রঙ্গীন দুনিয়া – ১০

শেষ পোস্টের পর অনেককিছুই ঘটে গেছে আবার কিছুই ঘটেনাই! আমার জন্য যেগুলো অনেক কিছু অন্যদের জন্য হয়তো সেগুলো কিছুইনা! যাই হোক, সেসব জিনিসকে একসাথে ভরার চেষ্টা চালাচ্ছি এই পোস্টে। কতটুকু সম্ভব হবে জানিনা।

ইদুর

দেশে থাকতে ইদুর জিনিসটার সাথে তেমন একটা পরিচয় ছিলনা। মাঝে মাঝে বাসায় উৎপাত দেখা দিলে র‍্যাটম বা ঐ টাইপের কিছু একটা কিনে রাতে বাসায় ছড়িয়ে দিলেই কাহিনী শেষ হয়ে যেত, সকালে দেখা যেত কয়েকটা ইদুর বা চিকা প্রজাতির প্রাণী মরে পড়ে আছে। কিন্তু সুদূর হল্যান্ডে এসেও যে ইদুর বাবাজির খেল দেখতে হবে সেটা চিন্তা করিনাই। কাহিনীটা গত সামারের পরের ঘটনা, সেসময় কিছুদিন খালার বাসায় ছিলাম। তো বাসায় ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে ল্যাপিতে কাজ করছি, এমন সময় মনে হল জীবন্ত কিছু একটা আমার পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। কাহিনী কি! একটু এদিক সেদিক তাকালাম কিছু চোখে পড়লনা। মনের ভুল নাকি! আবার ল্যাপির দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ল দরজার কোনায়, দেখি একজোড়া কুঁতকুতে চোখ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কোন ইঁদুরের আমার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকার ঘটনা এই প্রথম!

যাই হোক ইঁদুর থাকা মানেই হল একে খতম করতে হবে। পরদিন থেকেই উঠে পড়ে লাগা হল ইঁদুরের পেছনে। আসমিতা রিপোর্ট করল নীচে বসার ঘরে দেখা গেছে বাবাজীকে। সাথে সাথে ড্রইংরুমের সব দরজা জানালা আটকে ঝাপিয়ে পড়া হল। হঠাৎ চোখ গেল এরিকের দিকে। ও দেখি একহাতে পিনাট বাটারের বৈয়াম আরেক হাতে চামচে পিনাট বাটার নিয়ে পজিশন নিচ্ছে। কাহিনী কি? পরে জানা গেল গুগুল বাবা নাকি ফর্মায়েছেন যে পিনাট বাটার আর চিজ ইঁদুর প্রজাতির অতি প্রিয় খাদ্য। তাই সেই প্রিয় খাদ্য নিয়ে লোভ দেখিয়ে ইঁদুর মারার ফন্দি করেছে এরিক বেচারা। ঐ দিন অবশ্য ইঁদুর নিধন প্রকল্প সফল হয় নাই, শুধু ঐ দিনই না এর পর যতবারই ইঁদুর মারতে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে কোনবারই আর সেটা সফল হয়নি। মাসখানেক পর মনের দুঃখে ইঁদুরটা বাসা ছেড়েই চলে গেল! এরপর থেকে আমরা আর তার লেজের টিকিটিও দেখিনি।
Continue reading রঙ্গীন দুনিয়া – ১০

রঙ্গীন দুনিয়া – ৯

বহুদিন ধরে লেখা হয়না। অনেকগুলো কারনের মধ্যে প্রধান কারন হচ্ছে ফাঁকিবাজী। ইদানিং সবকিছুতেই ফাঁকিবাজী করতে ইচ্ছে করে। আমার ইংলিশ ব্লগটা আপডেট করিনা, ফেসবুকে বন্ধুদের ওয়ালে লিখিনা, একেরপর এক এসাইনমেন্ট বাকী পড়ছে, পরীক্ষার পড়া জমে উঠেছে – সবকিছুতেই ফাঁকি দিচ্ছি। মাঝখানে ওয়াটারলু, বেলজিয়াম আর ট্যাসেলে গিয়েছিলাম, ফাঁকিবাজীর ঠ্যালায় পড়ে সেইগুলা কিছুই লেখা হয়নাই। গত সপ্তাহে হঠাৎ করে জার্মানি গেলাম। এই জায়গাতেও ফাঁকি মারতে ইচ্ছা করছিল, তারপর কী যেন মনে করে লিখতে ইচ্ছা করল। তাই ল্যাপিটাকে কোলের উপর নিয়ে বসে লিখতে শুরু করলাম।

প্রথমেই জানতে হবে জার্মানি যাবার কেন ঠ্যাকা পড়লো। মামীর এক আপা সম্পর্কীয় আত্মীয় জার্মানীতে তার ছেলের বাসায় এসেছে। সেই মহিলার হঠাৎ করেই মামীকে দেখবার খায়েশ হলো (সেই সাথে হল্যান্ড আসার খায়েশও ছিল), সেই খায়েশ পূরণ করতে জার্মানী যেতে হবে। প্ল্যান মোতাবেক, মামীরা প্রথমে জার্মানি যাবে তারপর ছেলেসহ আপাকে হল্যান্ডে আনা হবে- পুরোটাই হবে একটা রোডট্রিপ! যেহেতু রোডট্রিপ সেহেতু পুরাপুরি নেভিগেটরের উপর নির্ভর করতে হবে, যেহেতু নেভিগেটরের উপর নির্ভর করতে হবে সেহেতু মামীর চেয়ে আমি বেশি রিলায়েবল (মামী আবার টেকনোসাইডে কিঞ্চিত কচি-কাঁচা), যেহেতু আমি বেশি রিলায়েবল সেহেতু মামা আমাকে নিবেই নিবে, যেহেতু আমাকে নিবেই নিবে সেহেতু আমার না গিয়ে কোন গতি নাই, যেহেতু আমার না গিয়ে কোন গতি নাই সেহেতু যাবার আগের দিন রাতের বেলা ঠিকানা নিয়ে নেভিগেটর সেট করতে বসলাম। ঠিকানা বলছে জার্মানির উল্‌ম শহরে যেতে হবে, নেভিগেটরে ঠিকানা ঢুকানোর পর দেখি ডিস্ট্যান্স দেখাচ্ছে ৭১৬ কিমি! বিশাল ড্রাইভিং ডিস্ট্যান্স! প্রায় তিনবার ঢাকা-চিটাগাং আসা যাওয়া করা যাবে। অবশ্য সেই তুলনায় সময় কম লাগবে, একটানা যেতে পারলে নেভিগেটরের হিসাব অনুযায়ী ছয় ঘন্টায় যাওয়া সম্ভব। ইউরোপীয়ান রাস্তা বলে কথা!

