দ্যা স্পিড ডু অর ডাইঃ মরা-বাঁচার এক অনবদ্য (!) কাহিনী!

বাংলা সিনেমার সময়কালকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় – “খোঁজ-দ্যা-সার্চ এর আগের সময়” এবং “খোঁজ-দ্যা-সার্চ এর পরবর্তী সময়”। যারা অবাক হয়ে ভাবছেন যে খোঁজ-দ্যা-সার্চ আবার কী বস্তু – তারা দয়া করে এখান থেকে ঘুরে আসুন, বহুৎ ফায়দা হবে। খোঁজ-দ্যা-সার্চ নামের সেই কালোত্তীর্ণ মহাকাব্যের পর বাংলার মহানায়ক জলিল (ওরফে অনন্ত) বঙ্গবাসীর জন্য নিয়ে এসেছেন তার নতুন রোমান্টিক-সামাজিক-অ্যাকশন-মেলোড্রামা-সাইফাই-মিস্টেরিয়াস-সাইকোথ্রিলার-ফ্যান্টাসি ছবি “দ্যা স্পিডঃ ডু অর ডাই”। এতটুকু বললে আসলে কম হয়ে যায় – এই ছবিকে ইচ্ছা করলে দেশপ্রেম ভিত্তিক ছবি, কিংবা স্পোর্টস ছবি বা হরর এমনকি লাইভ অ্যাকশন অ্যানিমেশন ক্যাটাগরিতেও ফেলা সম্ভব। ইনফ্যাক্ট সব ধরণের ক্যাটাগরিতেই একে ফেলা সম্ভব। কী নেই এই সিনেমাতে! নায়ক, নায়িকা, অতি পাকনা শিশু শিল্পী, ধুমসি সাইজের চাকরাণী, স্যুট পড়া  ড্রাইভার, ম্যান ইন ব্ল্যাক বডিগার্ড, বাংলাদেশী পুলিশ, মালয়শিয়ান পুলিশ, অনেক প্লেন, বিশাল গাড়ির বহর, আলিশান সব বাড়ি, বিদেশী হোটেল, বিদেশী রেস্টুরেন্ট, অতিমানবীয় নাচ-গান, স্পিড বোট, জেটস্কি, ক্রুজার, মোটর বাইক, দুর্ধর্ষ ভিলেন, সাথে ফাউ ফাউ মহিলা ভিলেন, ভিলেনের সাঙ্গপাঙ্গ, বিশাল ভিলেন বাহিনী, ঘোড়া, ডাক্তারের দল, সমুদ্র, অস্ত্র, ডিজিটাল ঘড়ি, গ্যাস চেম্বার – এলাহী কারবার! এক কথায় লিখে শেষ করা যায়না। সিনেমার ক্যাটাগরি বিশ্লেষনে একটু পর আসছি। তার আগে সিনেমা সম্পর্কে বলে নেই। এ বিষয়ে কোন ভুল নেই যে এই সিনেমা এখন পর্যন্ত “খোঁজ-দ্যা-সার্চ এর পরবর্তী সময়” এর সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অপরিহার্য সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হবে।

Continue reading দ্যা স্পিড ডু অর ডাইঃ মরা-বাঁচার এক অনবদ্য (!) কাহিনী!

খোঁজ দ্যা সার্চ: খোঁজাখুঁজি’র এক কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য!

