আমরা সবাই রকি!

রকিকে (এঁই রঁকি) চেনেনা অথচ ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আইইউটিতে ছিল এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। যারা আইইউটিতে থাকতো না তারাও রকি’র বিভিন্ন কীর্তির সাথে কমবেশি পরিচিত। আজকের এই লেখাটা রকি কে নিয়ে। যারা রকি’র সাথে পরিচিত না তাদের জন্য সাবধানবাণী “রকিকে বেশি জানতে নেই, বেশি জানতে গেলে নিজেই রঁকিতে পরিনত হবার সম্ভাবনা প্রবল।” আর রঁকিতে পরিনত হলে জীবন কেমন ঝুঁকিময় হতে পারে তার অতি ক্ষুদ্র একটা উদাহরন এই লেখাটা!


আমাদের আইইউটিতে অন্যতম মজার আড্ডাটা হয় রাতের বেলায়, রাত বলতে আমি আসলে মাঝরাতের পরের সময়কে বুঝাচ্ছি। আইইউটিতে রাত শুরুই হয় ঠিক মাঝরাতের পর। সেই আড্ডার পরিধি প্রায়ই আইইউটি পার হয়ে পাশের হোটেলগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। তো মাঝ রাতের পর হোটেলে গিয়ে পরোটা-ভাজি খাওয়াটা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে তখন। হঠাৎ আমাদের হ্ল প্রভোস্ট নতুন নিয়ম করলেন। রাত দশটার পর বাইরে যাওয়া বন্ধ। কেউ যদি যেতে চায় তবে গেইটের সিকিউরিটি মামাদের কাছে নাম-ধাম লিখে বাইরে যেতে হবে। নতুন নিয়ম হজম করাটা আমাদের জন্য বেশ কষ্টের। আগেই বলেছি, বাইরে খেতে যাওয়াটা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। একেতো বাঙ্গালী তার উপর আবার আইইউটিয়ান। আমাদের অভ্যাস পরিবর্তন করার চেয়ে বরং ক্যালকুলেটর দিয়ে সুপার কম্পিউটার এর কাজ করা অনেক সহজ। উপায় একটা বের করতেই হবে। যাই হোক যথারীতি রাতের বেলা গেলাম গেইটের কাছে। এখন বের হবার পালা। দেখলাম মামা আমাদের দিকে একটা খাতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সেই রেজিস্ট্রি খাতা যার মধ্যে নাম, স্টুডেন্ট আইডি, রুম নম্বর, বের হবার সময়, ঢোকার সময় এইসব হাবিজাবি লিখতে হবে। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিলো, যদি বাইরে কোন ঝামেলা হয় তাহলে তো নাটস্‌ এন্ড পাটস্‌ (আমাদের দুই হল প্রভোস্ট) পুরা ধুয়ে ফেলবে। কী করা যায়! যেভাবেই হক নিজেদের নাম দেয়া যাবেনা। সাথে ছিল দিপু। বুদ্ধি করলাম যে নিজেদের নাম না দিয়ে বরং রকি’র নাম দিই। এতে ঝামেলা বলতে গেলে একদমই নাই। তো গেলাম রেজিস্ট্রি খাতায় রকির প্রক্সি দিতে। নাম লিখতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হবার দশা। আমার আগেই রকি কমপক্ষে বিশবার এই গেইট দিয়ে আসাযাওয়া করেছে, অন্তত রেজিস্ট্রি খাতা তাই বলে। রেজিস্ট্রি খাতার এক পৃষ্ঠাতেই প্রায় বিশবার রকির নাম লেখা, যদিও হাতের লেখা বিশ রকমের! বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই বোঝার কথা, আমাদের বুদ্ধি অনেক আগেই অন্য পোলাপান আবিষ্কার করে ফেলেছে!

এই আইন যতদিন ছিলো ততদিন রকি ছিলো রেজিস্ট্রি খাতার হিট সেলিব্রিটি আইটেম। কী সিনিয়র কী জুনিয়র, সবাই তখন রকির ভক্ত। এই ভক্তদের বাঁধভাঙ্গা আবেগের সাক্ষী ছিলো ওই রেজিস্ট্রি খাতা। তাদের কল্যাণে প্রতিরাতেই রকির অজস্রবার আগমন-নির্গমন নিয়মিত ঘটনায় পরিনত হলো। রকির এই হিট ইমেজ ফ্লপ করতেই কিনা কে জানে বেশিদিন এই আইন টিকে নাই। তবে এইটা ঠিক যে এই আইন আমাদের সবাইকে আর কিছু না হোক, রকির কাতারে নিয়ে এসেছিলো! আমার সন্দেহ হয় রকি মনে হয় ওর ভক্তকূলের উন্মাদনার কিছুই জানেনা। এই লেখা পড়ে ও যদি কিছু জানে!

