স্বপ্ন তো আমরা কতই দেখেছি এবং দেখেও যাচ্ছি। কিন্তু দেখে যাওয়া স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবতায় রূপ দিতে হয় সেটা ক’জনেরই বা জানা আছে? আমাদের বেশিরভাগেরই দৌড় কেবল ঐ স্বপ্ন দেখা পর্যন্তই। স্বপ্ন দেখে সেটাকে আঁকড়ে ধরে কীভাবে তাকে বাস্তবে গড়ে নিতে হয় সেটা দেখিয়েছেন খিজির হায়াত খান! “জাগো” সিনেমাটিতে তিনি একদল তরুণের গল্প শুনিয়েছেন, যারা দেশের টানে উজ্জীবিত হয়ে অসম্ভব এক অধরা স্বপ্নকে টেনে হিঁচড়ে বাস্তব জগতের মাটিতে নামিয়ে এনেছে।
সিনেমাটির কাহিনী গড়ে উঠেছে কুমিল্লা শহরের আজাদ বয়েজ ফুটবল ক্লাবকে ঘিরে। “আজাদ বয়েজ ফুটবল ক্লাব” ছোটখাট একটা ফুটবল ক্লাব – যেখানে পাড়ার তরুণ ছেলেরা মনের আনন্দে ফুটবল খেলে থাকে। সেই ছেলেদেরই কয়েকজন হচ্ছে তুহিন, রাফি, জয় আর মেসবাহ। তুহিনের বড় ভাই শামীম কুমিল্লার নামকরা উঠতি ফুটবলার। ঐতিহ্যগতভাবে প্রতি বছরই কুমিল্লা একাদশের সাথে অল ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ান ত্রিপুরা একাদশের দু’ম্যাচের একটা খেলা হয়ে থাকে। অতীতে কুমিল্লা একাদশ কখনই ত্রিপুরা একাদশের সাথে কোন ম্যাচে জয়লাভ করেনি। বরাবরের মত এবারও কুমিল্লা একাদশ প্র্যাকটিস করে যাচ্ছে। সবাই নতুন আশায় বুক বেঁধেছে যে এবার অন্তত হারের দুর্নাম ঘুচবে। এই আশার বৃত্তের কেন্দ্রে রয়েছে শামীম – যে নিজে খুব ভালো ফুটবলার এবং এবার কুমিল্লা একাদশের অধিনায়ক, যার নেতৃত্বে কুমিল্লা একাদশ নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে মুখিয়ে আছে ত্রিপুরা একাদশের সাথে জয়লাভের জন্য। কিন্তু সবকিছু ভন্ডুল করে দেয় একটা সড়ক দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কুমিল্লা একাদশের পুরো টিমটাই খেলতে অক্ষম হয়ে যায়, অধিনায়ক শামীম হয়ে যায় প্যারালাইজড। ফলে কুমিল্লা আর ত্রিপুরার মধ্যকার দুটো ম্যাচই বাতিল হয়ে যায়। এরই মধ্যে একটি স্থানীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ত্রিপুরা একাদশের খেলোয়াড়রা কুমিল্লা একাদশকে বেশ তাচ্ছিল্য করে যা আজাদ বয়েজের ছেলেদের জন্য মেনে নেয়া সহজ হয়না। তুহিনের নেতৃত্বে আজাদ বয়েজের ছেলেরাই কুমিল্লা একাদশের শুন্যস্থান পূরণের জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়, ছুঁড়ে দেয় ত্রিপুরা একাদশকে চ্যালেঞ্জ। কিন্তু চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেই তো হয়না, ভাল প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষক দুটোই যে দরকার। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে প্রাক্তন ফুটবলার সাফু ভাই এবং স্থানীয় ফুটবল ফেডারেশনের সেক্রেটারি মুন্না। সাফু ভাইয়ের আরেক পরিচয় উনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ত্রিপুরার সাথে ম্যাচের আগে সাফু ভাইয়ের হাতে সময় মাত্র একমাস, এই একমাসের মাঝে আজাদ বয়েজকে পাড়ার একটা দল থেকে কুমিল্লা একাদশে পরিণত করতে হবে। সাফু ভাই নিবিড় অনুশীলনের জন্য পুরো দল নিয়ে কক্সবাজারে ক্যাম্পিং করেন। সেখানে তাঁর ছত্রছায়ায় দল কঠোর ও শৃঙ্খলাবদ্ধ এক অনুশীলনে অংশ নেয়। এর মাঝে টিভির এক নিউজ রিপোর্টার কক্সবাজার থেকে কুমিল্লা একাদশের ক্যাম্পিং নিয়ে নিউজ রিপোর্ট করে। কুমিল্লা একাদশের চ্যালেঞ্জের খবর সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কুমিল্লা একাদশ তখন আর শুধু কুমিল্লারই থাকেনা, হয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশের। ক্যাম্পিং শেষে আজাদ বয়েজ যখন কক্সবাজার থেকে ফিরে আসে তখন তারা আর