রাতে জার্মানী থেকে খবর আসলো, আন্টির (মামীর বোন হলে আমার নির্ঘাৎ আন্টি!) পান লাগবে! জার্মানীতে পান জিনিসটা নাই। ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও পান জিনিসটা পাওয়া যায় বলে জানতামনা। আন্টি নাকি বেশ পান-পিয়াসী, কিন্তু জর্ম্মন দেশে আসার পর থেকে আর পান পায়না, উপরি পাওনা হিসেবে ইউরোপীয়ান খাবার খেতে হয় (বোনাস হিসেবে উনি জার্মান পুত্রবধূ অর্জন করেছেন কিনা!), তার মুখ নাকি পুরা বিস্বাদ হয়ে গেছে। স্বাদ ফিরিয়ে আনতে তার দরকার পান! এই ইউরোপের এক ইংল্যান্ড ছাড়া আর কোন জায়গার নাম মাথায় আসলোনা যেখানে পান পাওয়া যেতে পারে। এ্যামস্টারড্যামে পাওয়া গেলেও যেতে পারে – চান্স কম। মামা বেশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় গেল!

সকালবেলা আটটার দিকে আমাদের জার্নি শুরু হল। প্রথমে গেলাম এক ইন্ডিয়ান দোকানে – যদি পান পাওয়া যায়! কপাল খারাপ – ওদের কাছে পান নাই। তবে ওরা এক তুর্কী দোকান দেখিয়ে দিল যেখানে পাওয়া হয়তো যেতে পারে। মামা-ভাগ্নে মিলে গেলাম সেই দোকানে। কাউন্টারে এক ভূঁড়িওয়ালা তুর্কি বীর বসে হাই তুলছে – সম্ভবত রাতে ঘুম ঠিকমত হয়নাই। সেই লোকরে পানের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে টের পেলাম পানের ইংলিশ আমরা কেউই জানিনা, তার উপর আবার সেই তুর্কীর ইংলিশ জ্ঞানও অসাধারন! কি আর করা আকারে ইঙ্গিতে বুঝায় বললাম “জায়ান্ট ইন্ডিয়ান লীফ” যেইটা আবার “ফ্ল্যাট”! তুর্কী বীর পুরোপুরি বিভ্রান্ত – “ফ্ল্যাট লীফ” আবার কি জিনিস, সব লীফই তো ফ্ল্যাট। বেচারা লাল শাক আনে, পালং শাক আনে, আরো হাবিজাবি কত “লীফ” আনে কিন্তু পান আর আনেনা। কী আর করা দোকান থেকে বের হয়ে দেখি এক সুরিনামী দোকান। পানের আশায় সেই দোকানেও ঢুকলাম, আর কী আশ্চর্য সামনেই প্যাকেট প্যাকেট পান সাজিয়ে রাখা! দু’খান প্যাকেট চটপট নিয়ে ফেললাম। দাম জিজ্ঞেস করে দেখা গেল প্রতি বিশটা পানের দাম চব্বিশ ইউরো মানে প্রায় দু’হাজার টাকা – মানে পানপ্রতি একশ টাকা!

যাই হোক মিশন পান একমপ্লিশ করে আবার রওনা দিলাম। এবার গন্তব্য জার্মানী। প্রায় দেড় ঘন্টা হয়ে গেল, গাড়ি একটানা চালিয়ে মাম ক্লান্ত। সামনের এক পেট্রল স্টেশনে থেমে গাড়ির পেট ভরা হল সেই সঙ্গে আমাদেরও পেট খালি করে ভর্তি করে নিলাম। আবার রওনা দিলাম। নেদারল্যান্ডের হাইওয়েতে সর্বোচ্চ স্পীড হচ্ছে ১২০ কিমি/ঘন্টা। মামা ১২০ এই চালাচ্ছিল। হঠাৎ দেখি পিছন থেকে একের পর এক গাড়ি ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে, কাহিনী কি! আমরা কি তাহলে কম স্পীডে যাচ্ছি? কিন্তু স্পিডোমিটারতো তা বলেনা। চোখ পড়লো রাস্তার ‘Exit’ সাইনের উপর। ডাচ ভাষায় ‘Exit’ সাইনবোর্ডটাতে লেখা থাকে ‘Uitgang’, সেটা পালটে এখন ‘Ausfahrt’ লেখা দেখাচ্ছে – তারমানে আমরা এখন জার্মানীতে! এই জন্যই আমরা বারবার পিছিয়ে পড়ছি কারন, জার্মানীর হাইওয়েতে কোন স্পীড লিমিট নাই! আহা রাস্তায় কী গাড়ির বাহার! একেবারে আনকোড়া নতুন মার্সিডিজ, ক্রাইসলার, অডি, বিএমডব্লিউ, ওপেল পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে – স্বপ্নের মত দৃশ্য। ডাচ লোকজন কিপটা হওয়াতে হল্যান্ডে এত আনকোড়া নতুন গাড়ি দেখা যায়না। এই কিপটা লোকজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফোর্ড, ভল্ভো, সিত্রঁ আর রেনল্টের উপর দিয়েই খায়েশ মেটায়।

হঠাৎ কোত্থেকে এক ভ্যান এসে সামনে পড়ল। ভ্যানের পেছনে ইলেক্ট্রনিক ডিস্পলে বোর্ডে লেখা উঠল “ফলো মি”! নিশ্চয়ই পুলিশ মামু! একপাশে গাড়ি পার্ক করতেই সামনের ভ্যান থেকে ইউনিফর্ম পড়া পাঁচজন মামু আর একজন মামী লাফ দিয়ে বের হয়ে আসলো। রুটিন চেকয়াপ করবে, হল্যান্ডের নাম্বার প্লেট দেখে গাড়ি থামিয়েছে। আমাদের আইডেন্টিটি কার্ড চেক করে হাই হ্যালো বলে ছেড়ে দিল। আবার যাত্রা শুরু হল। একটু পরেই শুরু হল পাহাড়ি এলাকা। সে কি দৃশ্য – পাহাড় ডিঙ্গিয়ে রাস্তা চলে গেছে, মাঝে মাঝে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে টানেল, পাশাপাশি রয়েছে ট্রেন লাইন! অসাধারন ব্যাপার – মনে হচ্ছে যেন রোলার কোস্টার চড়ছি। এরই মধ্যে দেখি পাশ দিয়ে ভুম ভুম আওয়াজ করে দুইখান পোর্শে যেন উড়ে গেল। আমাদের গাড়ির স্পিডের কাটা ছিল ১৬৫ এর মত, তাহলে ঐ দুইটা নিশ্চয়ই ২০০’র মত চলছিল! আমি তাই সবসময় বলি, সেই রকম গাড়ির মত গাড়ি কিনলে চালায়া মজা জার্মানীতে!

