফারি মাঠে ঢুকে খেলা শুরু করার জন্য হুইসেল বাজায় এবং খেলাটি কয়েকঘন্টার জন্য স্থগিত করা হয়। মাঠ থেকে শ’খানেক পাখিকে সরিয়ে খেলাটি অবশেষে শুরু করা হয়।

এই ঘটনার উপর মফিজ তার থিসিস লেখা শেষ করল – “… উপরোক্ত উদাহরণ ও আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে যে, আকার-আকৃতি ও কার্য-প্রকরণভেদে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার বাঁশি এবং ফুটবলের রেফারির বাঁশিতে বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। ইদুঁর কিংবা বাচ্চাদের আকৃষ্ট না করে উপযুক্ত পরিবেশে রেফারির বাঁশি খেলোয়াড়দের পাশাপাশি পাখিদেরও আকৃষ্ট করার সামর্থ রাখে।”

থিসিসনামা ১: মফিজ ও তেলাপোকা

চারদিকে সবাই থিসিস লিখছে। থিসিস না লিখলে মানসম্মান কিছু থাকেনা। নিজের মানসম্মান রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই মফিজ ঠিক করল তারও একটা থিসিস লেখা দরকার। কী নিয়ে থিসিস লেখা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে ঘরের কোনায় কিছু তেলাপোকা দেখে অবশেষে তার মাথায় একটা প্রজেক্টের আইডিয়া খেলে গেল।

প্রজেক্টের প্রথম ধাপ হচ্ছে উপাত্ত সংগ্রহ। এজন্য একটা তেলাপোকা ধরে এনে মফিজ সেটার একটা পা ছিঁড়ে ফেলল। তারপর সেটাকে টেবিলে রেখে মুখে বলল, “পালা!” টেবিলে পড়েই তেলোপোকাটি সামনের দিকে পড়িমড়ি করে ছুটতে লাগল। তারপর মফিজ সেটাকে আবার ধরে আরেকটা পা ছিঁড়ে ফেলল, তারপর টেবিলে রেখে বলল, “পালা!” তেলাপোকাটি আবারো টেবিলে পড়েই আগের মত ছুটে যেতে চেষ্টা করল। এবার মফিজ তেলাপোকাটির তৃতীয় পা ছিঁড়ে ফেলে টেবিলে রেখে বলল, “পালা!” এবারও তেলাপোকাটি হাঁচড়ে-পাঁচড়ে সামনে যেতে চেষ্টা করল। এভাবে মফিজ প্রতিবার একটা করে পা ছিঁড়ে তেলাপোকাটিকে সামনে যেতে বলত। শেষ পর্যন্ত যখন তেলাপোকাটির সবগুলো পা-ই মফিজ ছিঁড়ে ফেলল, তখন তেলাপোকাটি আর নড়াচড়া করতে পারলনা, অসহায় ভাবে টেবিলে পড়ে থাকল। একটা তেলাপোকার উপর পরীক্ষা করে মফিজ তার প্রজেক্টের উপাত্ত সংগ্রহ করল।

উপাত্তের মানের নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য মফিজ আরো শ’খানেক তেলাপোকার উপর একই পরীক্ষা চালায়, এবং নিশ্চিত হয় যে তার ফলাফল প্রতিবারই নির্ভুলভাবে প্রথমবারের পরীক্ষার সাথে মিলে যাচ্ছে। প্রজেক্টের সাফল্যে মফিজ খুশিতে আটখানা।

এবার সে তার থিসিস লেখা শুরু করল – “একটা তেলাপোকার সবগুলো পা কেটে নিলে তেলাপোকাটি বদ্ধকালা হয়ে যায়!”