একটি বর্ষাপ্লাবিত দিন!

বাংলাদেশে এসে অনেকদিন পর কুকুর-বিড়াক টাইপের মুষলধারে বৃষ্টি দেখলাম। কথা নাই বার্তা নাই রাত বারটার দিকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। ভ্যাপসা গরমের পর বৃষ্টি বেশ ভালোই লাগলো। রাতে আরামে ঘুমানো যাবে চিন্তা করেই বিছানায় চলে গেলাম! তাছাড়া আবার পরদিন আমার পুরনো কর্মক্ষেত্রে প্রাক্তন কলিগদের সাথে দেখা করার কথা। তাই এমন বৃষ্টির রাতে ঝরঝরে ঘুম হওয়াটা বেশ জরুরি ব্যাপার।

পরদিন সকালে সকাল আটটার দিকে ঘুম ভাঙলো। বাইরে তখনো বৃষ্টি হচ্ছে! একটানা বৃষ্টি হচ্ছে নাকি মাঝে বন্ধ হয়ে আবার শুরুর হয়েছে বোঝার কোন উপায় নাই। বন্ধ হয়ে থাকবে হয়তো, কারন টানা বৃষ্টি বাংলা দেশে দেখিনা বহুদিন। ছোটবেলায় এমন বৃষ্টি নামতো যে স্কুল ছুটি করে দেয়া হত, ঐদিনকে বলা হত রেইনি ডে। সেসময় ঝুম বৃষ্টি হলেই দোয়া পড়তাম যেন স্কুল বন্ধ ঘোষনা করে! সেরকম বৃষ্টি দেখিনা অনেক বছর। এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে দেখি আম্মু চলে এসেছে। প্রতিদিন সকালে ছোট বোনকে কলেজে দিয়ে আম্মু বাসায় চলে আসে। তবে আজকে ব্যতিক্রম, সঙ্গে দেখি বোনও চলে এসেছে? কাহিনী কি! পরে শুনি আজকে ওদের স্কুলে রেইনি ডে!

ছবিটি ২৯ শে জুলাইয়ের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠা ছাপা হয়।

আম্মুর কাছেই প্রথম শুনলাম যে ঢাকার রাস্তা ঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে! যেই ধানমন্ডি সহজে ডুবেনা সেটা পর্যন্ত পানিতে থইথই করছে, ধানমন্ডি লেক পানিতে টইটুম্বুর! বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন খবর পেতে লাগলাম- সাতাশ নম্বরে রাপাপ্লাজার সামনে নাকি মাথার উপর দিয়ে পানি যাচ্ছে, মানুষজন লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে ডুব সাঁতার দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, রাস্তা ঘাটে গাড়িগুলো সব অচল হয়ে পড়ে আছে, কোন কোন জায়গায় নাকি গাড়ির ছাদ পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে- আরো কত কি! যাই হোক সব শুনেটুনে মনে হল আজকে সংগত কারনেই আর পুরনো কর্মস্থল পরিদর্শনে যাওয়া হবে না। শরীফ ভাইকে ফোনে জানালাম যে আসতে পারছিনা, ঢাকার অবস্থার বর্ননা দিলাম! বেচারা ঘুম ঘুম চোখে কি শুনল কে জানে তবে বেশ খুশিই হল মনে হল, একটা টানা ঘুম দিতে পারবে অন্তত।

বাসায় বড়মামা ফোন দিল, মালিবাগে আমার নানুবাড়ির একতলায় হাঁটু পানি। এইটা একটু ভয়ঙ্কর ব্যাপার, মালিবাগ এলাকাটা এমনিতেই একটু নিচু, তাই বৃষ্টি হলে পানি জমে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সেই পানি ঠেকাতে ঘরেরে সামনে এবং গেটের সামনে ইট সিমেন্ট দিয়ে সাত-আট ইঞ্চি উঁচু ছোটখাট বাঁধ দেয়া হয়েছিল। সেই বাঁধ টপকে পানি ঢুকে পড়েছে। পানি উঠার প্রথম পর্বে একতলায় নাকি পানি সেচার কাজ হচ্ছিল, এখন বাইরের পানি আর ঘরের পানির লেভেল এক হয়ে যাওয়াতে সেই কাজ আপাতত বন্ধ!

