বহুদিন ধরে লেখা হয়না। অনেকগুলো কারনের মধ্যে প্রধান কারন হচ্ছে ফাঁকিবাজী। ইদানিং সবকিছুতেই ফাঁকিবাজী করতে ইচ্ছে করে। আমার ইংলিশ ব্লগটা আপডেট করিনা, ফেসবুকে বন্ধুদের ওয়ালে লিখিনা, একেরপর এক এসাইনমেন্ট বাকী পড়ছে, পরীক্ষার পড়া জমে উঠেছে – সবকিছুতেই ফাঁকি দিচ্ছি। মাঝখানে ওয়াটারলু, বেলজিয়াম আর ট্যাসেলে গিয়েছিলাম, ফাঁকিবাজীর ঠ্যালায় পড়ে সেইগুলা কিছুই লেখা হয়নাই। গত সপ্তাহে হঠাৎ করে জার্মানি গেলাম। এই জায়গাতেও ফাঁকি মারতে ইচ্ছা করছিল, তারপর কী যেন মনে করে লিখতে ইচ্ছা করল। তাই ল্যাপিটাকে কোলের উপর নিয়ে বসে লিখতে শুরু করলাম।
প্রথমেই জানতে হবে জার্মানি যাবার কেন ঠ্যাকা পড়লো। মামীর এক আপা সম্পর্কীয় আত্মীয় জার্মানীতে তার ছেলের বাসায় এসেছে। সেই মহিলার হঠাৎ করেই মামীকে দেখবার খায়েশ হলো (সেই সাথে হল্যান্ড আসার খায়েশও ছিল), সেই খায়েশ পূরণ করতে জার্মানী যেতে হবে। প্ল্যান মোতাবেক, মামীরা প্রথমে জার্মানি যাবে তারপর ছেলেসহ আপাকে হল্যান্ডে আনা হবে- পুরোটাই হবে একটা রোডট্রিপ! যেহেতু রোডট্রিপ সেহেতু পুরাপুরি নেভিগেটরের উপর নির্ভর করতে হবে, যেহেতু নেভিগেটরের উপর নির্ভর করতে হবে সেহেতু মামীর চেয়ে আমি বেশি রিলায়েবল (মামী আবার টেকনোসাইডে কিঞ্চিত কচি-কাঁচা), যেহেতু আমি বেশি রিলায়েবল সেহেতু মামা আমাকে নিবেই নিবে, যেহেতু আমাকে নিবেই নিবে সেহেতু আমার না গিয়ে কোন গতি নাই, যেহেতু আমার না গিয়ে কোন গতি নাই সেহেতু যাবার আগের দিন রাতের বেলা ঠিকানা নিয়ে নেভিগেটর সেট করতে বসলাম। ঠিকানা বলছে জার্মানির উল্ম শহরে যেতে হবে, নেভিগেটরে ঠিকানা ঢুকানোর পর দেখি ডিস্ট্যান্স দেখাচ্ছে ৭১৬ কিমি! বিশাল ড্রাইভিং ডিস্ট্যান্স! প্রায় তিনবার ঢাকা-চিটাগাং আসা যাওয়া করা যাবে। অবশ্য সেই তুলনায় সময় কম লাগবে, একটানা যেতে পারলে নেভিগেটরের হিসাব অনুযায়ী ছয় ঘন্টায় যাওয়া সম্ভব। ইউরোপীয়ান রাস্তা বলে কথা!
রাতে জার্মানী থেকে খবর আসলো, আন্টির (মামীর বোন হলে আমার নির্ঘাৎ আন্টি!) পান লাগবে! জার্মানীতে পান জিনিসটা নাই। ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও পান জিনিসটা পাওয়া যায় বলে জানতামনা। আন্টি নাকি বেশ পান-পিয়াসী, কিন্তু জর্ম্মন দেশে আসার পর থেকে আর পান পায়না, উপরি পাওনা হিসেবে ইউরোপীয়ান খাবার খেতে হয় (বোনাস হিসেবে উনি জার্মান পুত্রবধূ অর্জন করেছেন কিনা!), তার মুখ নাকি পুরা বিস্বাদ হয়ে গেছে। স্বাদ ফিরিয়ে আনতে তার দরকার পান! এই ইউরোপের এক ইংল্যান্ড ছাড়া আর কোন জায়গার নাম মাথায় আসলোনা যেখানে পান পাওয়া যেতে পারে। এ্যামস্টারড্যামে পাওয়া গেলেও যেতে পারে – চান্স কম। মামা বেশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় গেল!