আমাদের বাংলা সিনেমার ইতিহাসে মহাকাব্যের সংখ্যা সম্ভবত হাতে গোনা – বেদের মেয়ে জোছনা (নাকি জোৎস্না?), রূপভান, নবাব সিরাজুদ্দৌলা ও সোহরাব-রুস্তম ছাড়া স্মৃতি হাতড়ে আর কিছু বের করতে পারলাম না। তবে ডাইহার্ড ফ্যানদের দাবীর মুখে মাহমুদ কলি, ওয়াসিম কিংবা ইলিয়াস কাঞ্চনের একগাদা রাজা-বাদশাহ-জমিদার-প্রজা টাইপ সিনেমাগুলোকে গোনায় ধরলে অবশ্য অন্য কথা, গুনতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলতে হবে। সেই সাথে যদি যুক্ত হয় কিংবদন্তী পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু’র নাম- তাহলে তো কথা নেই! সংখ্যা যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে! এ সব অবশ্য মহাকাব্যিক সিনেমার কথা। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমাদের এই সব মহাকাব্য গুনতে টুনতে হবেনা। কারণ আমাদের এই আলোচনা এসব মহাকাব্যিক বাংলা সিনেমা নিয়ে নয় বরং কালোত্তীর্ণ এক মহাকাব্য নিয়ে! আর এখনও পর্যন্ত বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ‘কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য’ কিন্তু একটিই নির্মিত হয়েছে, সেটা হল – “খোঁজ দ্যা সার্চ”!

Khoj the search

প্রথমেই একটা সাফ কথা জানিয়ে দেই – আমি বাংলা সিনেমার একনিষ্ঠ দর্শক নই। তাই আমার রিভিউকে রামায়ন ধরে নেবার কোন কারণই নেই। এই ছবি দেখার পর হাত এতই নিশপিশ করছিলো যে এর একটা রিভিউ না লিখলে বদহজম হয়ে যাবার জোগাড় হচ্ছিল। তাই নিজের হজমকে বদ হওয়া থেকে রক্ষা করতেই এই দাওয়াই। প্রশ্ন আসতেই পারে যে কেন এই ছবিকে “কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য” বললাম? এই সিনেমাটির ট্রেইলার দেখে যা ভেবেছিলাম, চাক্ষুষ পুরো সিনেমাটি দেখার পর মনে হচ্ছে যে “কালোত্তীর্ণ মহাকাব্য” বললেও এই ছবি সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করা হয়না। কিন্তু আর কোন বিশেষণ মাথায় এলোনা দেখে আপাতত এই বিশেষণেই থাকি। কালোত্তীর্ণ এই সিনেমাটির ‘দুর্ধর্ষ’ ট্রেইলার দেখে যারা এটাকে রস-কষহীন অ্যাকশন সিনেমা হিসেবে ভেবে নিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যেই বঙ্গদেশীয় কবি বলেছেন “চকচক করলেই সোনা হয়না” – ট্রেইলার দেখে সিনেমা বোঝা যায়না; অ্যাকশনের মোড়কে আবৃত এই সিনেমাটি আদতে আগাগোড়াই কমেডি একটা সিনেমা, আরো ভালো করে বললে ‘একটা ট্রেইলার’! জ্বী, ঠিকই শুনেছেন এটা একটা ট্রেইলার, বেশ বড়সর ধরনের ট্রেইলার, এই ধরুন গিয়ে পুরো দুই ঘন্টাব্যাপী বিশাল ট্রেইলার। কেন ট্রেইলার? সেই ব্যাপারে একটু পরে আসি, তারচেয়ে বরং চলুন কালোত্তীর্ণ এই মহাকাব্যের অন্য বিষয়গুলোও একটু দেখি।