এরপর ফোন দিল মিনহাজ ভাই, তার বাসায়ও নাকি হাঁটু পানি! এইবার ভালো বিচলিত হলাম, যতদূর জানি এই লোক থাকে তিনতলায় বা চারতলায়, অর্থ্যাৎ ছাদের ঠিক নিচের ফ্লোরেই। তারমানে কি এতই বৃষ্টি হল যে তার বাড়ির একতলা দোতলা ডুবে গিয়ে তিনতলার ফ্লোরও ডুবিয়ে দিয়েছে! পরে জানলাম খবর অন্য, উনাদের ছাদের পানি জাবার পাইপ ব্লকড হয়ে যাওয়ায় ছাদের সব পানি সিঁড়ি দিয়ে তাদের বাসায় চলে এসেছে!

ঢাকার ষাট বছরেরে ইতিহাসে নাকি সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে সেদিন, ৩৩০ মিলিলিটার! দশ ঘন্টার সেই বৃষ্টি হলে ঢাকা হয়ে যায় একটা বড়সর লেক – কোন ছাগল যে ঢাকাকে আধুনিক শহর নাম দিয়েছিল! টিভি আর খবরের কাগজে দেখলাম চিরাচরিত সেই দৃশ্য- সিটি কর্পোরেশন দোষ দিচ্ছে ওয়াসার ঘাড়ে আর ওয়াসা দিচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের ঘাড়ে। অথচ জলাবদ্ধতা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নাই- যেন এইটা তাদের কাজ না! অশিক্ষিত মূর্খ একেকটা সরকার আর তাদের গবেট পা চাটা সরকারি লোকগুলোর পাল্লায় পড়ে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে ভাবতে বসলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। হয়তোবা আজ থেকে আরো চল্লিশ বছর পর ইতিহাস বইয়ে লেখা থাকবে “দক্ষিন এশিয়ায় বাংলাদেশ নামে একটা দেশ ছিল যার অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে কেটেকুটে খেয়ে ফেলে পুরো বিলুপ্ত করে ফেলেছে”!

একজন মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

তখন ক্লাশ সিক্সে পড়ি, কিশোর বয়স। কমিক্সের পাশাপাশি তিনগোয়েন্দা পড়া শুরু করেছি মাত্র। একদিন ক্লাশে মুশফিকের কাছে একটা বই দেখলাম, নাম “দুষ্ট ছেলের দল”, লেখকের নাম পরিচিত জাফর ইকবাল! পরিচিত এই হিসেবে যে আমি জাফর ইকবাল কে চিনতাম, আসলে একজন জাফর ইকবালকেই আমি চিনতাম, সে লোক সিনেমার হিরো ছিলো! আমি তো অবাক, সিনেমার হিরোরা বই লিখতে পারে বলে আমার কোন ধারনা ছিলোনা, তাও আবার কিশোর উপন্যাস! মূশফিক জিজ্ঞেস করলো যে বইটা আমি পড়ব নাকি! আমি তখন কিশোরদের বই বলতে চিনি তিনগোয়েন্দা, গোয়েন্দা রাজু, ফেলুদা, শঙ্কু – এইসব। তখন আমার প্রিয় লেখক ছিল সত্যজিত রায় (এখনো আছে!)। সেই লোকের গল্প, উপন্যাস, ছড়া, আঁকাআঁকি- সবকিছুতেই আমি মুগ্ধ! তাই কোথাকার কোন সিনেমাওয়ালা বই লিখেছে, সেটা পড়ার কোন উৎসাহ আমার মধ্যে হলনা। আমি না বলে দিলাম। মুশফিক দমবার পাত্র না, সে বুঝাতে লাগলো এই লোক হুমায়ুন আহমেদের আপন ভাই। হুমায়ুন আহমেদকে সবাই খুব পছন্দ করলেও কেন জানি আমি পছন্দ করিনা, আমার মতে তার সবচেয়ে দারুন সৃষ্টি হচ্ছে “বোতল ভূত” (যে বইটা পড়ে আমি হোমিওপ্যাথিকের শিশিতে কাগজ পোড়ানো ধোঁয়া ভরে সত্যি সত্যি পকেটে ভরে হাঁটতাম)। তাই হুমায়ুন আহমেদের ভাই শুনে মনটা আরো দমে গেল!