সকালবেলা আটটার দিকে আমাদের জার্নি শুরু হল। প্রথমে গেলাম এক ইন্ডিয়ান দোকানে – যদি পান পাওয়া যায়! কপাল খারাপ – ওদের কাছে পান নাই। তবে ওরা এক তুর্কী দোকান দেখিয়ে দিল যেখানে পাওয়া হয়তো যেতে পারে। মামা-ভাগ্নে মিলে গেলাম সেই দোকানে। কাউন্টারে এক ভূঁড়িওয়ালা তুর্কি বীর বসে হাই তুলছে – সম্ভবত রাতে ঘুম ঠিকমত হয়নাই। সেই লোকরে পানের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে টের পেলাম পানের ইংলিশ আমরা কেউই জানিনা, তার উপর আবার সেই তুর্কীর ইংলিশ জ্ঞানও অসাধারন! কি আর করা আকারে ইঙ্গিতে বুঝায় বললাম “জায়ান্ট ইন্ডিয়ান লীফ” যেইটা আবার “ফ্ল্যাট”! তুর্কী বীর পুরোপুরি বিভ্রান্ত – “ফ্ল্যাট লীফ” আবার কি জিনিস, সব লীফই তো ফ্ল্যাট। বেচারা লাল শাক আনে, পালং শাক আনে, আরো হাবিজাবি কত “লীফ” আনে কিন্তু পান আর আনেনা। কী আর করা দোকান থেকে বের হয়ে দেখি এক সুরিনামী দোকান। পানের আশায় সেই দোকানেও ঢুকলাম, আর কী আশ্চর্য সামনেই প্যাকেট প্যাকেট পান সাজিয়ে রাখা! দু’খান প্যাকেট চটপট নিয়ে ফেললাম। দাম জিজ্ঞেস করে দেখা গেল প্রতি বিশটা পানের দাম চব্বিশ ইউরো মানে প্রায় দু’হাজার টাকা – মানে পানপ্রতি একশ টাকা!
যাই হোক মিশন পান একমপ্লিশ করে আবার রওনা দিলাম। এবার গন্তব্য জার্মানী। প্রায় দেড় ঘন্টা হয়ে গেল, গাড়ি একটানা চালিয়ে মাম ক্লান্ত। সামনের এক পেট্রল স্টেশনে থেমে গাড়ির পেট ভরা হল সেই সঙ্গে আমাদেরও পেট খালি করে ভর্তি করে নিলাম। আবার রওনা দিলাম। নেদারল্যান্ডের হাইওয়েতে সর্বোচ্চ স্পীড হচ্ছে ১২০ কিমি/ঘন্টা। মামা ১২০ এই চালাচ্ছিল। হঠাৎ দেখি পিছন থেকে একের পর এক গাড়ি ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে, কাহিনী কি! আমরা কি তাহলে কম স্পীডে যাচ্ছি? কিন্তু স্পিডোমিটারতো তা বলেনা। চোখ পড়লো রাস্তার ‘Exit’ সাইনের উপর। ডাচ ভাষায় ‘Exit’ সাইনবোর্ডটাতে লেখা থাকে ‘Uitgang’, সেটা পালটে এখন ‘Ausfahrt’ লেখা দেখাচ্ছে – তারমানে আমরা এখন জার্মানীতে! এই জন্যই আমরা বারবার পিছিয়ে পড়ছি কারন, জার্মানীর হাইওয়েতে কোন স্পীড লিমিট নাই! আহা রাস্তায় কী গাড়ির বাহার! একেবারে আনকোড়া নতুন মার্সিডিজ, ক্রাইসলার, অডি, বিএমডব্লিউ, ওপেল পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে – স্বপ্নের মত দৃশ্য। ডাচ লোকজন কিপটা হওয়াতে হল্যান্ডে এত আনকোড়া নতুন গাড়ি দেখা যায়না। এই কিপটা লোকজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফোর্ড, ভল্ভো, সিত্রঁ আর রেনল্টের উপর দিয়েই খায়েশ মেটায়।