পাড়ার কোন ফুটবল ক্লাব নয়, তারা তখন কুমিল্লা একাদশ। শুরু হয় ত্রিপুরা একাদশ বনাম কুমিল্লা একাদশের খেলা। প্রথম ম্যাচে অভিজ্ঞতার অভাবে ত্রিপুরা একাদশের কাছে যাচ্ছেতাই ভাবে হেরে যায় কুমিল্লা একাদশ। দলের সবার মনোবল ভেঙে পড়ে। কিন্তু সাফু ভাই ভেঙে পড়েননা, তিনি সকলকে উদ্ধুদ্ধ করেন পরবর্তী খেলাতে আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলার জন্য। কুমিল্লা একাদশ উপলব্ধি করে যে তাদের পেছনে কুমিল্লাই নয় বরং সমগ্র বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় ম্যাচের আগে কঠোর আরেক ধাপ প্রশিক্ষণে সকলে প্রথম ম্যাচের ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা করে। দ্বিতীয় ম্যাচের দারুণ উত্তেজনাকর খেলায় কুমিল্লা একাদশ বুঝিয়ে দেয় যে তারা শুধু শুধু ত্রিপুরা একাদশকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়নি। তারা একটা স্বপ্ন বুকে নিয়ে চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়েছিল। তারা বিশ্বাস করে – যে স্বপ্ন দেখতে সাহস করে, সে স্বপ্নকে সত্যি করতে পারে।
সিনেমাটির কী কী ব্যাপার ভালো লেগেছে? সত্যি বলতে কী, পুরো সিনেমাটিই অসাধারণ লেগেছে আমার কাছে। মোটেও গতানুগতিক বাংলা সিনেমার মত নয়। ক্যামেরার কাজ দারুণ। তাছাড়া কুমিল্লার ও কক্সবাজারের মনোরম লোকেশানগুলোকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যে দুটি ব্যাপার অবশ্যই উল্লেখ করার মত, তার মাঝে প্রথমটি হল অর্ণবের সুর করা গানগুলো (বিশেষ করে ‘সময় চুরি’ আর ‘পথে চলতে’), দ্বিতীয়টি হল গানগুলোর দুর্দান্ত কোরিওগ্রাফি। ফেরদৌস এবং তারিক আনাম নিজেদের অংশে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তবে তারিক আনামের চরিত্রকে আরো ব্যপ্তি দেয়া যেতে পারত – এতে করে বোধহয় সিনেমাটি আরো পরিপূর্ণ মনে হত। ম্যাচের কিছু কিছু দৃশ্য কিছুটা দুর্বল মনে হলেও, খোদা বক্স মৃধা’র দেয়া ম্যাচের ধারাভাষ্য সেটুকু পুষিয়ে দিয়েছে। খেলার শেষ ফলাফল আগে থেকেই অনুমান করা সত্ত্বেও টানটান উত্তেজনা অধীর আগ্রহ নিয়ে স্ক্রিনের সামনে বসে ছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পুরো ছবিটা দেখে কখনোই মনে হয়নি যে একঘেঁয়েমিতে ভুগছি। শুধু খেলা নয়, বরং কোচ ও খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত আক্ষেপ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, নিজেদের ইচ্ছা-আকাঙ্খা – সবই উঠে এসেছে এক এক করে। জাগো সিনেমাটির প্রধান দিক হলো এটিতে দেশপ্রেম ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ত্রিপুরা একাদশের বিরুদ্ধে কুমিল্লা একাদশের ফুটবল লড়াই দেখানো হলেও ছবির মূল প্রাসঙ্গিক দিক হয়ে উঠেছে অাঞ্চলিক ও ব্যক্তিগত সংকীর্ণতা দূর করে দেশের হয়ে বিজয়ের প্রত্যাশায় উজ্জীবিত একদল তরুণের লড়াই। সেই সাথে ছবির শেষে স্মরণ করা হয়েছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে। আমাদের প্রজন্ম বা তার পরবর্তী প্রজন্মের ক’জনই বা জানে যে একাত্তরের যুদ্ধে বাংলাদেশ নিয়ে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম দেশ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ফুটবল খেলার জন্য।