সবার আগে আসুন নামকরণের ব্যাপারে। এই মহাকাব্যের নাম দেখে একজন অশিক্ষিত গন্ডমূর্খও বুঝবে যে এটা কত উঁচুমাপের সৃস্টি – ইংলিশ ও বাংলার মত দু’দুটো ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করতে হয়েছে এই সৃষ্টির নামকরণে। তাছাড়া নামটাও বেশ চিন্তাউদ্দীপক – “খোঁজ দ্যা সার্চ”। কিছু একটা খুঁজতে বলা হচ্ছে। কিন্তু কি খুঁজবেন? ঘোড়েল প্রশ্ন! তারচেয়েও ঘোড়েল প্রশ্ন হচ্ছে, যা খোঁজার কথা সেটা কি দর্শক হিসেবে আপনি খুঁজবেন নাকি সিনেমার কলাকুশলীরা খুঁজবে? তবে সারা ছবি দেখেও কূলকিনারা করতে পারলাম না যে আসলে কি খোঁজ করার কথা। আরো সহজভাবে বললে কি বা কে হারিয়ে গিয়েছে সেটাই বুঝলামনা! সিনেমার মাঝখানে অবশ্য নায়ক বাবাজীর স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছিল, শুধু হারিয়ে গিয়েছিল বললে ভুল হবে, বরঞ্চ ভিলেনপক্ষ সেটা ওভাররাইট করে নিজেদের বানানো তথ্য নায়ক সাহেবের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল! ভাবছেন সাইফাই মুভি’র মত কোন গুন্ডা-ডাক্তার আজগুবি কোন যন্ত্র দিয়ে এই মহাকর্মটি সাধন করেছে? মোটেইনা। গডফাদার শামসুদ্দীন নওয়াবের আর্মস সাপ্লাইয়ার ‘মাস্টার’ কেবলমাত্র একটি ডান্ডা, কয়েক গামলা পানি ও একটি হাডুড়ি দিয়ে এই কাজটি একা একাই করে ফেলেছেন! কাকতালীয়ভাবে এই মাস্টার অবশ্য ব্যক্তিগত জীবনে ডাক্তার, অন্তত নামের আগে ডাক্তার পদবী লাগায়, তার নাম হচ্ছে ডাঃ এজাজ। যা বলছিলাম … পুরো ছবিতে নায়কের স্মৃতি ছাড়া আর কোনকিছু হারিয়েছে বলে মনে হল না। অবশ্য স্মৃতি হারাবার ফলে সেটা ‘সার্চ’ করার জন্য নায়কের মাঝে কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। সে ধীরে সুস্থে তার কমেডি ছবি টেনে নিয়ে গিয়েছেন। ভালো কথা… আগেই বলেছিলাম যে এই ছবিটা কমেডি ছবি। ছবি দেখে দমফাটানো হাসি আসাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তাই দেখার সময় খুব সাবধান! ছবি দেখে কেউ হাসতে হাসতে অসুস্থ হয়ে পড়লে এই লেখক কোনভাবে দায়ী থাকবেনা।

মহাকাব্যের মহানায়কের নাম মেজর মাহমুদ হাসান, সে বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিস (বিএসএস) এর একজন স্পাই (!)। বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিসের অফিসটা বেশ ভালোই, সেখানে সবাই ইংলিশে কথা বলে। মেজর কামরুল নামের একজন আছেন, সে যেকোন বিষয়ে একেবারে গলা বাড়িয়ে ইংলিশে বুলি আওড়ানো শুরু করে, কিন্তু এই লোকই যখন নায়কের মাকে নায়কের মৃত্যুর খবর দিতে যায় তখন তার মুখনিঃসৃত বাংলা শুনে মনে হল উল্টা দিকে দৌড় দেই। তো এসব বাংলাদেশী ইংলিশম্যানদের খপ্পড়ে পড়ে বিএসএস’র চিফ সোহেল রানাকেও বাংলাদেশীদের সাথেই ইংলিশে বাক্যবিনিময় করতে হয়। তার এই কাজটা আরো কঠিন হয়ে যায় যখন আমেরিকা ফেরত নায়ক এসে ইংলিশ বুলি আওড়ানো শুরু করে। আহা কী সেই ইংলিশ! শুধু নায়কের ইংলিশের প্রশংসা করলে কম করে বলা হবে, নায়কের বাংলাও মাশাল্লাহ ‘সেইরকম’। শুনলে মনে হবে কেউ যেন কানের ভেতরটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। তবে একদিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় যে সিনেমাটিতে বেশ কিছু গূঢ় তথ্য রয়েছে, যেমন ধরুন, নায়কের মোহনীয় বাংলা ও সুললিত ইংলিশ উচ্চারণ কিন্তু সচেতন মহলে বিবিসি জানালার পাশাপাশি বিটিভি জানালা চালু করার একটা প্রচ্ছন্ন বার্তাও প্রেরণ করে।

