বন্ধুহীন পরিণতবেলা হতে পারে কিন্তু বন্ধুহীন ছেলেবেলা হয়না। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায় কথাটা আসলেই ঠিক। ছেলেবেলা বন্ধুহীন কাটিয়েছে এমন কয়জন পাওয়া যাবে? সংখ্যাটা হাতে গোনা যাবে। তবে বন্ধুত্ব যে সব সময় মানুষের সাথে করতে হবে এমন কোন কথা নিশ্চয়ই নেই। অনেকের ছোটবেলার খেলার সাথী থাকে বাসার পোষা বিড়াল বা কুকুরছানা অথবা টিয়া পাখি কিংবা নিদেনপক্ষে মুরগী। মুরগী বললাম এই কারনে যে শিশুবেলায় আমার নিজেরই মুরগী প্রজাতির সাথে বেশ প্রগাঢ় সম্পর্ক ছিল। সেই কাহিনীতে আসছি একটু পরেই। তবে এক দিক দিয়ে আমি মনে হয় সবাইকে টেক্কা দিয়েছি। কারন ছোটবেলাতে আমার মানুষ আর অন্য প্রাণীকূলের চেয়ে সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল মনে হয় অনুজীবকূল!
আরেকটু খোলসা করে বলা যাক। ছোটবেলায় রোগবালাই ছিল আমার নিত্য সাথী। অনেকটা টেনিদা’র প্যালারামের মত। অনেক চেষ্টা করেছি ওসব অনুজীবদের সাথে আড়ি নেবার জন্য, কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়তোনা। কী করিনাই! হোমিওপ্যাথ, এ্যালোপ্যাথ, কোবরেজী সব ট্রাই মেরেছি। কিন্তু সেই বন্ধুদের ফেরাতে পারিনি। হাতেগোনা কয়েকটা অসুখ বাদে মনে হয় সব অসুখ হয়ে গিয়েছিল। সব ডাক্তারের যখন আমাকে দেখে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন আমার ভার পড়ল দাদীর উপর। আমার দাদী আবার লতাপাতা দিয়ে চিকিৎসা করতে খুব পছন্দ করতেন। আশেপাশের সবার কাছে দাদী ছিল অঘোষিত ডাক্তার। আর আমি ছিলাম সেই অঘোষিত ডাক্তারের ঘোষিত গিনিপিগ। এখনও মনে পড়ে, সকাল বেলা দাদু বাজারে যাবার জন্য বের হলেই দাদী তাকে ভেষজ লতা পাতার একটা লিস্ট ধরিয়ে দিতেন। সেই লিস্ট মেনে দাদু সবসময় জিনিসপ্ত্র এনে দাদীর হাতে তুলে দিতেন। এরপর শুরু হত দাদীর চিকিৎসা। রোগ সারাবার চিকিৎসা হিসেবে কাঁচা শাপলা থেকে থানকুনী পাতা বা দুর্ব্বা ঘাস সবই আমাকে খাওয়াতেন। চিরতার রস ছাড়া আমার সকাল শুরু হবে ভাবাই যেতনা। দুপুর আর রাতে শিং মাছের ঝোল দিয়ে জাউ ভাত ছিল আমার জন্য ধ্রুব সত্য। কিন্তু এত কিছুর পরও পরিচিত মহলে ভীষণ সফল এই চিকিৎসক কেবল আমার কেসেই নীরব হয়ে যেতেন। আমি ছিলাম তার একমাত্র ব্যর্থতা!
