যখন ছোট ছিলাম তখন পত্রিকার ছোটদের পাতাগুলো (নামগুলো এখন ভুলে গেছি) খুব মনযোগ দিয়ে পড়তাম। পাতাটির আগাগোড়া ভাজ ভাজা হয়ে পড়া হয়ে যেত। তবে প্রতি সপ্তাহে মাত্র একটা ছোটদের পাতায় কী আর পোষায়? আর প্রতিটি পাতাই ছিল একই রকম – একটা কি দুইটা গল্প, কয়েকটা ছড়া, কখনোবা বিখ্যাত কারো কবিতা হয়তো একটা–দুইটা থাকতো, কয়েকটা জোক্স, আর আমার মতই ছোট্ট ছোট্ট পাঠকদের আঁকা কয়েকটি ছবি – এইতো! এতটুকুতেই পুরে যেত পুরো একটা পাতা – সব একঘেঁয়ে ব্যাপার স্যাপার। তারপরও ছোটদের পাতাটুকুকে আপন মনে হত খুব – মনে হত যেন বড়দের শুকনো পত্রিকার মাঝে নিজের একটা রঙিন পৃথিবী! কত আগ্রহ নিয়ে থাকতাম সপ্তাহে এই পাতাটির জন্য!
তারপর একসময় পরিচিত হলাম “কিশোর তারকালোক” নামে একটা ম্যাগাজিনের সাথে – ম্যগাজিনটা কিশোরদের জন্য ছিল। একটা পুরো পত্রিকা তাও আবার আমাদের মত বাচ্চাদের জন্য – ভাবা যায়? একটা সংখ্যা পড়েই তাই নিয়মিত রাখা শুরু করলাম। কিশোর তারকালোক ছিল মাসিক পত্রিকা। সেসময়ই পরিচয় হল “টইটম্বুর” আরেকটি শিশুকিশোর মাসিকের সাথে। বাসায় প্রতি মাসে দুটো করে ম্যাগাজিন রাখা শুরু হল। প্রতি মাসের শুরুতেই বসে অপেক্ষা করে থাকতাম কখন হকার দিয়ে যাবে পত্রিকা দু‘টো। তারপর পরিচয় হল “কিশোর পত্রিকা“র সাথে। চমৎকার একটা পত্রিকা ছিল সেটি। গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস, কমিক্স, ফিচার – কী নেই তাতে! সম্ভবত বাংলাদেশে কিশোর পত্রিকাই প্রথম কিশোরদের জন্য পত্রিকা যাতে দারুণ সব কমিক্স ছাপানো হত! কিশোর পত্রিকা এতই ভালো লেগে গেল যে অন্য সব পত্রিকা বন্ধ করে বাসায় এটাই নিয়মিত রাখা শুরু হল। তারপর একসময় এটা বন্ধ হয়ে গেল। সম্ভবত এটাই ছিল বাংলাদেশের কিশোরদের জন্য মান সম্মত একমাত্র দুর্দান্ত পত্রিকা। তারপর “ছোটদের কাগজ” নামে একটা পত্রিকা বের হত, সেটাও পড়েছি কিছুদিন, কিন্তু কিশোর পত্রিকার অভাব কেউই পূরণ করতে পারেনি। কিশোর পত্রিকার সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল সম্ভবত তারাই প্রথম কেবলমাত্র কিশোররা কী চায় – তা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। আর কোন পত্রিকা সেটি পারেনি। পরে একসময় পশ্চিম বাংলা থেকে বের হওয়া “আনন্দমেলা” পত্রিকাটাও রাখতাম, বিশেষ করে পূজাসংখ্যাগুলো কিনা হত নিয়মিত। এখনো আমার ছোটবোন নিয়মিত প্রতিবছর আনন্দমেলা‘র পূজাসংখ্যাগুলো কিনে যাচ্ছে।