হঠাৎ কোত্থেকে এক ভ্যান এসে সামনে পড়ল। ভ্যানের পেছনে ইলেক্ট্রনিক ডিস্পলে বোর্ডে লেখা উঠল “ফলো মি”! নিশ্চয়ই পুলিশ মামু! একপাশে গাড়ি পার্ক করতেই সামনের ভ্যান থেকে ইউনিফর্ম পড়া পাঁচজন মামু আর একজন মামী লাফ দিয়ে বের হয়ে আসলো। রুটিন চেকয়াপ করবে, হল্যান্ডের নাম্বার প্লেট দেখে গাড়ি থামিয়েছে। আমাদের আইডেন্টিটি কার্ড চেক করে হাই হ্যালো বলে ছেড়ে দিল। আবার যাত্রা শুরু হল। একটু পরেই শুরু হল পাহাড়ি এলাকা। সে কি দৃশ্য – পাহাড় ডিঙ্গিয়ে রাস্তা চলে গেছে, মাঝে মাঝে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে টানেল, পাশাপাশি রয়েছে ট্রেন লাইন! অসাধারন ব্যাপার – মনে হচ্ছে যেন রোলার কোস্টার চড়ছি। এরই মধ্যে দেখি পাশ দিয়ে ভুম ভুম আওয়াজ করে দুইখান পোর্শে যেন উড়ে গেল। আমাদের গাড়ির স্পিডের কাটা ছিল ১৬৫ এর মত, তাহলে ঐ দুইটা নিশ্চয়ই ২০০’র মত চলছিল! আমি তাই সবসময় বলি, সেই রকম গাড়ির মত গাড়ি কিনলে চালায়া মজা জার্মানীতে!
জার্মানীতে প্রথম ব্রেক নিয়ে এক পেট্রল স্টেশনের বাথরুমে ঢুকে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। জনপ্রতি পঞ্চাশ সেন্ট দিয়ে ঢুকতে হবে, মানে প্রায় পঞ্চাশ টাকা! হুলান্ট দেশে বাথরুম ফ্রী অফ চার্জ আর এই জর্ম্মন দেশে পয়সা দিয়ে ঢুকতে হয় – কী ক্যারদানী! কিন্তু আমারো ঠ্যাকা পড়ছে, টয়লেটে না গিয়ে উপায় নাই। কী আর করা গাঁটের টাকা খরচ করেই ঢুকলাম সেই বাথরুমে। ভাবলাম পয়সা খরচ করে ঢুকতে হল যখন টয়লেটটা দেখতে না জানি কেমন, নিশ্চয়ই টেকনিক্যাল ক্যারাব্যারায় ভর্তি; কোথায় কি – পুরাই নরমাল একটা টয়লেট, খামাখা এতগুলা টাকা নিসে ব্যাটারা।
প্রায় সাতখান ব্রেক নিয়ে অবশেষে বিকাল চারটায় আমরা উলমে গিয়ে পৌছালাম। ইউনিভার্সিটি আর পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গির্জার শহর এই উল্ম জার্মানীর একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে। এই শহর আইন্সটাইনের জন্ম শহর। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইউরোপখ্যাত দানিয়ুব নদী। আমার কাছে ইউরোপের সব শহরই দেখতে একই রকম লাগে, একই ধরনের রাস্তা, বাড়ি, গাছপালা। সিটি সেন্টারগুলোতে মনুমেন্টের ছড়াছড়ি, বেশিরভাগেরই আবার ভিতর থেকে পানির ফোয়ারা পড়ছে। যাই হোক, একসময় গিয়ে পৌছালাম সেই ভদ্রলোকের (উনি আবার সম্পর্কে আমার ভাই হন, যেহেতু মামীর আপার ছেলে) বাসায়। গিয়ে দেখি জার্মান ভাবী টেবিলে পোলাও সাজাচ্ছে আমাদের জন্য। কী আর করা সাজানো পোলাও তো ফেলে রাখা যায়না, অগত্যা খেতে বসতেই হল! ঐদিকে পান পেয়ে আন্টির মুখের হাসি আর ধরেনা, ভদ্রমহিলা সাথে সাথে কয়েক খিলি মুখে পুরে ফেললো!
