শেষ পোস্টের পর অনেককিছুই ঘটে গেছে আবার কিছুই ঘটেনাই! আমার জন্য যেগুলো অনেক কিছু অন্যদের জন্য হয়তো সেগুলো কিছুইনা! যাই হোক, সেসব জিনিসকে একসাথে ভরার চেষ্টা চালাচ্ছি এই পোস্টে। কতটুকু সম্ভব হবে জানিনা।
ইদুর
দেশে থাকতে ইদুর জিনিসটার সাথে তেমন একটা পরিচয় ছিলনা। মাঝে মাঝে বাসায় উৎপাত দেখা দিলে র্যাটম বা ঐ টাইপের কিছু একটা কিনে রাতে বাসায় ছড়িয়ে দিলেই কাহিনী শেষ হয়ে যেত, সকালে দেখা যেত কয়েকটা ইদুর বা চিকা প্রজাতির প্রাণী মরে পড়ে আছে। কিন্তু সুদূর হল্যান্ডে এসেও যে ইদুর বাবাজির খেল দেখতে হবে সেটা চিন্তা করিনাই। কাহিনীটা গত সামারের পরের ঘটনা, সেসময় কিছুদিন খালার বাসায় ছিলাম। তো বাসায় ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে ল্যাপিতে কাজ করছি, এমন সময় মনে হল জীবন্ত কিছু একটা আমার পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। কাহিনী কি! একটু এদিক সেদিক তাকালাম কিছু চোখে পড়লনা। মনের ভুল নাকি! আবার ল্যাপির দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ল দরজার কোনায়, দেখি একজোড়া কুঁতকুতে চোখ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কোন ইঁদুরের আমার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকার ঘটনা এই প্রথম!
যাই হোক ইঁদুর থাকা মানেই হল একে খতম করতে হবে। পরদিন থেকেই উঠে পড়ে লাগা হল ইঁদুরের পেছনে। আসমিতা রিপোর্ট করল নীচে বসার ঘরে দেখা গেছে বাবাজীকে। সাথে সাথে ড্রইংরুমের সব দরজা জানালা আটকে ঝাপিয়ে পড়া হল। হঠাৎ চোখ গেল এরিকের দিকে। ও দেখি একহাতে পিনাট বাটারের বৈয়াম আরেক হাতে চামচে পিনাট বাটার নিয়ে পজিশন নিচ্ছে। কাহিনী কি? পরে জানা গেল গুগুল বাবা নাকি ফর্মায়েছেন যে পিনাট বাটার আর চিজ ইঁদুর প্রজাতির অতি প্রিয় খাদ্য। তাই সেই প্রিয় খাদ্য নিয়ে লোভ দেখিয়ে ইঁদুর মারার ফন্দি করেছে এরিক বেচারা। ঐ দিন অবশ্য ইঁদুর নিধন প্রকল্প সফল হয় নাই, শুধু ঐ দিনই না এর পর যতবারই ইঁদুর মারতে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে কোনবারই আর সেটা সফল হয়নি। মাসখানেক পর মনের দুঃখে ইঁদুরটা বাসা ছেড়েই চলে গেল! এরপর থেকে আমরা আর তার লেজের টিকিটিও দেখিনি।
তবে আমরা ইঁদুর না মারতে পারলে কি হবে, বাংলাদেশের একজন ইঁদুর মেরে ঠিকই কিন্তু বিশ্বে নাম কামিয়ে ফেলেছেন! মোখায়রুল ইসলাম নামের এই কৃষক জানুয়রি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট তিরাশি হাজার চারশো পঞ্চাশটা ইঁদুর মেরে কৃষি বিভাগ থেকে পুরষ্কার হিসেবে রঙ্গীন টিভি তো পেয়েছেনই, সেই সাথে পেয়েছেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারনা। যুক্তরাজ্যের টাইমস অনলাইনে তাকে নিয়ে সংবাদও ছাপা হয়!
দুইটা ঈদ
ঈদ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করেনা। দেশের বাইরে ঈদ কাটানোটাকে মাঝে মাঝে বিশাল অভিশাপ বলে মনে হয়। পরিচিত গন্ডির বাইরে থাকা তো আছেই সাথে আছে ঈদের দিনে ঈদের আমেজটাকে মিস করা। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি যে ঈদ মানেই চারপাশে একটা খুশির আমেজ। আর এইখানে এসে বোঝাই যায়না যে আদৌ কোন ঈদ আছে কি না নাই! পুরাই ম্যাড়ম্যাড়ে একটা জীবন!