নিজের দেশের কিশোরদের জন্য একটা মানসম্মত পত্রিকার অভাব সমসময়ই অনুভব করেছি। এই অভাব অনুভব করে আমার ছোট বোন “প্রথম আলো“র আনিসুল হককে একটা ইমেইলও করেছিল গত বছর। এবং ইমেইলের জবাবে সে জানতে পারে যে প্রথম আলো পহেলা বৈশাখে “কিশোর” নামে একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুনে যে ও কী খুশি হয়েছিল বলার মত না! “কিশোর” বের হবার প্রথম দিনেই ওটা কিনে এনেছিলাম – তারপর দুই ভাইবোন মিলে গোগ্রাসে সেটা পড়ে ফেলেছিলাম! খুশিটা আরো বেড়ে গেল যখন শুনলাম যে প্রথম আলো কিশোরদের জন্য মাসিক একটা পত্রিকা বের করতে যাচ্ছে, যার নাম “কিশোর আলো” (কিআ)। খুশিতে বিষম খাবার জোগাড়! পয়লা অক্টোবর আমি অফিস থেকে ফেরার পথে অনেকগুলো পত্রিকা স্টল ঘুরেও কিআ‘র কোন নাম নিশানা পেলামনা, কিআ ফুরিয়ে গেছে! বাসায় এসে দেখি আমার ছোট বোন একটা কিআ জোগাড় করে ফেলেছে! কিআ হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টেই মনটা ভরে গেল। সুন্দর কাগজে ঝকঝকে ছাপার অক্ষর আর চকচকে সব ছবি – দেখেই মনের মাঝে কে যেন বলে উঠল – এবার বুঝি বাংলাদেশের কিশোর অভাব পূরণ হতে যাচ্ছে!
এককথায় কিআ প্রথম সংখ্যা থেকেই চমৎকার সজ্জা নিয়ে হাজির হয়েছে। অন্য পত্রিকাগুলোর সাথে তুলনায় কিআ একেবারেই নিখুঁত। কী আছে কিআ‘তে? একঝলকে বললে বলতে হয় – প্রতিবেদন, ধারাবাহিক উপন্যাস, উপন্যাস, গল্প, কমিক্স, অর্থনীতি, বাংলার উদ্যোমী ছেলেমেয়েদের কথা, ধ্রুপদী লেখা, কবিতা, ছড়া, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য নিয়ে নিবন্ধ, ফ্যাশান, খেলাধূলা, বিভিন্ন মজার মজার আর্টিকেল, অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী, জাদুর কলাকৌশল, গণিত, সাক্ষাৎকার – আরো কত কী! প্রতিটি লেখাই প্রাঞ্জল – কিশোরদের জন্যই লেখা সব! ১২৮ পৃষ্ঠার মাঝে শিশু–কিশোরদের জন্য চমৎকার খোরাক এটি। তবে আমার মনে হয় কিআ যদি কিছু কিছু ব্যাপারে আরেকটু মনযোগী হয় তবে ভবিষ্যতে আমরা আরো সুন্দর সুন্দর কিআ পাব। তাহলে ব্যাপারগুলো কি কি?
প্রথমতঃ কিআ‘র উপন্যাসগুলোকে আসলে উপন্যাস না বলে বড়গল্প বললে আরো ভালো হয়। রকিব হাসানের “প্রেতসভা” আর আহসান হাবীবের “স্কুলে একদিন” – এ দুটোই আমার কাছে বড়গল্প বলেই মনে হয়েছে। একটি মাত্র চৌদ্দ পৃষ্ঠার আরেকটি মাত্র সাত পৃষ্ঠার। তাই এ ধরণের লেখাগুলোকে ভবিষ্যতে উপন্যাস না বলে বড়গল্প হিসেবে দেয়া উচিৎ। তবে মুহম্মদ জাফর ইকবালের “টুনটুনি ও ছোটাচ্চু” ধারাবাহিক উপন্যাস হিসেবে দারুণভাবে মানিয়ে গেছে।
দ্বিতীয়তঃ কমিক্সগুলোর আঁকা খুবই দারুণ এবং কাহিনীও চমৎকার (বিশেষ করে জংলী বাবু দুর্দান্ত হয়েছে)। তবে কাহিনীগুলো আরো চমৎকার হওয়া দরকার। কিশোরপত্রিকায় তারিকুল ইসলাম শান্ত‘র কয়েকটি কমিক্স বের হত – ধুরন্দর ও পাখোয়াজ, পটকার খটকাবাজী, টুটু পুটু কুটু। আঁকা এবং লেখা – দুটোই ছিল দুর্দান্ত। এসব মানের কমিক্স চাইতে ইচ্ছা করছে কিআ‘র কাছে। টিপ্স হিসেবে কয়েকটি কথা বলতে পারি।
