রঙ্গীন দুনিয়া – ২

নেদারল্যান্ডস এর একটা ব্যাপার বেশ অবাক হবার মত; পুরো দেশটা একেবারে সবুজে ছাওয়া। যেদিকেই তাকাই সেদিকেই কেবল সবুজ। চারদিকে কেবল সবুজের সমারোহ। এরা খুবই সবুজ প্রিয় জাতি। খালি জায়গা পেলেই সেখানে গাছ লাগিয়ে দেয়। ডেলফ, হেগ বা লেইডেন এর মত শহরে না গেলে বিশ্বাস করা কঠিন যে কোন শহর গাছগাছালিতে এতটা পরিপুর্ণ থাকতে পারে। আর গ্রামের কথাতো বাদই দিলাম!

বাঙ্গালী ছাড়া আর কোন জাতিকে তেমন একটা কাছ থেকে ভালোভাবে কখনোই দেখি নাই। আইইউটিতে থাকতে অবশ্য ভিন জাতির পোলাপানদের সাথে কিছুটা মেশা হয়েছিলো। কিন্তু তাওতো আবছা’র উপর ঝাপসা করে। একেবারে পুরো একটা জাতিকে একসাথে দেখা – এই প্রথম। জাতি হিসেবে ডাচরা বেশ আড্ডাপ্রিয় বলেই মনে হল। এদের অফিস আদালতে গেলে মনে হবে যেন এরা অফিসে আড্ডা মারতে এসেছে। তবে এদের আসল আড্ডা চলে অফিস ছুটির পর। তখন দেখা যায়, সব লোকজন রেস্টুরেন্ট আর বারে গিয়ে ভীড় করেছে। এরা খাবার টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরে যায়। এদের বার মানে সেখানে কেবলই তরল জিনিস পাওয়া যায়। আগে কেবল গল্পের বইয়ে পড়তাম যে পশ্চিমারা ঘন্টার পর ঘন্টা তরল গলায় ঢালতে পারে। এইবার নিজের চোখে দেখলাম। এরা বারে বসে থাকে গড়ে পাঁচ থেকে সাত ঘন্টা। এই পুরো সময়টুকু কেবল মগের পর মগ হয় বিয়ার নয় ওয়াইন নতুবা হুইস্কি একের পর এক টানতে থাকে। অবাক ব্যাপার হল এরা এতটুকু মাতাল হয়না, অন্তত আমি দেখিনি! তরল ছাড়া আরেকটা যে ব্যাপারে এরা সিদ্ধহস্ত সেটা হল ধোঁয়া খাওয়া। সিগারেট টানতে এদের জুড়ি নাই। ছেলে বুড়ো সবাই দেদারসে ধোঁয়া গিলছে। এরা বাতাস টানার মত করে ধোঁয়া টানে।
ইউরোপের যে ব্যাপারটাতে এখনো অভ্যস্ত হতে পারিনি সেটা হল রাস্তার ডান দিকে চলা। সারাজীবন বাংলাদেশে রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলে এসেছি, নিজেও গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু এখানকার রাইট হ্যান্ড রুল এখনো কেমন কেমন জানি লাগে। তবে এখানে এসে বুঝেছি, ঢাকার ড্রাইভাররা বিশ্বসেরা। ঢাকায় যে চাপের মধ্যে গাড়ি চালাতে হয় তার কানাকড়ি চাপও এইখানে নাই। কেউ হুটহাট করে লেইন চেঞ্জ করেনা। সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন করা। আর রিক্সাতো নাই! একটা জিনিসকে সবাই ভয় পায়, সেটা হল আইন। সামনে পুরা রাস্তা খালি, আশেপাশে কোন জনমানুষ নাই, এই অবস্থাতেও যদি লাল বাতি জ্বলে তবুও গাড়ি থেমে যাবে। এমনকি যদি সময়টা রাত একটাও হয়!

এখানে আসার পর দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়েছিলাম ডলফিনেরিয়ামে। এইটা হেগ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে হার্ডারবাইক নামের আরেক জায়গায়। ডলফিনেরিয়ামে মুলত সামুদ্রিক প্রাণীদের শো হয়। ডলফিন, সীল – এদের বিভিন্ন খেলা দেখানো হয়। এতদিন কেবল ডিস্কভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতেই কেবল ডলফিন বা সীলের খেলা দেখতাম, এইবার নিজের চোখে লাইভ দেখলাম। এটা ছাড়াও ওখানে থ্রিডি সিনেমা আছে। সিকোয়েন্সের সাথে সাথে একেবারে চেয়ার নাড়িয়ে দেয়। পর্দায় হয়তো দেখা গেলো বোমা ফাটলো, সাথে সাথে বিকট বিস্ফোরনের শব্দ আর চেয়ারে সজোরে ঝাঁকুনি। ডলফিনেরিয়ামে গিয়ে ছিলাম মামা মামির সাথে। আসার পথে মামা লিলিস্টাডের বিশাল বাঁধ ঘুরিয়ে আনলো। যাদের নেদারল্যান্ডস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা নাই তাদের জন্য ছোট্ট একটা তথ্য- পুরো দেশটার এক তৃতীয়াংশ অংশ এসেছে সাগরের নীচ থেকে। ডাচরা সাগরে বাঁধ দিয়ে তাদের দেশ বাড়িয়েছে। সেরকম একটা বাঁধ আছে লিলিস্টাডে। এটাকে বাঁধ না বলে আসলে বলা উচিৎ সাগরের মাঝ দিয়ে হাইওয়ে। এর উপর দিয়ে একের পর এক গাড়ি চলে যাচ্ছে। রাস্তার একপাশে সাগর আর অন্যপাশে শুকনো সবুজ জমি, দেখে মনেই হয়না যে এই জমি এক সময় সাগরের নীচে ছিল। অপূর্ব দৃশ্য! না দেখলে বোঝানো কঠিন।