সিনেমার নায়কের আগমন দৃশ্য বেশ চৌকস। বিএসএস চিফ যখন জানতে পারেন যে তার তুরুপের তাস মেজর মাহমুদ হাসান আম্রিকায় স্পাইয়িংয়ে ব্যস্ত তখনই দেখা যায় স্ক্রিন ধোঁয়ায় ভরে উঠে। সেকেন্ডের মাঝেই সেই ধোঁয়া কেটে বেরিয়ে আসে নায়কের দুধ-ঘি খাওয়া আদুল দেহ, পরের সেকেন্ডেই নায়ককে দেখা যায় সুইমিং পুলে সাঁতারে ব্যস্ত, পরের সেকেন্ডেই আমরা আবিষ্কার করি নায়ক লাস ভেগাসের আকাশে হেলিকপ্টার নিয়ে চক্কর খাচ্ছে এবং পরের সেকেন্ডেই নায়ককে লাসভেগাসের রাস্তায় কালো আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় অশরীরিভাবে পদচারণা করতে দেখা যায় (হেলিকপ্টারটি কোথায় ক্র্যাশ করেছিলো সেটা দেখায়নি যদিও)। লাসভেগাসে এক হোটেলের সামনে দুই আম্রিকান ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট এসে মাহমুদ সাহেবকে একটা ডিস্ক ভর্তি ইন্টেলিজেন্স দিয়ে গেল। এই ইন্টেলিজেন্স কিন্তু নায়কের মাথায় ভরার জন্য নয়, বরং ‘নিনো’ নামের বিশ্ব তামা-তামা করা এক সন্ত্রাসীর ইন্টেলিজেন্স ইনফরমেশন। পরের দৃশ্যে আমরা দেখি নায়ক সাহেব এক বিদেশিনীকে গাড়ি করে পুরো হলিউড ঘুরিয়ে তার বাসার দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে সিনেমায় তার সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ বাক্য উচ্চারণ করেন – “টেল মি ইবাউট নিনু”! তার পরের দৃশ্যে দেখা যায় বিএসএস চিফ তার তুরুপের তাস মেজর মাহমুদকে নিনোর কেস ফেলে দিয়ে বাংলাদেশে ডেকে পাঠান নতুন কেসের তদন্ত করতে। কী তামশা, নতুন কেসও হচ্ছে নিনো নিয়ে!

এরমাঝে ক্যাপ্টেন ববি’র আগমন ঘটে বিএসএস অফিসে। লাস ভেগাস ফেরৎ মেজর মাহমুদকে চিফ পরিচয় করিয়ে দেয় ক্যাপ্টেন ববির সাথে, সঙ্গে এও উল্লেখ করতে ভুলেননা যে মেজর মাহমুদের সাক্সেস রেট ১০০% মানে এখনো কোনকিছুতে ফেল্টুস হননাই নায়ক বাবাজী! চিরাচরিত নিয়মানুসারে ক্যাপ্টেন ববিকেই নায়কের সাথে কাজ করার জন্য জুটিয়ে দেয়া হল, হাজার হোক নায়িকা বলে কথা। এদিকে আমরা আবিষ্কার করি যে নায়কের স্বাস্থ্য মাশাল্লাহ ‘সেরকম’ হলেও নায়ক মনেপ্রাণে কিন্তু বেশ স্বাস্থ্যসচেতন। সেজন্যই সকালবেলা নায়ককে দেখা যায় জিন্স পড়ে গ্রামের রাস্তায় জগিং করতে, বুকডন দিতে, নারিকেল গাছের সাথে ঘুষাঘুষি করতে (সুপারি গাছ বা খেজুর গাছ ও হতে পারে, নিশ্চিত না)! তাছাড়া নায়ক আবার গল্ফপ্রেমী। সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতা, সাদা ক্যাপ পড়ে তাকে দেখা যায় গল্ফ মাঠে। একটা শট খেলেইই স্লোমোশনে মোহনীয় ভঙ্গিতে ভুড়ি দুলিয়ে নায়িকার দিকে আসতে আসতেই মন জয় করে ফেলে নায়িকার। আর যায় কই! সাথে সাথে শুরু হয় গান!