বয়সকালে এসে রোগবালাই চলে গেলো। একেবারেই যে চলে গেলো তা না। এখনো তারা মাঝে মাঝে আসে, তবে কিনা অনেকদিন পর পর। এই অনুজীব গোত্রের পাশাপাশি আমার আরেক ধরনের বন্ধু ছিলো। তবে আগের গোত্রের মত তারা আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি, এখনো আছে আমার সাথে। এই নতুন গোত্র হল বই (পাঠ্য বই না কিন্তু)। ছোটবেলায় আমার নিত্য সঙ্গী ছিলো ফেলুদা, শঙ্কু, শার্লক হোমস, ক্যাপ্টেন নিমো বা টেনিদা। স্কুলের বইয়ের ভিতর রেখে পড়তাম চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কী, চান্নি চাচী, রমন; এমনকি হী ম্যান, থান্ডারক্যাটস্, স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান কোন কিছুই বাদ যায়নি। সমস্যা হত নন্টে ফন্টে, বাটুল বা হাদা ভোদা নিয়ে। এদের সাইজ বড় ছিলো বলে স্কুলের বইয়ের ভিতর আটতনা। টিনটিন বা এস্টেরিক্স নষ্ট হয়ে যাবে বলে কখনো স্কুলেই নিতামনা। ক্লাস সিক্সে উঠার পর জাফর ইকবালের বইয়ের সাথে পরিচয়। প্রথম পড়ি “দুষ্টু ছেলের দল”। ছোটদের নিয়ে ছোটদের মত করে যে উপন্যাস থাকতে পারে সেটা আমি প্রথম টের পেলাম ঐ বই দিয়ে। পাশাপাশি চলত সেবা প্রকাশনীর বিভিন্ন অনুবাদ আর বিখ্যাত তিন গোয়েন্দা সিরিজ। সেসময় “গোয়েন্দা রাজু” নামে আরো একটা সিরিজ ছিলো যেটা পরে বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থ্রিলারের জগতে আমার প্রবেশ। রবার্ট লুডলাম, টম ক্ল্যান্সি বা সিডনী শেল্ডন আমার ব্যাগে এখনো আমার সাথে ঘুরোঘুরি করে। এত বড় হয়ে গেছি তারপরো আমি এখনো হ্যারি পটার কিংবা নন্টেফন্টে বা টিনটিন পড়ি। এগুলো কতবার যে পড়েছি কোন তার কোন ইয়েত্তা নাই, তারপরও পড়ি, প্রতিবারই আমার কাছে তা নতুন লাগে। যখন এইসব বাচ্চাদের বই পড়ি তখন একবারের জন্যও মনে হয়না যে কাহিনী গুলো গাঁজাখুরি। এই লেখা যখন লিখছি, তখন আমার টেবিলে টিনটিনের “The Castafiore Emarald” বইটা পড়ে আছে।
লেখার শুরুতে এক মুরগীর কথা লিখেছিলাম। আমার প্রিয় সেই মুরগীর নাম ছিল “কাজলী”। চিক্চিকে কালো ছিলো দেখতে। সেই মুরগীর পর আরেকটা মুরগীর আমদানী হয় বাসায়। দেখতে লাল দেখে ঐটার নাম ছিল “লালী”। বিশাল লম্বা রশি দিয়ে সবসময় এদের পা বেঁধে রাখতাম, বাঁধা না থাকলে যদি পালিয়ে যায়! নানুর বাসায় প্রতি রাতে কোথা থেকে এক কুকুর আসতো। বেশ বড়সড় সাদা রঙের কুকুর। রাতের বেলা বাসার এঁটো খাবার খেতো আর সারা রাত বাসার সামনে বসে পাহারা দিত। কুকুরটাকে দিনের অন্য বেলায় খুব একটা দেখা যেতনা। নানু আদর করে ওকে বাবলু নামে ডাকতো। একদিন দেখি কারা যেনো বাবলুর পেছনের এক পা ভেঙ্গে দিয়েছে। দেখে এত কষ্ট লাগলো যে বলার মত না! এর পর যতদিন বাবলুকে দেখেছি ততোদিন ওকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি। একদিন হঠাৎ করেই বাবলু নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আর কোন দিন দেখি নাই ওকে। এখনো রাস্তাঘাটে সাদা কুকুর দেখলে বাবলুর কথা মনে পড়ে।