জার্মানীতে প্রথম ব্রেক নিয়ে এক পেট্রল স্টেশনের বাথরুমে ঢুকে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। জনপ্রতি পঞ্চাশ সেন্ট দিয়ে ঢুকতে হবে, মানে প্রায় পঞ্চাশ টাকা! হুলান্ট দেশে বাথরুম ফ্রী অফ চার্জ আর এই জর্ম্মন দেশে পয়সা দিয়ে ঢুকতে হয় – কী ক্যারদানী! কিন্তু আমারো ঠ্যাকা পড়ছে, টয়লেটে না গিয়ে উপায় নাই। কী আর করা গাঁটের টাকা খরচ করেই ঢুকলাম সেই বাথরুমে। ভাবলাম পয়সা খরচ করে ঢুকতে হল যখন টয়লেটটা দেখতে না জানি কেমন, নিশ্চয়ই টেকনিক্যাল ক্যারাব্যারায় ভর্তি; কোথায় কি – পুরাই নরমাল একটা টয়লেট, খামাখা এতগুলা টাকা নিসে ব্যাটারা।

প্রায় সাতখান ব্রেক নিয়ে অবশেষে বিকাল চারটায় আমরা উলমে গিয়ে পৌছালাম। ইউনিভার্সিটি আর পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গির্জার শহর এই উল্‌ম জার্মানীর একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে। এই শহর আইন্সটাইনের জন্ম শহর। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইউরোপখ্যাত দানিয়ুব নদী। আমার কাছে ইউরোপের সব শহরই দেখতে একই রকম লাগে, একই ধরনের রাস্তা, বাড়ি, গাছপালা। সিটি সেন্টারগুলোতে মনুমেন্টের ছড়াছড়ি, বেশিরভাগেরই আবার ভিতর থেকে পানির ফোয়ারা পড়ছে। যাই হোক, একসময় গিয়ে পৌছালাম সেই ভদ্রলোকের (উনি আবার সম্পর্কে আমার ভাই হন, যেহেতু মামীর আপার ছেলে) বাসায়। গিয়ে দেখি জার্মান ভাবী টেবিলে পোলাও সাজাচ্ছে আমাদের জন্য। কী আর করা সাজানো পোলাও তো ফেলে রাখা যায়না, অগত্যা খেতে বসতেই হল! ঐদিকে পান পেয়ে আন্টির মুখের হাসি আর ধরেনা, ভদ্রমহিলা সাথে সাথে কয়েক খিলি মুখে পুরে ফেললো!

খাওয়াদাওয়া করে বের হলাম শহর দেখতে। নামডাকের তুলনায় উল্‌ম অনেক ছোট শহর। মোটামুটি লাখখানেকের কিছু বেশি লোকের বাস এই শহরে। ইউরোপের আর সব শহরের মত এর সিটি সেন্টারও একই রকম- পাথরের রাস্তা, মনুমেন্টের ফোয়ারা, পুরানো দালান কোঠা। তবে একটা দিক থেকে অন্য রকম – দানিয়ুব নদীকে বিভিন্ন ছোট ছোট শাখা প্রশাখায় ভাগ করে শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করা হয়েছে, যার ফলে একে দেখতে অনেকটা ভেনিসের মত লাগে। ঠিক এই কারনে এখানকার লোকজন একে ‘লিটল ভেনিস’ বলে। সিটি সেন্টারের ঠিক মাঝেই হচ্ছে বিখ্যাত ‘উল্‌ম মিন্সটার’ বা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু চার্চ। চার্চ থেকে কিছুদূর গেলেই উল্‌মের সিটি কর্পোরেশনের খান্দানী পুরানো বিল্ডিং। আরো কিছুদূর এগোতেই সামনে পড়লো দানিয়ুব নদী। নদীর দুই পাশে প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু দেয়াল দেয়া। শহরের মধ্যে যেই জিনিসটা বেশি চোখে পড়ে সেইটা হল ‘উল্মার স্পাটয্‌’- একটা চড়ুই পাখির স্ট্যাচু। এই পাখি উল্‌ম শহরের প্রতীক। সূর্য ডুবে প্রায় রাত হয়ে গেল। পরদিন তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে তাই বাসার দিকে রওনা হলাম। আসার সময় পথের পাশে এক দূর্গের ওয়াচ টাওয়ার দেখতে গাড়ি রাখা হল। টাওয়ারের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঢুকতে গিয়ে নাকে ঝাঝালো গন্ধের ধাক্কা খেয়ে মনে হল যেন বাংলাদেশের পাব্লিক টয়লেটে ঢুকলাম! কে জানতো জার্মান পাব্লিকরা বাসা বাড়ি ফেলে এই টাওয়ারে ‘ছোট টয়লেট’ সারে। প্যাচানো সিড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে শুনি ফিসফিস শব্দ। কাহিনী কি! বাংলাদেশে কখনো ভূত দেখিনাই, শেষ পর্যন্ত জার্মান ভূত দেখতে হবে? ছাদের কাছে এসে সাবধানে মাথা তুলতে গিয়ে টকাস করে সিলিঙ্গে একটা বাড়ি খেলাম আর সাথে ফিসফিস শব্দ বন্ধ! ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখি আমার চেয়েও ভ্যাবচ্যাকা চোখে এক জুটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে – বাসা-বাড়ি ফেলে দিয়ে টাওয়ারের ছাদে প্রেম! এইটা কি বাংলাদেশ পাইসে নাকি? ওরা যা খুশি করুক আমি আমার মত টাওয়ারে উঠে রাতের উল্‌ম দেখতে লাগলাম। টাওয়ারের উপরে খানিকটা আবছা আলো ছিলো। সেই আলোতে দেখলাম দেয়ালে বিভিন্ন কালি দিয়ে লেখা ‘অমুক+তমুক’! আবার বঙ্গদেশের ঘ্রান – জার্মানদের দিয়ে সবই হয়!