বরফ
নেদারল্যান্ডেসের গত পচিশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি তুষারপাত হল এবছর। শুধু নেদারল্যান্ডসই না পুরো ইউরোপ জুড়েই তুমুল তুষারপাত হল। চারদিক সাদায় ঢেকে গেল। সেই সাদায় ঢাকা ছিল টানা সপ্তাহখানেক। ডাচ সরকার রাস্তায় বরফ গলাবার জন্য লবন ছিটিয়ে কূল পাচ্ছেনা। এর মধ্যে আবার লবন গেছে শেষ হয়ে! পরে জার্মানী থেকে লবন আমদানী করে পরে রক্ষা। ঐদিকে রটরড্যাম বন্দরে জাহাজ চলতে পারছেনা, ফলে ডেনমার্ক না কোন দেশ থেকে বিশাল বিশাল আইসব্রেকার ভাড়া করে আনা হয়েছে। রাস্তায় বরফ সরানোর জন্যও অন্যদেশ থেকে গাড়ি আনা হয়েছে। এত বরফ কখনো পড়েনি তাই ডাচ সরকারেরও এইসব যন্ত্রপাতি ছিলনা। তবে ধবধবে সাদায় হাটতে বেশ ভালো লাগতো; নীচে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ডেবে যাওয়া বরফ, উপরে কটকটে নীল আকাশ, চারদিকে শান্ত সাদার প্রলেপ- অসাধারণ দৃশ্য ছিল! ওয়েবক্যামে দেশে ছোটবোনকে দেখালাম লাইভ বরফ পড়ার দৃশ্য। দেখে সে বেচারীও কম শিহরিত না।
বড়দিন ও নববর্ষ
এইবার বড়দিনে দাওয়াত ছিল এনেকে আর জুয়ারের বাসায়। দাওয়াত মানে সেই রকম দাওয়াত! একেবারে এলাহি খানাপিনা যাকে বলে! সব খাবারের আবার নাম ধামও জানিনা। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলেছে খাওয়া দাওয়া। শেষমেশ টেবিল ছেড়ে উঠতো পারিনা এই দশা! স্টার্টারই ছিল প্রায় পাঁচ পদের। তারপর মেইনডিশ ছিল তিনটা সংগে ছয়-সাতটা সাইড ডিশ, আর ডেজার্টও ছিল দুই রকমের। তবে এক জম্পেশ খাওয়া দিয়েছিলাম সেদিন। পরদিন নাস্তা তো নাস্তা, দুপুরের খাবারও খাইনি! পাল্টা দাওয়াত হিসেবে নববর্ষের আগের রাতে ওদের দাওয়াত ছিল আমাদের বাসায়। তবে এবার থার্টি ফার্স্টের সবচেয়ে মজা ছিল আতশবাজী পোড়ানো। গতবার অন্য পোড়ায় আর আমি ছঅগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত পিছে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে দেখতাম। এবার ডিসিশন নেয়া হল আমরাই পোড়াবো। আমরা মানে আমি আর এরিক। গেলাম দোকানে আতশবাজী কিনতে। গিয়ে তো চোখ ছানাবড়া! আতশবাজী আর মানুষে গিজ গিজ করছে পুরো দোকান! এত মানুষ আতশবাজী কিনতে আসে – ধারণা ছিলনা। আর আতশবাজীর কি বাহার! পেন্সিলের সমান সাইজ থেকে শুরু করে প্রায় প্রমাণ সাইজের আছে (যেগুলোকে আকড়ে ধরে চাঁদে না হলেও চাঁদের আশপাশে কোথাযও যাওয়া সম্ভব বলেই আমার ধারণা)। যাই হোক কিছু রকেট টাইপের জিনিস কেনা হল, যেগুলো প্রমাণ সাইজের না হলেও পেন্সিলের মত দৈন্য সাইজের না। থার্টি ফার্স্টে রাত বারটার সময় রকেট পোড়াবার সবকিছু প্রায় রেডি। লাইটার আনা হল, ওয়াইনের কাচের বড় ভারী বোতল আনা হল, সেটাতে পানি ভরে ওজন আরো বাড়ানো হল। এবার রাত বারটা বাজার পালা। রাত বারটা বাজতেই আমি আর এরিক বের হয়ে বাসার সামনের রাস্তায় দুটা বোতলফিট করে সেটাতে রকেট পুরে আগুন দিতে গিয়ে দেখি কোন সলতে টাইপের কিছু নাই! জীবনে প্রথমবার রকেটে আগুন দিব, সবসময় টিভি-সিনেমায় দেখে এসেছি লোকজন রকেটের পিছনে লম্বা ফিতার মত সলতেতে আগুন ধরায় তারপর দূরে গিয়ে দেখে। আর আমার এটাতে সলতে নাই! মাথা চুলকে এরিকের দিকে তাকাই, দেখি ওরও একই দশা, কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। কি মনে করে রকেটের পিছনের যে প্লাস্টিকের আবরণ ছিল সেটাতে লাইটার কিছুক্ষণ ধরে রাখলাম, হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই ফুসসস করে আগুন ধরে গেল। সাথে সাথে মাথায় কাজ করলো এইবার পিছে দৌড়াতে হবে। দৌড় দিতে গিয়ে মনে হল পৃথিবী যেন উল্টে গেল! কাহিনী কি ভুমিকম্প হল নাকি? বোঝার চেষ্টা করছি এমন সময় কাধে হাত পড়ল, সাথে জুয়ারের গলা – “আর ইউ ওকে?”