খুব ছোটবেলাতে দেখতাম বড় বড় মানুষেরা কথায় কথায় নিজেদের মধ্যে একটুকরা কাগজ চালাচালি করে। সেই কাগজে মানুষটার নাম, অফিসের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার থাকত। যাকে দিচ্ছে সে আবার খুব যত্ন করে সেই কাগজ তার মানি ব্যাগে রেখে দিচ্ছে। আরো পরে ঐ টুকরা কাগজের নাম জানলাম, একে বলা হয় “ভিজিটিং কার্ড”। বড় বড় মানুষেরা তাদের পরিচয় অন্যদের দেবার জন্য এই সব কার্ড ব্যবহার করে। আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একটা ফোন নাম্বার দিতে কত ঝক্কি পোহাতে হত। তখন তো আর মোবাইল ছিলনা, ফোন নাম্বার দিতে হলে সেটা কাগজে লিখে দেবার নিয়ম, লিখার জন্য তাই কাগজের খোঁজ পড়ে যেত। যখন কারো কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে একটুকরো কাগজ পাওয়া গেলো তখন দেখা গেলো কলম নাই! এইবার আবার কলম খোঁজার ধুম। অনেক্ষন পর কলমও হয়ত একটা পাওয়া গেল। তারপর লিখে দিতে হত ফোন নম্বর। এই সময় পাশ দিয়ে হয়তো আরেক জন যাচ্ছে, হঠাৎ থেমে হয়ত জিজ্ঞেস করলো আরে এইটা আপনার নাম্বার? আমাকেও একটু লিখে দিয়েন তো। কি আর করা! আবার কাগজের খোঁজ কর, কলম খোঁজ, তারপর লিখ। কপাল খারাপ থাকলে হয়তো আরো একজন এসে চাইবে। অথচ যাদের “কার্ড” আছে তাদের ঐ ভেজাল নাই। খালি হাসিমুখে একটা কার্ড বের করে দিলেই হল। আহা কী সুখ! তাদের এই সুখ আমাকেও পেয়ে বসল। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম কবে কবে আমি বড় হব, কবে আমার ভিজিটিং কার্ড হবে।
জীবনের প্রথম মানিব্যাগ পাই ক্লাস থ্রিতে থাকা অবস্থায়, ঈদের সালামী রাখার জন্য! সেই সময় আমার মানিব্যাগে টাকা থাকুক আর না থাকুক চেনা-অচেনা বিভিন্ন লোকজনের গোটাকয়েক ভিজিটিং কার্ড সবসময় থাকত। দেখা গেল আব্বা হয়ত তার মানিব্যাগ থেকে একগাদা কার্ড ফেলে দিচ্ছে, আমি সেগুলো আব্বার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে নিজের মানিব্যাগে ঢুকাচ্ছি। এই ভাবে ছোটবেলায় আমার কার্ডের বিশাল সংগ্রহ ছিল।
তাই মিস্ত্রীগিরি পাশ করার পর যখন এক পাঠশালায় মিস্তিরি বানাবার কারিগর হিসেবে আমার ঠাঁই হল, তখন থেকেই নিজের একখান কার্ড বানাবার জন্য মন উচাটন শুরু হয়ে গেল। আমার সহপাঠী মিস্তিরীরা তখন দেশের বিখ্যাত বিদেশী মোবাইল কোম্পানীগুলাতে চাকরী করে। ওদের দেখতাম অফিস থেকে বিজনেস কার্ড দিত (সেই সময় ওদের কারো সামনে পড়লেই একটা করে কার্ড ধরিয়ে দিত, অনেকে আবার একই কার্ড অনেকবার ধরিয়ে দিত)। আমিও ধরে রাখলাম আমাকেও বোধহয় পাঠশালা থেকে কার্ড দিবে। কিন্তু স্বনামধন্য ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখলাম আমার মত সামান্য মানুষের দিকে নজর দেবার কোন সময় নাই। তাহলে কি আমাকে সারা জীবন ভিজিটিং কার্ডের বদলে আইডি কার্ড (আইডি কার্ডেরও আবার আরেক কাহিনী আছে) দেখিয়ে যেতে হবে? কাভি নেহি, এইটা তো হতে পারেনা। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে আমার কলিগ যাদের ভিজিটিং কার্ড ছিল তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম যে কার্ড পাবার প্রসিডিউর কি। ঐ লোকতো শুনে হেসে গড়াগড়ি। বলে, মাথা খারাপ নাকি এই ভার্সিটি তোমাকে দিবে কার্ড! নিজের টা নিজেকে করে নিতে হবে। আমি দমে যাবার পাত্র না, নিজের কার্ড নিজে করার ধান্দায় লেগে গেলাম। খুঁজে খুঁজে আজিজ সুপার মার্কেটের এক কার্ডের দোকান থেকে নিজের ডিজাইন করা চার রঙ্গা কার্ড বানালাম ঠিক ছয়শটা! মাতব্বরি করে ফটোশপে একটা রঙতুলির এফেক্ট দিয়েছিলাম কার্ডটাতে (আর্টিস্টিক আর্টিস্টিক ভাব আনার জন্য আরকি)। পরে ছাপানোর পর দেখা গেলো ঐ এফেক্টটাকে মনে হচ্ছে যেন ভুল করে কেউ এক ফোঁটা রঙ কার্ডের উপর ফেলে দিয়েছে। কেউ আমার কার্ডটা দেখে প্রথম যেই কথাটা বলত সেটা হল কোনখান থেকে বানিয়েছ এটা? আনাড়ি কাজ, ঠিকমত ছাপাতে পারেনি, কালি লেপ্টে ফেলেছে। আমি দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলি- আমার এত শখের আর্টিস্টিক ব্যাপারটা কেউ ধরতে পারলোনা!
এরপর শুরু হল আমার কার্ড বিলি করার পালা! সামনে যাকেই পেতাম তাকেই ভাবের সাথে একটা করে কার্ড ধরিয়ে দিতাম। অনেককে আবার একাধিকবার কার্ডও দিতাম। অবস্থা এমন হল যে আমাকে মানিব্যাগ থেকে কার্ড বের করতে দেখলেই অনেকে বলে উঠত- আরে ঐ কার্ড আমার কাছে অনেক গুলা আছে, প্লিজ আর না! আমার কার্ডের জ্বালায় লোকজন একেবারে অতিষ্ট। এভাবে বিলাতে বিলাতে প্রথম মাসেই কার্ড বিলানোর সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে গেল। পরের একশ পার করতে মাস তিনেক লেগেছিলো। তারপর কার্ড বিলানোর হার অনেক কমে গেল, কারন দেখা গেল পরিচিত সবার কাছেই আমার কার্ড আছে!
তবে সবচেয়ে মজার কার্ড ছিল আমাদের ব্যাচেলরের থিসিসের সুপারভাইজারের। সেই মানুষটার কার্ডের একপাশে নিজের নাম ধাম লিখে কুলাতো না, দুই পাশই ব্যবহার করতে হত। সারা জীবনে যা যা ছিলেন, যা যা করেছেন, তার পুরো একটা সামারী ছিল তার ঐ কার্ড। সেই কার্ড স্যাম্পল হিসেবে একটা রেখে দিয়েছি। এই রকম আজব জিনিস তো সহজে দেখা যায়না!
hmm prothom card pawar por amaro mone bapok uttejona hoichilo.tomar card ar pai nai karon mone hoi dekha hoi nai. so nijertao dite pari nai ;).
ho oi loker card amio ek piece sample hishabe raikha disi. kono logo ar baad rakhe nai 🙂
চিন্তা করিসনা… তোরটাও আমি পাইনাই 😀
হুমম… ঐ লোকের কার্ড আসলেই কালেকশনে রাখার মত আইটেম… 😆
আমি কবে বড় হব, আমার কবে কার্ড হবে।
আমার কার্ড নাই কিন্ত আমার আইডি কার্ডের অনেক নাম। আইন সংস্থার লোক ভুল করে ধরলেও ছেড়ে দেয়. হিহহিহিহি
মজা পেলাম লেখাগুলো পড়ে।