এভাবেই চলছিল। তারপর কাহিনী জট পাকিয়ে যায় যখন ১০০% সাক্সেস রেটের মেজর সাহেব একটা মিশনে ফেল্টুস মেরে গুন্ডাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তারপর গুন্ডারাজ ‘মাস্টার’ মেজরকে এমন ধোলাই দেয় যে মেজর আক্ষরিক অর্থেই নিজের নাম ভুলে গেল! এরপর থেকেই ছবিতে নায়কের নতুন নাম হয় ‘অনন্ত’। গোলাপ ফুলের উপর টার্গেট প্র্যাকটিস করে বেড়ে (!) উঠতে থাকে অনন্ত। সেই সাথে স্মৃতি হারিয়ে অনন্ত ক্রমাগত প্রশ্ন করে যায় – “আমি ক্যা?”। স্মৃতি হারানো অবস্থাতেই তার সাথে দেখা হয় ছবির আরেক নায়িকা বর্ষা’র সাথে। বর্ষা হচ্ছে মাস্টারের বস শামসুদ্দিন নওয়াবের একমাত্র বোন। শামসুদ্দিন নওয়াব হচ্ছে বাংলাদেশের গডফাদার যে কিনা স্যুটবুট পড়ে সারক্ষণ মুখে পাউডার আর ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে রাখে! যাই হোক, এক বিটকেলে পরিস্থিতিতে বর্ষাকে তার নিজের ভাইয়ের গুন্ডারা তাড়া করলে মহানায়ক একাই পুরো গ্যাংকে শুইয়ে দিয়ে মোটরবাইকে বর্ষাকে নিয়ে কেটে পড়ে। এদিকে নিনো আসে বাংলাদেশে। অনন্ত’র নাই স্মৃতিশক্তি! সেই সাথে ক্যাপ্টেন ববি’র সাথে প্যারালালি যুক্ত হয়েছে বর্ষা! বর্ষা ও নায়ক কক্সবাজারে। ঐ দিকে সিনেমার সেকেন্ড হিরো আবার বর্ষার বয়ফ্রেন্ড। টান টান উত্তেজনা! এমন সময়ই নায়ক বাবাজী সব স্মৃতি ফিরে পায়, মানে মাস্টার মশাই প্রাণের ভয়ে (নাকি বিরক্তিতে কে জানে?) নায়কের কাছে তার পরিচয় ফাঁস করে দেয়। অবশ্য না দিয়েও উপায় নাই, নায়ক কয়েক গন্ডা মানুষ মেরে মাস্টারের সামনে এসে ওভারকোট পড়ে “মা-আ-শ-টা-আ-র” বলে চেঁচিয়ে যেভাবে অস্ত্র ধরেছিল, তাতে এই বিরক্তিকর চরিত্রের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই মাস্টার সব হড়বড় করে বলে দেয় বলে আমার ধারণা। অবশ্য তারপরও মাস্টার এই বিরক্তিকর চরিত্রকে মারার জন্য একটা চেষ্টা নিয়েছিলেন। কিন্তু নায়ক আচমকা “মাশটার! আপনার মত পপেশনালের পেসন তেকে গুলি করা মানায়না” – বলে, মাস্টারকে গুলি করে নিজেই সিনেমা থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে দেয়। খুনোখুনি করার পর নায়কও তার নিজের পরিচয় পেয়ে কিংকংয়ের মত দেহখানা নিয়ে ঠিক ঠিক মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়!