জার্মানীতে একটা জিনিস ভীষন ভালো লাগলো – ঐখানে আমার নিজেকে অনেকদিন পর স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষ বলে মনে হল। হল্যান্ডের লোকজন বিচ্ছিরি ধরনের লম্বা হয়, এদের গড় হাইট থাকে ৬ ফুট! এরা জন্মের পর থেকে সাইকেল চালায় আর সাঁতার কাটে – এদের ছয়ফুট না হয়ে কোন উপায় নাই। এইসব ছ’ফুটিদের সাথে থাকতে থাকতে নিজেকে লিলিপুট মনে হত। জার্মানীতে এসে দেখি যে নাহ্‌ এরা আমার কাছাকাছি; আমার চেয়ে ছোট, আমার সমান, আমার চেয়ে বড় – সবধরনেরই আছে!

রঙ্গীন দুনিয়া – ৮

ইডলস

রোটরড্যামের খুব বিখ্যাত এক চাইনিজ রেস্টুরেন্ট হল আইডলসএটা নামে চাইনিজ হলেও এতে ইন্ডিয়ান আর জাপানিজ খাবারও পাওয়া যায়। তবে এই রেস্টুরেন্ট বিখ্যাত অন্যকারনে। এইখানে খাবার ভোক” করা যায়। ভোক হচ্ছে অতিথিদের সামনে তাদের পছন্দমত খাবার রান্না করে দেবার একটা চাইনিজ প্রসেস। টেবিলে সব কিছু কাঁচা সাজানো থাকে, যার যা দরকার সেটা প্লেটে তুলে নিয়ে রাধুঁনির কাছে নিয়ে যেতে হয়। তারপর রাধুঁনি ফরমায়েশানুযায়ী মসলা-টসলা দিয়ে খাবার তৈরি করে দেয়।

খালু এবার হল্যান্ডে আসাতে প্ল্যান হল যে আইডলসে খাওয়া হবে। মার্চের এক শনিবারের সন্ধ্যাকে টার্গেট করা হল আমাদের সঙ্গে আবার এনেকা আর জুয়ায়েরও যাবে। সময়মত আমরা সব রেডি হয়ে খালার বাসায় আসলাম। এসে শুনি খালুর বিএমডব্লু তে লুব্রিক্যান্ট ফেইলুর ইন্ডিকেশন দিচ্ছে। তিনটা গাড়ির বদলে এখন দুটো গাড়িতে যেতে হবে- মামার গাড়ি আর এনেকাদের গাড়ি। মোটামুটি সবাই ভাগভাগি করে গাড়িতে বসে রওয়ানা হলাম। আমি ছিলাম মামার সিট্রোঁতে। গাড়ি ছাড়ার পাঁচ মিনিট পর মামা বললো ভাইগ্না গাড়ির টেম্পারেচারে প্রব্লেম দিতেসেবলে কি! ড্যাশবোর্ডে উঁকি দিলাম, ইঞ্জিন টেম্পারেচার আশি ডিগ্রী ছাড়ায় গেছে। যে হারে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করছে তাতে যে কোন মুহূর্তে ইঞ্জিন উড়ে যাবার চান্স আছে! মামারে বললাম গাড়ি সাইড করতে। রাস্তায় গাড়ি থামায়ে রেডিয়টেরে উঁকি দিলাম, যা চিন্তা করছিলাম দেখি সেটাই ঘটেছে, পানি বলতে গেলে একদমই নাই। গাড়ির পিছন থেকে পানির বোতল বের করে পুরাটাই ঢেলে দিলাম। রেডিয়েটরের যেন রাজ্যের ক্ষুধা, দেয়া মাত্রই সব পানি উধাও! রেডিয়েটরে আরো আপনি ভরতে হবে। এইদিকে আসমিতা আবার এনেকাদের গাড়িতে খালাকে ফোন দিল সবকিছু জানাবার জন্যকিছুক্ষনের মধ্যে খবর আসলো আমাদের কাছের ফুয়েল স্টেশনে যেতে বলা হয়েছে, জুয়ায়ের নিজে গাড়ি দেখবে!

Continue reading রঙ্গীন দুনিয়া – ৮

রঙ্গীন দুনিয়া – ৭

শীত কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি?

প্রথম ধাক্কায় এইটা বলে নেয়া ভালো এইবার উইন্টারে নেদারল্যান্ডসে গত চৌদ্দ বছরের সবচেয়ে ঠান্ডা পড়লো। রাতের বেলা হেগ শহরে টেম্পারেচার মাইনাস পনেরতে গিয়ে ঠেকত। সাগরের পাশে থাকাতে হেগে ঠান্ডা কম ছিল, অন্যান্য জায়গায় তাপমাত্রা মাইনাস বিশের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো! ঠান্ডায় আমি কি কাবু হব, ডাচ লোকেরাই কাবু হয়ে গেছে! রাস্তায় সবাই বস্তা (ঠান্ডায় যে পরিমান কাপড়চোপড় পড়া হয় সেগুলাকে বস্তা বললে খুব একটা ভুল হবেনা) পড়ে ঘোরাঘুরি করছে, এইটা এদের কাছেও অপরিচিত দৃশ্য। তবে তুষার একেবারেই পড়েনি। এখন পর্যন্ত মাত্র তিন দিন তুষার পড়েছে তাও যেটা সবচেয়ে বেশীক্ষন পড়েছিলো সেটার স্থায়ীত্বকাল ছিল টেনেটুনে চার ঘন্টা!

শীতের দিনে সবচেয়ে যেটা কষ্টের সেটা হল ঘড়ির কাঁটা বলে সকাল আটটা কিন্তু ঘরের বাইরে জমাট অন্ধকার! সূর্য উঠতে উঠতে সকাল নয়টা। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে সাড়ে দশটায় ক্লাস শেষ করে প্রফেসর আমাদের গুড মর্নিং জানিয়ে চলে যান। আবার অন্যদিকে বিকেল চারটা বেজেছে কি বাজেনি সাথে সাথে চারদিকে ঝপাস করে অন্ধকার জেঁকে বসলো। রাতে আঁধারে বাসা ছাড়ি আবার রাতের আঁধারেই বাসায় ফিরি। কি কপাল!