ডাচদের সাথে কথা বললে প্রথমেই যে জিনিসটা মনে ধরে সেটা হল এরা সবাই প্রতিটা বাক্যেই খক্‌ খক্‌ করে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। ইংলিশে কথা বললেও খক্‌ খক্‌! আসলে ডাচ ভাষাটা বেশ অদ্ভুত। এদের খুব প্রিয় বর্ণ মনে হয় “খ”। খুব সম্ভবত এদের প্রতিটা বাক্যেই একাধিক “খ” থাকে। “খ” তাই এদের গলা থেকে খিল খিল করে ঝরে পড়ে।

মারিয়াহোভ ট্রেন স্টেশন আমার প্রতিদিনের পরিচিত জায়গা। ইউনিভার্সিটিতে যেতে এখান থেকেই আমি ট্রেনে উঠি। একদিনের কথা, সবে ট্রেন থেকে নেমে মাত্র স্টেশনের বাইরে আসলাম, এসেই দেখি সামনে বিশাল মার্সিডিজ নিয়ে কালো স্যুট কালো সানগ্লাস পরা সিকিউরিটির এক দামড়া দাঁড়িয়ে আছে! কেবল যে দাঁড়িয়ে আছে তাই-না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুক ধ্বক করে উঠলো, সন্ত্রাসী হিসেবে আবার সন্দেহ করল নাতো! তার উপর আমার পিঠে আবার ব্যাকপ্যাক। আমার ব্যাকপ্যাকের যে সাইজ তাতে এটম বোমা আছে বলে সন্দেহ করাটা মোটেও অমূলক না। সাবধানে আরেকটু এগোতেই ব্যাপারটা চোখে পড়লো। ব্যাটার গাড়ীতে নীল রঙের নম্বর প্লেট লাগানো, তার মানে ব্যাটা ট্যাক্সি ড্রাইভার! এদের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের এই বেশভূষা বেশ কমন। বলা যায় এইটাই এদের ইউনিফর্ম! একেবারে ম্যাট্রিক্স সাজ যাকে বলে। তবে প্রথমবার একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের এই দশা দেখে হজম করতে বেশ কষ্ট হয়েছে।

রঙ্গীন দুনিয়া – ১

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে ভয়াবহ ধরনের ব্যস্ত ছিলাম। ভিসা প্রসেসিং, কেনাকাটা, অফিসে রিজাইন দেয়া – বহুত ঝামেলা। গ্রাজুয়েশন করার পর ভালই ছিলাম। হঠাৎ কী মনে হল আরও লেখাপড়ার জন্য মাথা কামড়া-কামড়ি শুরু হল। এম এস করার জন্য ইউরোপকেই পছন্দ করলাম। টেকনিকাল ইউনিভার্সিটি অফ ডেলফ এ এডমিশন পেলাম। ওই দিকে আবার মামা খালা নেদারল্যান্ডস থাকে। সব মিলিয়ে একেবারে খাপে খাপ মিলে যাবার দশা আর কী। যাই হোক সংক্ষেপে এই হল আমার নেদারল্যান্ডস যাবার আদ্যোপান্ত। এই আদ্যপান্তকেই এক মলাটে ঢেকে ফেলার একটা চেষ্টা এই লেখাটা। হয়তবা এটকে একটা সিরিজ হিসেবে লিখতে পারব। দেখা যাক কি হয়… অনেক দিন ধরেই এই লেখাটা লিখেছি, লেখাটা লেখা শুরু করেছিলাম হিথ্রো এয়ারপোর্টে।

ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ

নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। প্লেন কিভাবে আকাশে উড়ে এটা নিয়ে মনে কোনদিন সন্দেহ জাগেনি। কিন্তু আজকে সকালে যখন ব্রিটিশ এয়ার ওয়েযের বিএ১৪৪ ফ্লাইটটাকে দেখলাম তখনই মনে প্রথম সন্দেহটা জাগলো। আসলেই কি এই বিশাল জিনিসটা আকাশে উড়তে পারে? রান ওয়েতে বিশাল ধবধবে সাদা প্লেনটা ডানা বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কনকনে ঠান্ডা লাউঞ্জে বসে ছিলাম প্রায় ঘন্টাখানেক। একসময় ডাক পড়ল প্লেনে উঠার। লাইন ধরে উঠলাম একসময়। আব্বা বাসায় বারবার বলে দিয়েছিলো যে চেক ইনের সময় যেন জানালার পাশের সিটের জন্য রিকোয়েস্ট করি। এটাই আমার প্রথম প্লেনে উঠা। তাই উপর থেকে পৃথিবী দেখার সাধ কেন অপূর্ণ থাকবে। কিন্তু সারাক্ষন মনে রেখে ঠিক টিকেট চেক ইনের সময় ভুলে গেলাম রিকোয়েস্ট করতে। কী আর করা! এ যাত্রায় আর জানালার পাশে বসা হোলনা মেনে নিয়েই প্লেনে উঠলাম।