যাই হোক, একটা বিষয় প্রথমেই পরিস্কার করা দরকার ছিল – আমি বাংলা চলচ্চিত্রের একনিষ্ঠ দর্শক নই। নিয়মিত বাংলা চলচ্চিত্র দেখাও হয়না। শেষবার যে বাংলা সিনেমাটা দেখেছিলাম সেটা দেখেছিলাম নিছক কৌতুহল থেকে। সেই সিনেমাটির ট্রেইলার এবং সিনেমাটি সম্পর্কে বহু মানুষের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা বিভিন্ন জায়গায় পড়ে, নিজের মাঝে সিনেমাটি সম্পর্কে ভয়ানক কৌতুহল জেগে উঠে। এর মানে আবার এই না যে আমি আর্ট ফিল্মের চড়া দর্শক। আমি আর্ট ফিল্মও দেখিনা – ঐগুলো একদমই বুঝিনা বলে। এবার আসি “জাগো” সিনেমাটির কথায়। “জাগো” সিনেমাটা সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম ইন্টারনেটে, সিনেমাটির ট্রেইলার দেখে। কিন্তু পরবর্তীতে এ সিনেমাটি নিয়ে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা। সেদিন টিভি’র সামনে বসে চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে দেখি এক চ্যানেলে সিনেমাটি দেখাচ্ছিল। আমি যখন দেখা শুরু করেছি তখন ইতিমধ্যেই অর্ধেক পার হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কোন এক অদ্ভুত ভাল লাগায় ঐ আধা-আধি অংশ থেকেই স্ক্রিনের সামনে আটকে ছিলাম। সিনেমাটি আধা-আধি দেখার পর পুরোটা দেখার নেশায় খুঁজতে লাগলাম এর ডিভিডি। কোন এক আজব কারণে কোন দোকানেই এর ডিভিডি খুঁজে পাইনি। দিন কয়েক আগে এক দোকানে খুঁজে পেয়ে ডিভিডি কিনে নিয়ে বাসায় এনে আবার শুরু থেকে দেখা শুরু করলাম। পুরো সিনেমাটা দেখে মনটা দ্বিতীয়বারের মত অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে গেল!
অনেকেই হয়তো এর মাঝে ‘উই আর মার্শাল‘ সিনেমাটির ছায়া খুঁজে পাবেন। খুঁজে পাওয়াটা অযৌক্তিক না। কিন্তু জাগো যে অনেকটা ‘উই আর মার্শাল’ এর ছায়ার নীচে রয়েছে এটা বুঝতে আমার অনেক্ষণ লেগেছিল। সিনেমাটি যতক্ষণ দেখছিলাম ততক্ষণ একটিবারের জন্যও মনে হয়নি যে এটা অন্য কোন সিনেমা অবলম্বনে বানানো হয়েছে! হয়তো এটাই এই ছবির সবচেয়ে বড় দিক। অবশ্য খেলাধূলা নিয়ে এত এত সিনেমা হয়েছে যে যেকোন অ্যাঙ্গেল থেকেই দেখা হোক না কেন, কোন না কোন সিনেমার সাথে মিলে যাবার আশঙ্কা থেকেই যায়। হলিউডে খেলাধূলা নিয়ে প্রচুর ছবি হলেও বাংলাদেশে এর আগে খেলাধূলা নিয়ে কোন সিনেমা বানানো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাই খেলাধূলা ঘরানার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে বলা যায় যে “জাগো” পুরোপুরি সফল।
জাগো’র ট্যাগ লাইন দিয়ে এই লেখাটা শেষ করছি।
Dare to Dream
জাগো ফিল্মটা নিয়ে আপনার আলোচনাটা পড়ে আমার দেখার খুব ইচ্ছা করছে সিনেমাটা । কিন্তু কলকাতায় তো বাংলাদেশী সিনেমা বা গানের কোন আইনসন্মত ডিভিডি বা সিডি তো পাওয়া যায় না । তাই অপেক্ষায় রইলাম যদি কোনদিন ফিল্মটা এখানকার সিনেমাহলে বানিজ্যিকভাবে মুক্তি পায় ।
প্রসঙ্গত জানাই 1911 সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষে কলকাতার মোহনবাগান ক্লাব অত্যাচারি ব্রিটিসদের দলকে হারিয়ে প্রথমবার ফুটবলে IFA Shield জিতেছিলো এবং গোটা দেশ দেশপ্রেমের উন্মাদনায় ভেসে গেছিলো । তখন থেকে সমস্ত দেশনেতা এবং বিপ্লবী দেশভক্তরা মোহনবাগানপ্রেমী হয়ে যান । যাইহোক , ওই ঘটণাটা তারপর বিভিন্ন সিনেমায় বিক্ষিপ্তভাবে এলেও পূণাঙ্গ সিনেমা হিসাবে এই বছরই কলকাতায় বানিজ্যিকভাবে মুক্তি পেয়ে সাফল্যলাভ করেছে । নাম – ১৯১২ ॥
ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচী হিসাবে যদি এই ফিল্মদুটো বিনিময় করা যেত , তবে কত না ভালো হোত ॥ কিন্তু হায় , সেটা কি আর আমার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবো !
ছবিটি দেখার ইচ্ছে রইল। আমাদের যুব সমাজ স্বপ্ন দেখে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুক এ কামনায়।
ধন্যবাদ সুন্দর পোস্টের জন্য।
“অরুণোদয়ের তরুনদল” ও দেখতে পারেন। গান এবং কাহিনী – দুটোতেই দারুণ কাজ হয়েছে।