তবে তুষার না পড়লেও বাড়ির পাশের খাল ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। শুধু বাসার পাশের খাল না, অন্যান্য সব খাল, লেক, নদীও ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে গিয়েছিলো। নেদারল্যান্ডসের সবগুলো খাল, লেক, নদী একটার সাথে আরেকটা কানেক্টেড। তাই কেউ ইচ্ছা করলেই যে কোন খালে নৌকা ভাসিয়েই যে কোন নদীতে গিয়ে হাজির হতে পারে। অবশ্য সেই জন্য রূট জানা চাই। তো শীতে যখন সব পানি জমে বরফ হয়ে গেলো, এইখানকার লোকজন তখন স্কেটিং করা শুরু করল। স্কেটিং করে তারা এক শহর থেকে আরেক শহরে হাজির হত, প্রত্যেক শহরের মাথায় আবার চেকপোস্ট টাইপের একটা পোস্ট বসানো হল, স্কেটিং করে একেকটা পোস্ট পার হলে সেই পোস্ট থেকে একটা সার্টিফিকেট মিলে যাতে লেখা থাকে যে ঐ সার্টিফিকেটের মালিক এই শহর স্কেটিং করে পার হয়েছে! এইভাবে সবাই চায় বেশি বেশি সার্টিফিকেট নেবার জন্য।

পাগল সব দেশেই থাকে। কোথাও একটা দুইটা আবার কোথাওবা দল বেঁধে – এই যা পার্থক্য! এইখানে ও সেরকম দলবদ্ধ পাগলের কমতি নাই, তবে একসাথে আমার দেখা সে পাগলদের সংখ্যাটা শতিনেকের কাছাকাছি। তো এই পাগলদের দেখা মিললো জানুয়ারির এগারো তারিখ স্ক্যাভেনিংখে। স্ক্যাভেনিংখ হল হেগের একটা বীচ, হেগের আরেকটা বীচের নাম কাইকডাউন। যাই হোক স্ক্যাভেনিংখে সব ধরনের সব বয়সের পাগল এক হল, সেসব পাগলদের উৎসাহ দিতে আরো অনেক পাতি-পাগল আসলো। ঠিক দুপুর বারটায় কনকনে শীতের মধ্যে পাগলরা সবাই জামা কাপড় খুলে বরফ শীতল সমুদ্রের পানিতে দিল দৌড়! পেছন থেকে পাতি পাগলেরা চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে। তাদের শখ হল ঐ বরফ শীতল পানিতে সাঁতার কাটবে। এই কাজটা এরা প্রতিবছর জানুয়ারিতে করে থাকে!

Continue reading রঙ্গীন দুনিয়া – ৭

রঙ্গীন দুনিয়া – ৬

কোরবানীর ঈদ

দ্বিতীয়বারের মত দেশের বাইরে ঈদ করলাম। দেশের বাইরে ঈদ করার ঝামেলা একটাই, ঈদ-ঈদ ভাবটা কোনমতেই আসেনা। সাদামাটা একটা দিন, আশেপাশের সবাই যার যার মত কাজে যাচ্ছে মাঝখানে কেবল আমরা কয়েকজন ঈদের নামায পড়ার জন্য বের হয়েছি। সারা জীবন যেইখানে হইহুল্লোড় করে ঈদ করে অভ্যাস সেইখানে এইরকম ম্যাদামারা নির্জীব ঈদ পালন করাই বিরক্তিকর। দেশের ফেলে আসা মুখগুলোর কথা মনে পড়ে, পুরোনো ঈদ্গুলোর কথা মনে পড়ে, মনটা বিরক্তিতে তেতো হয়ে আসে এম্নিতেই।

চুল কাটা

দেশ ছাড়ার পর এই প্রথম চুল কাটাতে গেলাম। যেটাতে চুল কাটাতে গেলাম সেটা আসলে চুল কাটাবার স্কুল, সোজা কথায় নাপিত তৈরির পাঠশালা। এই খানে ভবিষ্যতের নাপিতেরা চুল কাটার তালিম নেয়। এই পাঠশালায় যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য এইটা বেশ সস্তা, নয় ইউরোতে চুল কাটানো যায়, যেখানে অন্য সবখানে লাগে মিনিমাম পচিশ ইউরো। নাপিতের দোকানে ছেলে মেয়ে বাচ্চা বুড়ো কোন ভেদাভেদ নাই- সবাই এইখানে কাস্টমার।

নাপিত-নাপিতানী সবাই নিজের নিজের কাজ করে যাচ্ছে। আমার সাথে যে কয়জন লোক ছিলো সবাই কে দেখলাম একজন করে নাপিতানী এসে নিয়ে যাচ্ছে চুল কাটাবার জন্য। আমিও বসে আছি একজন নাপিতানির জন্য। একসময় আমার ডাক পড়ল, তবে ভাগ্যে নাপিতানী পড়লোনা, কার্লোস নামের এক নাপিত পড়লো। সে হাসি মুখে এসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল যে আজকে সে আমার নাপিত। কার্লোসের একটা ছোটখাট বর্ণনা দেয়া উচিত। হাইটে ছোটখাট এই শ্বেতাংগ ছেলের কান এবং ঠোঁট ফুট করা এবং সেই ফুটো থেকে বেষ কয়েক ধরনের অলংকার বের হয়ে আছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে তার চুলের স্টাইল। একই মাথায় সে দুই ধরনের স্টাইল করে বসে আছে। পুরো মাথার চুলকে দুই ভাগে ভাগ করে সে ডান পাশে এক ডিজাইন করেছে আর বাম পাশে আরেক ডিজাইন। ডান পাশ থেকে দেখলে তাকে মনে হয় মাথায় “মুরগীর ঝুঁটি” কাট আর বাম পাশ থেকে দেখলে মনে হয় বাটি ছাঁট! একেবারে টুইন-ওয়ান যাকে বলে। তবে মাথায় চুলের গোছা যেমনই হোক ছেলে চুল কাটে ভালো।

নিউইয়ার

পশ্চিমা দেশগুলোতে নিউইয়ার একটা কালচারাল ইভেন্টের চেয়েও বড় কিছু। থার্টি ফার্স্ট নাইটে এদের নিউইয়ারের আসল উৎসবটা চোখে পড়ে। পুরো ডিসেম্বর জুড়ে চলে ক্রিস্মাস আর নিউ ইয়ারের প্রস্তুতি। চায়না টাউন বিভিন্ন ধরনের আতশবাজীতে ভরে যায়। আতশবাজী কেনার ধুম পড়ে যায় সারা দেশে। অর্থনৈতিক মন্দার এই বাজে সময়েও কেবল মাত্র নেদারল্যান্ডসে থার্টি ফার্স্টে পোড়ানোর জন্য আতশবাজী বিক্রি হয়েছে প্রায় ছেষট্টি মিলিয়ন ইউরোর যেখানে আগে বছর অর্থাৎ ২০০৭ এ বিক্রির পরিমান ছিলো ষাট মিলিয়ন ইউরো!

