খুব ছোট থাকতেই আমার ছবি আঁকার শখ। বাসার দেয়াল থেকে মেঝে সব জায়গাতেই আমার প্রতিভার ঝলক থাকত। আমি ছবি আঁকতাম আমার মত করে। কে কি ভাবলো সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নাই। এই না মাথা ঘামানো অভ্যাসটা কেজি ওয়ানে আমার জীবনের প্রথম ড্রইং পরীক্ষায় ফেল করতে টনিকের মত কাজ করেছিলো। আমার পুরো স্কুল জীবনে ওই একটা বিষয়েই আমি ফেল করেছিলাম।
স্কুলে যাবার আগে থেকেই আমি ছবি আঁকতাম। স্কুলে ভর্তি হবার পর দেখলাম ড্রইং নামে আলাদা একটা সাবজেক্ট আছে। আমাকে আর পায় কে? মনের মত ছবি আঁকতাম। ক্লাসে সবাই আমার ছবির খুব প্রশংসা করত। কেবল একজন ছাড়া, আমাদের ড্রইং টীচার। সেই মহিলার কাছে আমার সব ছবিই কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং! ক্লাসে যাইই আঁকি না কেন সেই টীচার আমার সব কিছুতেই ভুল ধরেন। হাতি আঁকতে দিলেন, এঁকে দিলাম। কিন্তু টীচারের পছন্দ না। আমার আঁকা হাতির শুঁড় নাকি স্প্রিংয়ের মত প্যাচানো। হাতির এত বড় একটা শুঁড়, ওইটা কি হাতি সোজা ঝুলিয়ে রাখবে? এত সুন্দর একটা লকলকে জিনিস আমার থাকলে আমিও তো প্যাঁচিয়ে রাখতাম। মানুষের হাত কি মানুষ সোজা ঝুলিয়ে রাখে? হাতকে স্প্রিংয়ের মত প্যাচানো যায়না দেখে মানুষ হাত ভাঁজ করে রাখে। এখানেই শেষ না আমার আরো ভুল ছিল। হাতীর রঙ কেন নীল দিলাম! আরে বাবা হাতির গায়ের যে রঙ সেটা কি দেখতে খুব সুন্দর? কেমন ম্যাটম্যাটে রঙ। দেখলেই তো বমি আসে। এর চেয়ে নীল রঙের হাতি দেখলেই তো মন জুড়িয়ে যায়, কেমন একটা স্নিগ্ধ ভাব। টীচার কে কে বোঝায়!
দেখতে দেখতে ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষা চলে আসলো। সবার শেষ পরীক্ষা ছিল ড্রইং। ড্রইং পরীক্ষায় আমাদের আঁকতে দেয়া হল গোলাপ ফুল। মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকে চলেছি। কোন দিকে খেয়াল নাই। এক এক করে সবাই খাতা জমা দিয়ে দিচ্ছে, আমি তখনো রঙ পেন্সিল দিয়ে রঙ করে চলেছি। পাঁপড়ি রঙ করা শেষ, ডাঁট রঙ করে ফেললাম। বাকী আছে পাতা। যে-ই দেখছে সে-ই তারিফ করছে। সবারই একই কথা এমন সুন্দর গোলাপ ফুল কেউ জীবনে দেখেনি । অনেকে আফসোস করা শুরু করলো, যদি আমার মত করে আঁকতে পারতো। অন্যদের হা হুতাশ শুনে বুক গর্বে ভরে গেলো। এবার হায়েস্ট মার্কস ঠেকায় কে? রঙ পেন্সিলের শেষ টান টা দিলাম। খাতাটা নিজের সামনে মেলে ধরে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না , এত সুন্দর এঁকেছি আমি! খাতটা জমা দিতে খারাপ লাগছিলো, এত সুন্দর ছবিটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। কিন্ত খাতা জমা দিতে হবে – এটাই পরীক্ষার নিয়ম। নিয়মের বাইরে তো আর যাওয়া যায়না। কী আর করা, খাতাটা জমা দিয়ে দিলাম। খাতা নেবার সময় টীচার একবার আমার খাতা দেখলেন, তারপর আমার দিকে আড় চোখে তাকালেন। নাহ্ এবার টীচার তারিফ না করে যাবে কই! মনে মনে বেশ খুশি হলাম। জায়গায় গিয়ে বসতে যাব এমন সময় টীচার আমাকে ডাকলেন। আবারো খুশি হলাম। যে সুন্দর ছবি এঁকেছি টীচার না ডাক দিয়ে পারেবেনইনা। খুশি খুশি মনে গেলাম।
“সবাইতো গোলাপ ফুল এঁকেছে তুমি এটা কি একেছো?” টীচারের প্রথম প্রশ্ন।
“জ্বী, এটাও গোলাপ ফুল।” আমতা আমতা করে বললাম।
“এটা কে গোলাপ ফুল বলে?” আমি দুর্বলভাবে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম।
“আমি যদি বলি এটা একটা বেগুন!” টীচার বলে কি, জ্বলজ্যান্ত গোলাপ ফুল কেন বেগুন হবে বুঝলাম না।
“গোলাপ ফুল দেখতে কি বেগুনী রঙের?”