হলিউডের টার্মিনেটরের পরের সিরিজগুলোর জন্য নায়ক অনন্তকে অফার দেয়া যেতে পারে। কারন তার রোবটিক অঙ্গভঙ্গি, যান্ত্রিক বাচনভঙ্গি কিংবা ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি – আর যাই হোক মানবসম্প্রদায়ের কাউকে মনে করিয়ে দেয়না। এর সাথে নায়কের শরীর-স্বাস্থ্য বিবেচনা করলে প্রাণীজগতে বড়জোর টেনেটুনে কিংকং পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে, এর বেশি কিছু নয়! তবে নায়ক মানুষ নাকি রোবট সেটা নিয়ে বিভ্রান্ত নায়িকাও প্রশ্ন করেছিল নায়ককে “আপনি রোবটের মত কেন?”। এমনকি ভিলেনকূলও মহা গবেষণা শুরু করে দিয়েছিল যে এই লোক মানুষ নাকি রোবট – তা নিয়ে। এই নায়কের পোশাক আশাক দেখে মনে হল নায়ক বঙ্গবাজারের বিশেষ ফ্যান। তার ছিড়া-বিড়া জামাকাপড় আর হাতে পায়ে বিভিন্ন পট্টি দেখে তাকে গুলিস্তানের ফ্যান বলেও মনে হতে পারে। তবে পরে জানলাম যে তার নিজেরই একখান গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে! সন্দেহ হচ্ছে এইসব টুটা-ফাটা কাপড়-চোপড় সেই ফ্যাক্টরিরই অবদান।

এতক্ষণ দেখি কেবল নায়কের কথাই বলে গেলাম, ছবির অন্যান্য ব্যাপারে কিছুই বললাম না! অন্য ব্যাপারগুলোও কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য ব্যাপারের মাঝে প্রথমেই আসি গানের ব্যাপারে। ইমন সাহা ও হাবিব ওয়াহিদের মত সংগীত পরিচালকরা কাজ করেছেন এই ছবিতে। গানগুলোও বেশ ভালো, তবে শর্ত হচ্ছে চোখ বন্ধ করে শুনতে হবে! যদি আপনি চোখ খোলা রেখে টুটা-ফাটা পোশাক পরিহিত বাংলার কিংকংএর হাত ছোঁড়াছুঁড়ি দেখতে দেখতে (একটা নায়ক যে কেবলমাত্র হাতকে নাড়াচাড়া একটা সিনেমার সব গান গেয়ে ফেলতে পারে সেটা এই সিনেমা না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর) গান শুনতে চান তাহলে সেটা নিজ দায়িত্বে করবেন। শুধু মনে রাখবেন যে আমি আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। তবে সেনাবহিনীর সুশৃংখল জীবনে অভ্যস্ত মেজর মাহমুদের এইসব ‘আইকনিক’ ফ্যাশান ও গানের সাথে হাদুমপাদুম নড়াচড়া দেখে আমাদের সেনাবাহিনীর মেজররা কাজেকর্মে উদাস কিংবা হতাশ হয়ে যেতে পারেন! এ ব্যাপারে সরকারে আশু দৃষ্টি দেয়া দরকার।

ছবির নির্মাণশৈলীতে রয়েছে নতুনত্ব। এই ছবিতে সম্ভবত নতুন ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করা হয়েছে – অনেকগুলো ছোট ছোট দৃশ্যকে একসাথে জুড়ে দিয়ে পুরো সিনেমাটা বানানো হয়েছে। তবে কিনা ঐসব ছোট ছোট দৃশ্যের নিজেদের ভেতর তেমন একটা মিল নেই! এই ছবির এডিটরকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। এক হাতে কাঁচি আরেক হাতে আইকা নিয়ে ফিল্মের রোল খালি কেটেছে আর জোড়া দিয়েছে। কয়েক মিনিটের কাজ! উপরে বলছিলাম না যে এটা একটা ট্রেইলার? ঠিক এ কারণেই বলেছিলাম। একটা ট্রেইলারে যেমন পুরো ছবির বিভিন্ন খাপছাড়া দৃশ্য দিয়ে জনমনে কৌতুহল তৈরি করে, এখানেও ঠিক তাই-ই করা হয়েছে। তাই এটাকে সিনেমা না বলে বিশাল বড় কোন ট্রেইলার বলাটাই বেশি মানানসই। সবচেয়ে দীর্ঘ ট্রেইলারের জন্য গিনেস বুকে একটা ট্রাই মারা যেতে পারে, বলা তো যায় না যদি লাইগ্যা যায়!