থার্টি ফার্স্ট নাইটে আমাদের দাওয়াত ছিলো জুয়ারের বাসায়। দাওয়াত বলে দাওয়াত, একেবারে এলাহী খাওয়া দাওয়া। আম দিয়ে রাঁধা মুরগীর তরকারী থেকে শুরু করে ক্যাংগারুর মাংসের পুরি কোন কিছুই বাদ যায়নাই! খাবার উদ্ভট হলেও খেতে ভালো লাগতো যদি এরা লবন ঠিকমত দিত। এরা আবার লবন খায়না বললেই চলে! টেবিল ভর্তি লোভনীয় সব খাবার কিন্তু সবগুলাতে লবন কম- কেমন লাগে!

আতশবাজী পোড়ানো দেখলাম এবং দেখে শিহরিত হলাম! আতশবাজী যে কেমন হতে পারে সেটা এই প্রথম দেখলাম। কিছু কিছু বাজী আবার তিন চার ধাপে ফুটে। অনেকে আবার ফানুশ বানিয়ে উড়াচ্ছে। চারদিকে পুরোপুরি উৎসব। প্রথমে আতশবাজী পোড়ানো দেখতে স্ক্যাভেনিংখ (হেগ শহরের বীচের নাম) যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু জুয়ারের বিশাল খাবার দাবার আয়োজনের ফলে আর যাওয়া হয়নাই, তবে বাড়ির সামনে যা পোড়ানো হয়েছে সেটাও খুব একটা ছোট না। এক রাতে ছেষট্টি মিলিয়ন ইউরো পোড়ানোর সাক্ষী হয়ে রইলাম।

সেল

ডিসেম্বর মাসের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এইটা সেল দেবার মাস। মাঝে ৭৫% পর্যন্ত সেল পাওয়া যায়। জামা, জুতা, পারফিউম সব কিছুতেই সেল। আর এই সময় নারী প্রজাতি আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে। যখনই কোন দোকানে সেল দেয় তখনই সেখানে হানা দেয় তারা। পৃথিবীর সব মার্কেট আসলেই মেয়েদের জন্য। আরো মজার ব্যাপার হল ছেলেদের জিনিসের চেয়ে মেয়েদের জিনিসে সেল বেশি দেয়। কেন কে জানে?


রঙ্গীন দুনিয়া – ৫

অনেকদিন হয় ব্লগ লেখা হয়না। একটা সময় ছিল যখন সবকিছু নিয়েই কেবল ব্লগ লিখতে ইচ্ছা করত। ইদানিং আর সেই ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দেয়না। খামাখা ব্যস্ততা আমার। কোন কিছুই তেমন করা হয়না, তারপরও কীভাবে কীভাবে যেন দিন চলে যায়। কোন কিছুই ভালো লাগেনা। পরিবার-পরিজন ছাড়া তিন মাস টানা কোথাও কখনো থাকা হয়নাই। তিন মাস! নেদারল্যান্ডসে এসেছি তিন মাস হয়ে গেছে, দিন গুলো কীভাবে কীভাবে চলে যায়! মনে হয় যেন গতকালকে সকালে সবাই আমাকে বিদায় দিয়ে প্লেনে তুলে দিল, আর ক্যালেন্ডার বলছে তিন তিনটা মাস! যাই হোক, এই লেখাটা অনেকদিন ধরেই লিখছিলাম। নতুন পুরনো অনেক কথাই এখানে চলে এসেছে। একেবারে খসড়া খাতা থেকে তুলে দিলাম…

স্প্যাম

আমার জিমেইল স্প্যামবক্স প্রতিদিনই গড়ে ১৫টার মত স্প্যাম ধরে! আর স্প্যামের বাহার কী! কেউ আমাকে লটারিতে মিলিওন মিলিওন ডলার দিচ্ছে, কেউবা আবার আমার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ চিন্তিত! তবে এইসব স্বাস্থ্যবিষয়ক চিন্তাবিদদের ধ্যানধারনার সাথে ফার্মগেটের খুজলীওয়ালাদের অনেক মিল। পৃথিবীতে যে এত শক্তি-বর্ধক বা বল-বর্ধক ঔষধ পাতি আছে তা এদের মেইল না পেলে বুঝতামনা। ইদানিং আবার মরা কোটিপতিদের উৎপাত বেড়েছে। প্রায়ই মেইল আসে যে, নাইজেরিয়া বা আরবের কোন কোটিপতি অমুক ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকা রেখে মারা গেছে, সেই টাকার কোন দাবীদার নাই। তো ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছে যেন আমি সেই টাকাটা তুলে নেই, সেজন্য অবশ্য তাকে ভাগ দিতে হবে। একবার তো ইংল্যান্ডের এক ধনীর দুলালী আমাকে মেইল করল তাকে বিয়ে করার জন্য! তার মেইলের ভাষা ছিলো অনেকটা এইরকমঃ তার বাবা বিশাল ধনী। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বাবা সুইজারল্যান্ডে ব্যবসায়িক কাজে গিয়ে আততায়ীর হাতে খুন হয়। এখন সুইসব্যাঙ্কে ভদ্রলোকের প্রচুর টাকা যার একমাত্র উত্তরাধিকারী হচ্ছে আমাকে পত্র লেখা এই কন্যা। কিন্তু সে এই টাকা নিতে পারছেনা, কারন তার (ভিলেন) চাচা তাকে ঘরের বাইরে যেতে দিচ্ছে না, যদি আমি তাকে বিয়ে করি তবে সে তার চাচার অধীন থেকে মুক্ত হয় আর আমার সাথে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে টাকা নিবে, আমাকে টাকার শেয়ার দিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। হায়রে নাদানের কপাল! এইসব মেইল আসবি যখন ভালোভবেই আয়, স্প্যাম হয়ে কেন যে আসে!