“আসলে টীচার গোলাপী রঙের ফুল দেখতে ভালো লাগেনা। গোলাপের রঙ বেগুনী হলে ভালো হত তাই…”
“গাধা! এজন্য তুমি রঙ পালটে দেবে! কোথাও কখনো বেগুনী রঙের গোলাপ ফুল দেখেছো। আর গোলাপের পাঁপড়ি কি এরকম লম্বা লম্বা হয়?”
“গোলাপ ফুল দেখতে যদি সূর্যমূখী ফুলের মত হত…” – আমি বলার চেষ্টা করি।
“তাহলে পৃথিবীর সব ফুলই সূর্যমূখী হত, কেউ গোলাপ বলে কিছু দেখতনা।” গোলাপ না দেখলে সমস্যা কোথায় বুঝলাম না। সূর্যমূখী দেখতে কত সুন্দর, ইয়া বড় সাইজ। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। কোথায় গোলাপ আর কোথায় সূর্যমূখী! কিন্তু টীচারের থমথমে রাগী চেহারা দেখে কিছু বলার সাহস পেলামনা। চুপচাপ বকা হজম করে যাচ্ছি।
“ফুলের ডাঁট উপরে কেন?” টীচার এবার পুরোপুরি ক্ষিপ্ত।
“আমি আসলে গাছ থেকে একটা ফুল পড়ে যাচ্ছে সেই অবস্থার কথা কল্পনা করে ছবিটা এঁকেছি। এটা পড়ন্ত ফুল তো তাই ডাঁটটা উপরের দিকে। নীচে পড়ে গেলেই আবার ঠিক হয়ে যাবে।” আমি আশ্বাস দিলাম। আসল কথা হল আমি আঁকার সময় খাতাটা উলটা করে ধরেছিলাম। টীচারের যেই রাগী মূর্তি, সত্যি কথা বলার সাহস পেলাম না। যদি আমার ভুল টের পেয়ে মারধর শুরু করেন? সেজন্য মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিলাম। টীচার বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
এরপরের ঘটনা খুব ছোট। আমি ওই পরীক্ষায় ফেল করলাম। এরপর সেকেন্ড টার্ম এবং এ্যানুয়াল পরীক্ষা দিলাম। কিভাবে কিভাবে যেন ক্লাস ওয়ানে উঠেও গেলাম। কিন্তু ওই ছোট বয়সেই টের পেয়েছিলাম, গতানুগতিক পথের বাইরে চলতে গেলে কীভাবে আটকে দেয়া হয়। মাঝে মাঝে ভাবি রাইট ভাইদ্বয় কল্পনায় মানুষকে উড়তে দেখেছিল বলেই আজকের দিনে এরোপ্লেনে আমরা উড়োউড়ি করি। যদি তাদের ধমক দিয়ে বলা হত “কত বড় ফাজিল, মানুষের নাই ডানা তাকে আবার আকাশে উড়ায়! এক্ষুনি এসব ফাউল কল্পনা বাদ দাও।” তাহলে আমরা আজকে কোথায় থাকতাম! অবশ্য আমার মত নগন্য মানুষের নীল হাতি বা বেগুনী গোলাপ ফুলের স্বপ্নের সাথে এরোপ্লেনের স্বপ্ন ঠিক মিল খায় না! কোথায় রাইট ভাইরা আর কোথায় আমি! কোথায় চাঁদপুর কোথায় কুয়ালালামপুর! তবে স্বপ্ন তো স্বপ্নই, সেটা যেরকমই হোক।
দারুণ পোস্ট। আমার নিজের অবস্থার কথা মনে পড়ে গেল। আমিও প্রতিবার ড্রইং পরীক্ষার সময়ে মহা বিপদে পড়তাম, বিপদটা আপনার মত না, আপনি ড্রইং বেশী ভাল পারতেন, এইটাই ছিল আপনার বিপদ, আর আমার বিপদ উল্টা, আমি ড্রইং কিছুই পারতাম না। সারা স্কুল জীবন মোটামুটি একি দৃশ্য একে পার করে দিয়েছি! আল্লাহর শোকর ভার্সিটিতে ড্রইং করতে হয় না।
আদনান ভাই, দারুন লাগলো পড়তে!!আমি নিজে কিছু আঁকতে পারিনা। ছোটবেলায় পারতাম আম, ছাতা আর কলা। এখন বললে ঐ তিনটাও পারবোনা 😀
@Asif @জিহাদ:নাহ্ আমি এখনো তেমন ভালো আঁকতে পারিনা। আমি যা আঁকি তা কেউ বুঝেনা… আমাকেই বুঝিয়ে দিতে হয়!! 😀