খাওয়াদাওয়া করে বের হলাম শহর দেখতে। নামডাকের তুলনায় উল্ম অনেক ছোট শহর। মোটামুটি লাখখানেকের কিছু বেশি লোকের বাস এই শহরে। ইউরোপের আর সব শহরের মত এর সিটি সেন্টারও একই রকম- পাথরের রাস্তা, মনুমেন্টের ফোয়ারা, পুরানো দালান কোঠা। তবে একটা দিক থেকে অন্য রকম – দানিয়ুব নদীকে বিভিন্ন ছোট ছোট শাখা প্রশাখায় ভাগ করে শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করা হয়েছে, যার ফলে একে দেখতে অনেকটা ভেনিসের মত লাগে। ঠিক এই কারনে এখানকার লোকজন একে ‘লিটল ভেনিস’ বলে। সিটি সেন্টারের ঠিক মাঝেই হচ্ছে বিখ্যাত ‘উল্ম মিন্সটার’ বা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু চার্চ। চার্চ থেকে কিছুদূর গেলেই উল্মের সিটি কর্পোরেশনের খান্দানী পুরানো বিল্ডিং। আরো কিছুদূর এগোতেই সামনে পড়লো দানিয়ুব নদী। নদীর দুই পাশে প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু দেয়াল দেয়া। শহরের মধ্যে যেই জিনিসটা বেশি চোখে পড়ে সেইটা হল ‘উল্মার স্পাটয্’- একটা চড়ুই পাখির স্ট্যাচু। এই পাখি উল্ম শহরের প্রতীক। সূর্য ডুবে প্রায় রাত হয়ে গেল। পরদিন তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে তাই বাসার দিকে রওনা হলাম। আসার সময় পথের পাশে এক দূর্গের ওয়াচ টাওয়ার দেখতে গাড়ি রাখা হল। টাওয়ারের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঢুকতে গিয়ে নাকে ঝাঝালো গন্ধের ধাক্কা খেয়ে মনে হল যেন বাংলাদেশের পাব্লিক টয়লেটে ঢুকলাম! কে জানতো জার্মান পাব্লিকরা বাসা বাড়ি ফেলে এই টাওয়ারে ‘ছোট টয়লেট’ সারে। প্যাচানো সিড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে শুনি ফিসফিস শব্দ। কাহিনী কি! বাংলাদেশে কখনো ভূত দেখিনাই, শেষ পর্যন্ত জার্মান ভূত দেখতে হবে? ছাদের কাছে এসে সাবধানে মাথা তুলতে গিয়ে টকাস করে সিলিঙ্গে একটা বাড়ি খেলাম আর সাথে ফিসফিস শব্দ বন্ধ! ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখি আমার চেয়েও ভ্যাবচ্যাকা চোখে এক জুটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে – বাসা-বাড়ি ফেলে দিয়ে টাওয়ারের ছাদে প্রেম! এইটা কি বাংলাদেশ পাইসে নাকি? ওরা যা খুশি করুক আমি আমার মত টাওয়ারে উঠে রাতের উল্ম দেখতে লাগলাম। টাওয়ারের উপরে খানিকটা আবছা আলো ছিলো। সেই আলোতে দেখলাম দেয়ালে বিভিন্ন কালি দিয়ে লেখা ‘অমুক+তমুক’! আবার বঙ্গদেশের ঘ্রান – জার্মানদের দিয়ে সবই হয়!
জার্মানীতে একটা জিনিস ভীষন ভালো লাগলো – ঐখানে আমার নিজেকে অনেকদিন পর স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষ বলে মনে হল। হল্যান্ডের লোকজন বিচ্ছিরি ধরনের লম্বা হয়, এদের গড় হাইট থাকে ৬ ফুট! এরা জন্মের পর থেকে সাইকেল চালায় আর সাঁতার কাটে – এদের ছয়ফুট না হয়ে কোন উপায় নাই। এইসব ছ’ফুটিদের সাথে থাকতে থাকতে নিজেকে লিলিপুট মনে হত। জার্মানীতে এসে দেখি যে নাহ্ এরা আমার কাছাকাছি; আমার চেয়ে ছোট, আমার সমান, আমার চেয়ে বড় – সবধরনেরই আছে!