ম্যাক্সপেইন

ম্যাক্সপেইন গেমের সাথে পরিচয় ইন্টারে থাকতে। যদ্দূর মনে পড়ে, চাচাতো ভাই আরেফীনের কাছ থেকে গেমটার সিডি নিয়েছিলাম। টানা সাতদিনে শেষ করেছিলাম গেমটা। কী একখান গেম! বুঝাই যায়না যে গেম খেলছি না মুভি দেখছি। এমনো হয়েছে যে যখন খেলছি তখন পিছন থেকে দেখে অনেকে জিজ্ঞেস করেছে যে এই মুভিটার নাম কি! তো যখন দেখলাম যে এই গেমের মুভি মুক্তি পেয়েছে, মোটেও দেরী করলামনা। দ্বিতীয় সপ্তাহের মাথায় গেলাম মুভি দেখতে প্যাথে সিনেমা হলে, সঙ্গী এরিক। পাঁচটার সময় গিয়ে শুনি যে নেক্সট শো হবে ছয়টায়, এক ঘন্টার ধাক্কা! দুইজনে কিছুক্ষন খাওয়া দাওয়া করে, সিনেমাহলের সামনে রাখা ফ্রী পিএস-থ্রী তে গেম খেলে ছয়টার কিছু আগে ঢুকলাম সিনেমা হলে। এবং আমরা দুজনেই ছিলাম সেই শোর প্রথম দুই দর্শক- পুরা হল খালি!

আমার সন্দেহ হল আমরা বোধহয় ভুল করে অন্য কোন হলে ধুকে গেছি (কারন এরকম আরো আটখান থিয়েটার হল আছে ঐ কম্পাউন্ডে)। এরিক দেখি নির্লিপ্তভাবে সামনের অন্ধকার পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে বললাম আমার সন্দেহর কথা কিন্তু ও পুরা নিশ্চিত যে আমরা ঠিক হলেই ঢুকেছি। আমি যখন প্রায় নিশ্চিত যে আমরা ভুল জায়গায় খামাখা বসে আছি তখন দেখি দুইজন-চারজন করে লোকজন ঢুকছে। দুইজন-চারজন বললাম এই কারনে সবাই জুটি বেঁধে একে একে ঢুকছে। মারমারকাটকাট ছবি দেখতে প্রেমিক জুটি আসে এই প্রথম দেখলাম! (আমার ধারনা ছিলো কেবল রোমান্টিক আমি-তুমি মার্কা ছবিগুলো কেবল জুটিরা দেখে।)

একেরপর এক এ্যাড দেখিয়ে যখন ছবি শুরু হল তখন আমার আক্কেল গুড়ুম! কারন ছবি শুরু হল একটা মিষ্টি মিষ্টি গানের সুর দিয়ে। ম্যাক্স পেইনের মত ভয়াবহ মারামারির ছবিতে এরকম মিউসিক বেশ দুঃখজনক। কোথায় রক্ত গরম করা মিউজিক থাকবে তা না কেমন একটা শান্তি শান্তি ঘুমপাড়ানি মিউজিক! এরপরের কাহিনী আরো হতাশাজনক। স্ক্রীনজুড়ে এক টিনেজ মেয়েকে রঙ্গিন জামা পড়ে ছুটোছুটী করতে দেখা গেল- যেকোন রোমান্টিক ছবির প্রথম দৃশ্য। এইবার আমি ড্যাম শিওর যে এরা ভুল ছবি ছেড়েছে। হলের মধ্যে দেখি সবাই আমার মতই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এরিককে বললাম যে চলো কমপ্লেইন করে আসি। এরিক সাদাসিধা মানুষ- ঝামেলায় যেতে চায়না, বলল এইটাই দেখি সমস্যা কি! ছেলে বলে কি! খামাখা ২০ ইউরো দিয়ে এই ফাউল টিন-মুভি দেখতে আসছি নাকি! ততক্ষনে স্ক্রীনে টিপিক্যাল টিনেজ মুভির মত হাই স্কুলের করিডর ধরে নায়কের বাস্কেটবল নিয়ে দৌড় শুরু হয়ে গেছে। কপাল ভালো, কিছু সহৃদয় জুটি তখনই উঠে কম্পলেইন করায় ম্যাক্সপেইন শুরু হয়। Continue reading রঙ্গীন দুনিয়া – ৫

রঙ্গীন দুনিয়া – ৪

রবাসী ঈদ

প্রথম বারের মত দেশের পরিচিত গন্ডীর বাইরে ঈদ করলাম। যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম ততটা খারাপ হয়নি। ঈদের দিন সকালে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম যে কপালে যাই থাকুক, ক্লাসে যাবনা। সারা জীবন ঈদের দিন কখনো ক্লাস করিনাই, এইবারই বা কেন করব? ঈদ মানে ছুটি। সিদ্ধান্তটা নেবার পর থেকেই মনটা বেশ হাল্কা হয়ে গেল। সকাল থেকেই ছিলো মুষলধারে বৃষ্টি। শেষ কবে ঈদের নামায মিস করেছিলাম মনে করতে পারছিলামনা। তার উপর প্রথম বৈদেশিক ঈদের নামাজ, মিস দেবার কোন কারনই দেখিনা। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গেলাম ঈদের নামায পড়তে। অবশ্য একা না, সঙ্গে ছিল মামা, খালু আর এরিক (খালাত ভাই)।

ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়েছে এক ইনডোর বাস্কেটবল কোর্টে। জামাতের ইমাম আবার পাকিস্তানী। এখানেও দেখি পুরা বাংলা স্টাইল। পিছন থেকে কিছু লোক বিভিন্ন আঙ্গুল দিয়ে ইমামকে ইশারা করছিল। অভিজ্ঞ বাঙ্গালী মাত্রই জানে এই ইশারা আসলে টাকা কালেকশনের ইশারা। পাঁচ আঙ্গুল দেখানোর মানে হল ইমাম যেন পাঁদ মিনিট পর জামাত শুরু করে, টাকা তোলার তখনো বাকী। ইমামও তাঁর অনুসারীদের একান্ত বাধ্যগত, টাকা কালেক্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত নামাজ শুরু করলোইনা। দশটার নামাজ সাড়ে দশটায় শুরু হয়ে একসময় শেষ হয়ে গেল। এবার কোলাকুলির পালা। সবাই যখন কোলাকুলিতে ব্যস্ত তখন দেখি এক লোক কিছুক্ষন পর পর আমাকে দেখছিলো। এক সময় আমার কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ঈদ মুবারাক, আপ রাজ হ্যায়না?। পাইক্কা (পাকিস্তানী) পাবলিক; উর্দুতে কথা বলছে। আমার হিন্দী-উর্দুর দৌড় আবার করেঙ্গা-মারেঙ্গা-ধরেঙ্গা পর্যন্ত। হিন্দী মুভি দেখতে বসলে আমার প্রধান সম্বল হয় ইংলিশ সাবটাইটেল! সাবটাইটেল না থাকলে শিল্পীদের আকার-ইঙ্গিত দেখে হাল্কার উপর ঝাপ্সা দিয়ে কাহিনী মোটামুটি বুঝে নেই। যাই হোক, আগের কথায় ফেরত যাই। একজন পাইক্কা আমাকে রাজ ভেবে ভুল করছে, তাকে শোধরানো উচিত। আমিও আমার হিন্দী জ্ঞান সম্বল করে পালটা জবাব দিলাম, ঈদ মুবারাক, নেহি চাচা, সরি!
লোক বেশ অবাক-
আপ জানতে হ্যায়, আপকো সুরৎ রাজ য্যায়সা হ্যায়!
জান্তা হু! মাথা নেড়ে বললাম।
লোকটা আরো অবাক-
আপ জানতে হ্যায়! ক্যায়সে?
নাহলে আপ মুঝে নেহি জিগাতা হ্যায়। আমার এই কথায় বেচারা কি বুঝল কে জানে বেশ সমঝদারের মত মাথা নেড়ে চলে গেল। একজন লোকের চেহারা রাজের মত, কিন্তু সে রাজ না, এই ব্যাপারটা আবার সেই লোক জানে একজন পাইক্কাকে বিভ্রান্ত করার জন্য এর চেয়ে জটিল কিছু মনে হয় দরকার হয়না! Continue reading রঙ্গীন দুনিয়া – ৪