ছবির কাহিনীর গাঁথুনীও অভিনব। এর শক্তিশালী চিত্রনাট্য দর্শকদের চিন্তাশক্তিকে উস্কে দেয় অনেকগুলো প্রশ্ন ও ধাঁধাঁ দিয়ে। বিশেষ করে নায়িকা বর্ষা যখন সরাসরি মাথায় গুলি খায়, তারপর তাকে সে অবস্থায় ফেলে রেখে নায়ক চলে যায় নিনোকে ধাওয়া করতে, ঐ দিকে কিভাবে কিভাবে যেন নায়িকা গুলি খাওয়া মাথা নিয়ে পৌঁছে যায় হাসপাতালে। প্রশ্ন জাগে যে নায়িকা কিভাবে গেল হাসপাতালে? কারণ ইতিমধ্যেই সেকেন্ড হিরো অক্কা পেয়েছে। তাছাড়া বিএসএস চিফ সোহেল রানা শেষমেষ বেঁচে থাকে না মারা যায় সেটাও একটা অমিমাংসিত ধাঁধা। এদিকে গন্ডা গন্ডা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত নায়ক যখন নিনো’র সাথে শেষ মারপিট করতে যায় তখন কুদরতিভাবে তার সব অস্ত্র হাওয়া হয়ে গিয়ে একটা গ্রেনেড ছাড়া আর কিছুই থাকেনা। তারপরও ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে ঝুলে ঝুলে নিনোর প্যান্টের ভেতর কিভাবে কিভাবে যেন ঢুকিয়ে দেয় সেই গ্রেনেড। ফলাফল ট্রেনের ইঞ্জিনের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকা নিনোর জায়গায় মাঝারি আকারের ধোঁয়ার বিস্ফোরণ। অথচ পুরো রেলগাড়ীর ডিজেল ইঞ্জিনে একটা আচঁড়ও নেই! বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন তাহলে কি ধাতু দিয়ে তৈরি? বিস্ফোরণের পরপরই মাথার ঘিলুতে গুলি খাওয়া নায়িকাকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় নায়কের সাথে নাচগান করতে দেখা যায়। ঘিলুতে গুলি লাগলে চিকিৎসা কি? এদিকে অন্য নায়িকার কোন খোঁজ খবর নেই, কি হয় ক্যাপ্টেন ববির? মেজর কিংবা ক্যাপ্টেন হয়ে এত নাচানাচি আর গানের তালিম কোত্থেকে পাওয়া যায় – সেটা জানার বড়ই শখ ছিল। এক দৃশ্যে নায়ক লাফ দিয়ে ঘোড়ার উপর উঠতে গেলে দেখা যায় যে, ঘোড়া শেষ মুহুর্তে অনীহা প্রকাশ করে পিছিয়ে যায়। খুব জানতে ইচ্ছা করে কী চিন্তা করছিল তখন ঘোড়াটা?

সিনেমা শেষে এতসব উন্মুক্ত ধাঁধাঁ থাকার অর্থ কিন্তু একটাই – অদূর ভবিষ্যতে এই মুভির সিক্যুয়াল আসছে (আল্লাহ রহম কর)। কি হবে সেই সিক্যুয়ালের নাম? “পাইছি দ্যা ফাউন্ড”?