মাসখানেক পরের কথা। ছোটবেলায় চিটাগাং নিউমার্কেটে গেলে মিনিমাম একটা বই কেনা ছিল আমার রুটিন ওয়ার্ক। আম্মুর সাথে নিউমার্কেট গিয়ে সেই রুটিন কাজের অংশ হিসেবে বইয়ের দোকানের সামনে যখন গেলাম তখন দেখি দোকানি “দুষ্ট ছেলের দল” ঝুলিয়ে রেখেছে। কী মনে হল কে জানে, ঐ বইটা কিনে ফেললাম। বাসায় আসার পর যখন বইটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললাম তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় আরেকটা নতুন নাম ঢুকে পড়েছে – মুহম্মদ জাফর ইকবাল!

Continue reading একজন মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

ভিজিটিং কার্ড

খুব ছোটবেলাতে দেখতাম বড় বড় মানুষেরা কথায় কথায় নিজেদের মধ্যে একটুকরা কাগজ চালাচালি করেসেই কাগজে মানুষটার নাম, অফিসের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার থাকতযাকে দিচ্ছে সে আবার খুব যত্ন করে সেই কাগজ তার মানি ব্যাগে রেখে দিচ্ছে। আরো পরে ঐ টুকরা কাগজের নাম জানলাম, একে বলা হয় ভিজিটিং কার্ড বড় বড় মানুষেরা তাদের পরিচয় অন্যদের দেবার জন্য এই সব কার্ড ব্যবহার করে। আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একটা ফোন নাম্বার দিতে কত ঝক্কি পোহাতে হত। তখন তো আর মোবাইল ছিলনা, ফোন নাম্বার দিতে হলে সেটা কাগজে লিখে দেবার নিয়ম, লিখার জন্য তাই কাগজের খোঁজ পড়ে যেত। যখন কারো কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে একটুকরো কাগজ পাওয়া গেলো তখন দেখা গেলো কলম নাই! এইবার আবার কলম খোঁজার ধুমঅনেক্ষন পর কলমও হয়ত একটা পাওয়া গেল। তারপর লিখে দিতে হত ফোন নম্বর। এই সময় পাশ দিয়ে হয়তো আরেক জন যাচ্ছে, হঠাৎ থেমে হয়ত জিজ্ঞেস করলো আরে এইটা আপনার নাম্বার? আমাকেও একটু লিখে দিয়েন তো। কি আর করা! আবার কাগজের খোঁজ কর, কলম খোঁজ, তারপর লিখ। কপাল খারাপ থাকলে হয়তো আরো একজন এসে চাইবে। অথচ যাদের কার্ড আছে তাদের ঐ ভেজাল নাই। খালি হাসিমুখে একটা কার্ড বের করে দিলেই হল। আহা কী সুখ! তাদের এই সুখ আমাকেও পেয়ে বসল। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম কবে কবে আমি বড় হব, কবে আমার ভিজিটিং কার্ড হবে।

Continue reading ভিজিটিং কার্ড

রঙ্গীন দুনিয়া – ৭

শীত কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি?