-
অন্তত একটা চরিত্রনির্ভর কমিক্স প্রতিটি সংখ্যায় রাখা যেতে পারে (যেমন প্রথম আলোতে আছে বেসিক আলী ও ন্যান্সি)। তবে মনে হচ্ছে “জংলীবাবু”কে হয়তো পরবর্তী সংখ্যাগুলোতেও দেখা যাবে।
-
বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাস বা গল্পকে কমিক্সে রূপান্তর করা যেতে পারে। যেমন– হুমায়ুন আহমেদের বোতলভূত, কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবালের একগাদা উপন্যাস, অথবা তিনগোয়েন্দার কোন একটা অভিযান ইত্যাদি।
-
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত কোন সুপার–হিরো কমিক্স আসেনি। কিআ কি আনতে পারবে এরকম কোন সুপারহিরো? দেশী সুপারহিরো?
তৃতীয়তঃ বিজ্ঞান ও কম্পিউটার প্রযুক্তি নিয়ে প্রতি সংখ্যাতেই আলাদাভাবে দুটি বিভাগ থাকতে পারে। বিজ্ঞান বিভাগে বাংলাদেশের বিজ্ঞানের বর্তমান অগ্রগতি, বিজ্ঞানীদের নতুন কোন আবিষ্কার বা বিজ্ঞানের কোন কঠিন জিনিস সহজ ভাবে ব্যাখ্যা ইত্যাদি থাকতে পারে। কম্পিউটার প্রযুক্তি বিভাগে বিভিন্ন কম্পিউটার সফটওয়ারের কথা লেখা যেতে পারে। যেমন – কোন পর্বে অভ্র কিবোর্ড নিয়ে লেখা যেতে, কোন পর্বে হয়তো মুক্ত সফটওয়্যার নিয়ে লেখা যেতে পারে।
চতুর্থতঃ যদি সম্ভব হয় তাহলে কিআ‘র সাইজটা আরেকটু বড় করা যায় কীনা! আর বিশেষ দিনে (যেমন ঈদ ও নববর্ষ) অবশ্যই বিশাল সাইজের কিআ বের করা দরকার।
আমার এই পরামর্শগুলোকে অন্যভাবে না নেবার অনুরোধ রইলো, এগুলো কিআকে আরো সুন্দর করার জন্য আমার ছোটখাট একটা প্রয়াস। কিআ‘র ফেসবুক পেজে গেলেই দেখা যায় যে প্রচুর মানুষ এর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। একটা মানসম্মত কিশোরদের পত্রিকা বের করার জন্য তাদের সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও প্রানঢালা শুভেচ্ছা।
ভাল কথা, আমি কিন্তু কিশোর কেউ নই, কৈশর পেরিয়েছি অনেক আগেই। আমার ছোটবোন কিন্তু আসলে ছোট নয় – ও বুয়েটে স্থপতিবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। কিন্তু তারপরও নিজের ভেতর কোথায় যেন একটা কিশোর এখনো আটকা পড়ে আছে, তাই কিশোরদের জন্য কাউকে কিছু করতে দেখলেই ভেতর থেকে একধরণের শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠে। কিআ‘র সাথে জড়িত সবার প্রতি রইল সেই শ্রদ্ধা নিঙড়ানো ভালবাসা।
খুব ভালো কিছু পরামর্শ । আশা করি আনিসুল হক স্যার কথা গুলো রাখবেন ।
আমি কিশোর আলোর বড় ভক্ত এবং আমি আশা করি যে প্রথম আলো এই পত্রিকার উদ্যোগ কখনো বন্ধ করবে না এবং আপনার পরামর্শগুলো পড়ে আমার ভালো লেগেছে