। কিছুক্ষণ সময় লাগলো বুঝতে কি হল। পরে আবিষ্কার করলাম যে আমি হাতপা ছড়িয়ে মাটিতে বসে আছি। পিছনে ফিরে দৌড় দিতে গিয়েই যত বিপত্তি! ব্যালেন্স না রাখার ফলে এক্কেবারে পপাতধরণীতল! পড়ে গেছি সেটা ব্যাপারনা, কিন্তু রাস্তাভর্তি লোকের সামনে পড়ে গেছি সেটাতেই সমস্যা! যাইহোক শেষমেষ সবগুলো রকেটই সাফল্যের সাথে উৎক্ষেপণ করেছিলাম।
ডিএসএলআর
খুব শখ ছিল, নিজের একখান ক্যামেরার, তাও যেন তেন না, এসএলআর। ইউরোপের ইলেক্ট্রক্য়াল পণ্যের চেইন শপ মিডিয়ামার্কেটে দেখলাম ছাড় দিচ্ছে ক্যানোনের এসএলআরে। কয়েকদিন দেরী করে দেখলাম দাম আরো কমে কিনা। পরে যখন দেখলাম যে বেশি রিস্ক হয়ে যায়, তখন আর দেরি না করে ধা করে কিনতে গেলাম ক্যামেরা। গিয়ে শুনি ক্যামেরা নাকি শেষ! বলে কি! সেলসম্যানরে বললাম যে “দ্যাখো ভাই, একটু খুঁজে দ্যাখো। একটা পেয়ে যাবে।” সেলসম্যান বলে যে আর নাই শুধু ডিস্প্লেতে যেটা আছে সেটাই। ডিস্প্লে’র কথা শুনে পেটে পেটে ফিচলা বুদ্ধি আটতে থাকলাম, আঁটা শেষ হয়ে গেলে বললাম “দ্যাখো ব্রাদার, ডিস্প্লের এটাতো সবাই হাতদিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছে, তাই এক অর্থে এটা ইউজড মাল। তাই আমি এটাকে নিব কিন্তু আরো কম দামে!” সেলসম্যান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল এটা শুনে, কেউ এভাবে কম দামে চাইতে পারে এটা ওর মাথাতেই আসেনাই। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করলে, “তুমি জোক করছো?”। আমি সিরিয়াসভাবে বললাম “মোটেই না, আমি কেন ইউজড জিনিস প্যাকেট করা জিনিসের সমান টাকা দিয়ে কিনব?”। এইবার বেচারার বোধোদয় হল। ধাঁ করে দৌড় দিল আরেক সহকর্মীর দিকে, দুজনে কি যেন আলোচনা করল, তারপর ফিরে এসে বলল ওদের গোডাউনে সম্ভবত কয়েকটা স্টক আছে, গাড়ি গিয়েছে আনতে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ফান্দে পড়লো তাইলে, নতুন মাল না দিয়ে কই যাবে। শেষপর্যন্ত ওরা আনলো, তারপর কিনলাম, এতে করে আল্লাহর রহমতে নিজের একটা শখ পূরণ হল, ফলে একটা ডিএসএলআর এর মালিক হয়ে গেলাম!
এই প্রাবাসের জীবন আমাদের, অনেকটা মিল পাচ্ছি নিজের সাথে, যেমন ইউরোপের তুষারপাত, ইতালীতেও এ বছর অনেক তুষারপাত হচ্ছে। ঈদের কথা আপনার মতো আমার ও বলতে ইচ্ছে করে না। ঈদ তো ভাই আর আমাদের জন্য না। ঈদ এলে খুবই খারাপ লাগে।
ভাল লাগলো আপনার রঙ্গীন দুনিয়া পড়ে।
প্রবাস জীবন মনে হয় ঘুরে ফিরে সবারই একই রকম হয়ে থাকে… কিছু আনন্দ… কিছু দুঃখ… এইতো!
প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা নেই, তাই বুঝতে পারি না। তানিম ভাইয়ের রঙ্গীন দুনিয়া পড়ে কিছু স্বাদ গ্রহণ করলাম। খুব ভাল লাগল ।
ভাই নিউ অর্লিন্সেতো তুষারপাত হয় না,তবে বৃষ্টি পড়ে…তখন দেশের কথা খুব মনে পড়ে।আর ঈদের সময়ে হয়ত সব প্রবাসীদের মনের অবস্থা একই রকম থাকে।তবে থ্যাঙ্কসগিভিং,বড়দিন,নববর্ষ এগুলো সময় আসলেই বেশ মজা হয়।
আপনার লেখাটা পড়ে অনেক ভাল লাগলো।
সেসবে মজা অবশ্য হয়। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে ঈদের যেই মজা সেটা আর কোন কিছুর সাথে তুলনা করতে রাজী না আমি! 😛
আপনার অভিজ্ঞতাগুলো শুনে যানপরানই মজা পেলাম। 🙂