ভূত ভূতং ভূতঔ

ঘটনার শুরু আইইউটি’র সাউথ হলের ৫২১ নম্বর রুমে। এক সন্ধ্যায় শাদিদ গল্পটা যখন বলা শুরু করলো তখন শ্রোতা কেবল আমি, দিপু আর মিফতাহ্‌; ৫২১ এর ত্রিরত্ন। গল্পটার কাহিনী অনেকটা এইরকম ছিল,“…রাতের বেলায় এক লোক পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি পড়ছিলো। কিছুদুর যাবার পর সে একটা গাড়িকে রাস্তায় মুখ থুবরে পড়ে থাকতে দেখলো। সাহস করে কাছে গিয়ে সে দেখল এক মহিলার লাশ গাড়িতে পড়ে আছে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, মহিলার পুরো শরীর ভর্তি গহনা! কেউ সেগুলোতে হাত দেয়নি পর্যন্ত। লোকটার মাথায় লোভ মাথাচাড়া দিয়ে ঊঠলো। সে একে একে সব গহনা খুলে নিলো। ঝামেলা বাঁধালো মহিলার ডান হাতের অনামিকার একটা আঙটি। কিছুতেই খুলা যাচ্ছেনা সেটা। লোকটাও ছাড়বার পাত্র নয়। সে পরে সেই অনামিকা কেটে আংটিটা নিয়ে যায়। … বিশ বছর পরের কথা… লোকটা এখন বিশাল বড়লোক। এক বৃষ্টির রাতে সে আবার সেই পথ দিয়ে আসছিলো। হঠাৎ গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। কাছাকাছি এক কুঁড়েতে সে গেলো পানি চাইতে। এক মহিলা ছিল সেই কূঁড়েতে। লোকটা পানি চাইলে সে ভেতর থেকে এক গ্লাস পানি এনে দিল। লোকটা তখন মহিলাকে বিশ বছর আগের সেই কাহিনী বলা শুরু করে। কাহিনী শেষ হলে মহিলা হঠাৎ করে তার ডান হাত বাড়িয়ে দেয় লোকটার দিকে, লোকটা আতংকের সাথে দেখলো মহিলাটার ডান হাতের অনামিকাটা কাটা…” – এটুকু বলে শাদিদ হঠাৎ অনামিকাটা ভাঁজ করে ওর ডান হাত বাড়িয়ে দেয় । এইরকম একটা ভয়ের গল্প শুনার সাথে সাথে এইরকম আচমকা ডান হাত বাড়িয়ে দেয়ায় আমাদের কলিজা পুরা ঠান্ডা হয়ে গেল। ভয় কাকে বলে টের পেয়েছিলাম সেইরাতে।

যাই হোক নিজেরা ভয় পেয়েছি ভালো কথা, তবে পোলাপানদের ভয় দেখানোর একটা উপায়তো পাওয়া গেল!


সাউথ হল, রুম নম্বর ৫১৩। এই রুমের অধিবাসী রাতুল, সাদাত আর আতিক। টার্গেট করলাম সাদাতকে ভয় দেখাব এই গল্পটা বলে। গেলাম ওদের রুমে। রাতুল ছিলনা। আতিক আর সাদাতকে পেলাম। সব আলো নিভিয়ে দিয়ে গল্পের আসর জমিয়ে ফেললাম। গল্প প্রায় শেষ পর্যায়ে… আচমকা ডান হাত বাড়িয়ে দেয়ার সময় আসলো… সাদাতের দিকে বাড়িয়েও দিলাম… কিন্তু এরপর যা ঘটলো তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ খাট থেকে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ পেলাম। আমি আর সাদাত দুজনেই মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম আতিক ভয় পেয়ে পড়ে গেছে। গল্পটা রঙ নাম্বারে চলে গেছে!

আলো জ্বালানো হলো। আতিককে শান্ত করা হলো। বেচারার বুকের ধুকপুকানি তখনো কমেনি। সাদাত বললো ও এই গল্পটা অন্যভাবে শুনেছে। শেষ অংশে নাকি বক্তা নিজের ডান হাত হঠাৎ বাড়িয়ে দিয়ে শ্রোতাকে বলে, “তুই এজন্য দায়ী!” বলতে বলতে সাদাত ব্যাপারটা করেও দেখাল। সে একটু বেশিই জোরে বলে উঠেছিল, কারন সাথে সাথেই আবার ধপ্‌ একটা আওয়াজ। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম আতিক ওর জায়গায় নাই, চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে!


সাউথ হল, রুম নম্বর ৫২১। নিজের রুমে এসে দিপু আর মিফতাহ্কে ৫১৩ তে ঘটে যাওয়া কাহিনী বলছি। এমন সময় দরজায় কেউ নক্‌ করল। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই ওপাশ থেকে কেউ চিৎকার করে বলে ঊঠলো, “তুই এজন্য দায়ী!” … কাজটা আতিকের। হঠাৎ বলে উঠায় ভয়ানক চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু চেহারা ভাবলেষহীন রেখে ওকে আমার চমকানোটা বুঝতে দেইনি। যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরেই ওকে বললাম, “কী ব্যাপার আতিক?” আতিক বেশ অবাক! আমি ভয়-টয় কিছু পাইনাই। বেচারা এসেছিল প্রতিশোধ নিতে। এমন সময় আমার পিছন থেকে আচমকা দিপু এসে আতিকের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে বললো, “তুই এজন্য দায়ী!” আমার চোখের সামনে আতিককে তৃতীয়বারের মতো ফ্ল্যাট হতে দেখলাম… তবে এবার ব্যালকনিতে!

শুভ নববর্ষ ১৪১৫

নিশি অবসান প্রায় ঐ পুরাতন বর্ষ হয় গত

আমি আজি ধূলিতলে জীর্ণ জীবন করিলাম নত ।।

বন্ধু হও শত্রু হও যেখানে যে রও

ক্ষমা কর আজিকার মত

পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।।

-রবি ঠাকুর

সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা… শুভ পহেলা বৈশাখ ১৪১৫।।