রঙ্গীন দুনিয়া -৩

হাসি কয় ধরনের? বাঙ্গালী হিসেবে আমি মাত্র চার ধরনের হাসি জানতাম – লাজুক হাসি, মুচকি হাসি, অট্টহাসি আর বাঁকা হাসি। (এর মধ্যে আবার চার নম্বরটা কেবল শুনেই এসেছি কখনো দেখলাম না!) এর বাইরে কি হাসি হয়না? হয় হয়, না হলে হাসি নিয়ে এই বেলা হাঁসফাঁস করতামনা। ইউরোপে পুরো সমাজ ব্যবস্থাটা চলে হাসি’র উপর। গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে পাশের গাড়িতে লেগে গেল তাহলে দিতে হবে অপরাধবোধ হাসি। এলিভেটরে কারো সাথে দেখা হলে আসবে সৌজন্যমূলক হাসি। ব্যাঙ্কে গেলে রিসিপশনের মানুষটি দিবে সম্ভাষনসূচক হাসি, এর উত্তরে তখন প্রত্যুত্তরমূলক হাসি দেবার নিয়ম। এভাবে আরো আছে অনুরোধমূলক হাসি, ভদ্রতামূলক হাসি, অনুযোগমূলক হাসি, অবুঝ হাসি, বঞ্চনামূলক হাসি, ভুল শোধরানোর হাসি, অপরাধমূলোক হাসি, ভয়ের হাসি (যদিও এই হাসি আমি কখনো দেখি নাই), সম্মানসূচক হাসি, দুঃখমূলক হাসি, ভালোবাসার হাসি (এখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি), এমনি এমনি হাসি; আরো কত ধরনের হাসি! এখনো সব খুঁজে বের করতে পারিনি। তবে এমন অনেকে আছে হাসতে হাসতে যাদের মুখের কাটিংটাই পারমানেন্টটলি হাসি হাসি হয়ে গেছে। এই প্রজাতির হাসিগুলো হয় বেশ বিভ্রান্তিমূলক। কারন এরা মুখ সামান্য ফাঁক করলেই মনে হয় এরা হাসি দিচ্ছে, হাসিটা কোন ক্যাটাগরির সেটা সহজে বোঝা যায়না।

নেদারল্যান্ডসে একটা প্রবাদ আছে “Be aware of four Ws: Wine, Wealth, Women and Weather!”. এখানকার আবহাওয়াকে মোটেই বিশ্বাস করা যায়না। এই হয়তো ফক্‌ফকা নীল আকাশ, হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই পুরো আকাশ কালো হয়ে ঝপ করে বৃষ্টি নেমে গেল। পুরো ব্যপারটা হয়তো বড়জোড় তিন মিনিটে ঘটে গেল! এর কিছুক্ষণ পরই আকাশ আবার পরিষ্কার। তবে আকাশ যখন পরিষ্কার থাকে তখন পুরোপুরি নীল আকাশ। নীল আকাশ তার মাঝে সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। ঢাকায় শেষ কবে নীল আকাশ দেখেছি মনে করতে পারিনা, দেশ ছেড়ে আসার আগেও যে আকাশ দেখে এসেছিলাম সেটা ছিল ধোঁয়া আর ধূলায় ঢাকা ছাই-রঙ্গা ম্যাটম্যাটে একটা আকাশ। বিকেল হলেই দেখা যায় ঝাঁক বেঁধে পাখিরা সব নীড়ে ফিরছে। এখানে বক, হাঁস আর গাংচিলই বেশি চোখে পড়ে। কাকও যে নাই তা না, কাক আছে তবে এদের সাইজ ঢাকার কাকের সাইজের প্রায় অর্ধেক। আমাদের দেশের ডাহুকের মত দেখতে এক ধরনের পাখি দেখা যায় আর দেখা যায় টিয়া পাখি। বিকেল হলেই কোত্থেকে যেন শত শত টিয়া পাখি গাছগুলোতে এসে ভীড় জমায়। ঢাকায় কখনো এমন দেখেছি বলে মনে পড়েনা।

ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় নেদারল্যান্ডস অনেকটা সমতল। ফলে দেখা যায় এখানকার বেশিরভাগ (অথবা সবাই) মানুষই সাইকেল ব্যবহার করে। এই দেশের প্রত্যেকটা রাস্তায় সাইকেলের জন্য আলাদা আলাদা লেইন আছে। এরা আবার সাইকেলকে বলে “ফিয়েটস”। সাইকেলের রাস্তাগুলো এত চমৎকার যে কেউ ইচ্ছে করলেই বেশ সহজেই সাইকেল নিয়ে পুরো নেদারল্যান্ডস ঘুরে আসতে পারে। এদের ট্রেন স্টেশনগুলোতে সাইকেল পার্ক করার আলাদা জায়গা আছে। সে সব জায়গায় দশ-বিশটা না, শত শত সাইকেল পার্ক করা থাকে। অনেক সময়ই দেখা যায় যে সাইকেলের সংখ্যা পার্কিং প্লেস ছাড়িয়ে পাশের রাস্তায় গিয়ে পড়ে!
Continue reading রঙ্গীন দুনিয়া -৩