প্রথম ধাক্কায় এইটা বলে নেয়া ভালো এইবার উইন্টারে নেদারল্যান্ডসে গত চৌদ্দ বছরের সবচেয়ে ঠান্ডা পড়লো। রাতের বেলা হেগ শহরে টেম্পারেচার মাইনাস পনেরতে গিয়ে ঠেকত। সাগরের পাশে থাকাতে হেগে ঠান্ডা কম ছিল, অন্যান্য জায়গায় তাপমাত্রা মাইনাস বিশের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো! ঠান্ডায় আমি কি কাবু হব, ডাচ লোকেরাই কাবু হয়ে গেছে! রাস্তায় সবাই বস্তা (ঠান্ডায় যে পরিমান কাপড়চোপড় পড়া হয় সেগুলাকে বস্তা বললে খুব একটা ভুল হবেনা) পড়ে ঘোরাঘুরি করছে, এইটা এদের কাছেও অপরিচিত দৃশ্য। তবে তুষার একেবারেই পড়েনি। এখন পর্যন্ত মাত্র তিন দিন তুষার পড়েছে তাও যেটা সবচেয়ে বেশীক্ষন পড়েছিলো সেটার স্থায়ীত্বকাল ছিল টেনেটুনে চার ঘন্টা!

শীতের দিনে সবচেয়ে যেটা কষ্টের সেটা হল ঘড়ির কাঁটা বলে সকাল আটটা কিন্তু ঘরের বাইরে জমাট অন্ধকার! সূর্য উঠতে উঠতে সকাল নয়টা। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে সাড়ে দশটায় ক্লাস শেষ করে প্রফেসর আমাদের গুড মর্নিং জানিয়ে চলে যান। আবার অন্যদিকে বিকেল চারটা বেজেছে কি বাজেনি সাথে সাথে চারদিকে ঝপাস করে অন্ধকার জেঁকে বসলো। রাতে আঁধারে বাসা ছাড়ি আবার রাতের আঁধারেই বাসায় ফিরি। কি কপাল!

তবে তুষার না পড়লেও বাড়ির পাশের খাল ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। শুধু বাসার পাশের খাল না, অন্যান্য সব খাল, লেক, নদীও ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে গিয়েছিলো। নেদারল্যান্ডসের সবগুলো খাল, লেক, নদী একটার সাথে আরেকটা কানেক্টেড। তাই কেউ ইচ্ছা করলেই যে কোন খালে নৌকা ভাসিয়েই যে কোন নদীতে গিয়ে হাজির হতে পারে। অবশ্য সেই জন্য রূট জানা চাই। তো শীতে যখন সব পানি জমে বরফ হয়ে গেলো, এইখানকার লোকজন তখন স্কেটিং করা শুরু করল। স্কেটিং করে তারা এক শহর থেকে আরেক শহরে হাজির হত, প্রত্যেক শহরের মাথায় আবার চেকপোস্ট টাইপের একটা পোস্ট বসানো হল, স্কেটিং করে একেকটা পোস্ট পার হলে সেই পোস্ট থেকে একটা সার্টিফিকেট মিলে যাতে লেখা থাকে যে ঐ সার্টিফিকেটের মালিক এই শহর স্কেটিং করে পার হয়েছে! এইভাবে সবাই চায় বেশি বেশি সার্টিফিকেট নেবার জন্য।

পাগল সব দেশেই থাকে। কোথাও একটা দুইটা আবার কোথাওবা দল বেঁধে – এই যা পার্থক্য! এইখানে ও সেরকম দলবদ্ধ পাগলের কমতি নাই, তবে একসাথে আমার দেখা সে পাগলদের সংখ্যাটা শতিনেকের কাছাকাছি। তো এই পাগলদের দেখা মিললো জানুয়ারির এগারো তারিখ স্ক্যাভেনিংখে। স্ক্যাভেনিংখ হল হেগের একটা বীচ, হেগের আরেকটা বীচের নাম কাইকডাউন। যাই হোক স্ক্যাভেনিংখে সব ধরনের সব বয়সের পাগল এক হল, সেসব পাগলদের উৎসাহ দিতে আরো অনেক পাতি-পাগল আসলো। ঠিক দুপুর বারটায় কনকনে শীতের মধ্যে পাগলরা সবাই জামা কাপড় খুলে বরফ শীতল সমুদ্রের পানিতে দিল দৌড়! পেছন থেকে পাতি পাগলেরা চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের শখ হল ঐ বরফ শীতল পানিতে সাঁতার কাটবে। এই কাজটা এরা প্রতিবছর জানুয়ারিতে করে থাকে!

Continue reading রঙ্গীন দুনিয়া – ৭