রাখে আল্লাহ মারে কে! প্লেনে উঠে দেখি জানালার পাশের সিটের পাশের সিটটা আমার। যাক বাবা অন্তত পাশের যাত্রীর উপর দিয়ে উঁকি মেরে জানালা দিয়ে কিছু তো দেখা যাবে! হঠাৎ মনে হল পাশের যাত্রী যদি মেয়ে হয় তাহলে তো উঁকি দিলে পুরা মার্ডার কেস! যাই হোক এক সময় প্লেন নড়াচড়া শুরু করল এবং আমার আর জানালার মাঝে আর কেউ নেই! টেক অফের আগেই তাই জানালার পাশের সিট আমার দখলে। যাক শেষ পর্যন্ত একটা আশা পুর্ণ হল তাহলে।

পাখির চোখে বাংলাদেশ

উপর থেকে বাংলাদেশকে যে এত অসাধারন লাগে তা আগে কখনো চিন্তা পর্যন্ত করি নাই। এক কথায় অপূর্ব! মেঘের ফাঁক দিয়ে একে একে চোখে পড়লো হোটেল রেডিসন, গুলশান লেক, হকি স্টেডিয়াম; আরো অনেক কিছু, কিন্তু সব গুলো ঠিক মত বুঝতে পারি নাই। একসময় চোখে পড়ল গ্রাম। গ্রামের টিনের ঘরের চাল গুলো রোদে ঝিকমিক করছিলো। যাই দেখিনা কেন, কেবল সবুজ রংটাই চোখে পড়ে। সবুজের মাঝে এঁকে বেঁকে গেছে চকচকে রূপালি নদী। সবুজের মাঝে রূপালী ফিতার মত নদী; অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য। না দেখলে এককথায় বোঝানো অসম্ভব! আমি কবি মানুষ না। তাছাড়া কবিতা খুব একটা পড়িওনা। এক কথায় আমি কখনোই কবিতার সমঝদার ছিলাম না। তাই আমার ভান্ডারে কবিতার সংখ্যা অনেক কম। পাখির চোখে বাংলাদেশকে দেখে আমার মনে হয়েছিলো কোন কবিই এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশকে কোন কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেনাই; হোক সেটা রবিন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রলাল। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, যদি তাদেরকে রূপালী-সবুজের অসাধারন এই মিশ্রনটা দেখানো যেত তারা এক বাক্যে তাদের সব সৃষ্টি নতুন করে লিখতেন।

মহাপতঙ্গের পেটে

খাওয়া দাওয়ার দিক থেকে মনে হয় প্লেনের কোন বিকল্প নেই। শুরুতেই সকালের নাস্তা। কিছুক্ষন পর আবার নাস্তা। তারপর আবার এক প্রস্থ। তারপরে লাঞ্চ। মোটামুটি বেশ রমরমা অবস্থা আর কী! আমার পাশের লোক আবার সিলেটি প্লাস লন্ডনি। বেশ মাই ডিয়ার ধরনের। এই লোক বছরে তিন-চারবার দেশে আসে। তার কাছে ঢাকা-লন্ডনের দশ ঘন্টা জার্নি কোন ব্যাপারই না। এরই মধ্যে প্লেনের ছোট এলসিডি টিভিতে একের পর এক মুভি আর কার্টুন চলতে লাগলো। ডিজনী’র “ক্রনিকেলস অফ নারনিয়া”র দ্বিতীয় পর্বটা দেখে ফেললাম। আর কার্টুন নেটওয়ার্কের একটা চ্যানেলে লাগাতার ভাবে “বেন টেন” আর “কে এন ডি” চলছিলো।
শুনেছিলাম এয়ারহোস্টেসরা বেশ অমায়িক হয়। কথাটা মিথ্যা না। তবে একেকজনের যে দামড়া সাইজ, দেখলেই কিছু বলতে ভয় করে। আর ব্রিটিশদের হাসি দেবার ভঙ্গীটা বেশ অদ্ভুত। এরা হাসি দেবার সময় মাথা নাড়ানাড়ি করে চোখ ভুরু কুঁচকে বিটকেলে হাসি দেয়, ব্যাপারটা হাসি না ভেংচি বোঝা বেশ কঠিন! আমার পেছনের সীটে এক বঙ্গদেশীয় ছেলে পাশের সীটের সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছে এক ব্রিটিশ রমনীকে। কী তার উচ্ছ্বাস! পুরা জার্নিতে সে ইয়েস-নো-ভেরি-গুড টাইপের ইংলিশ দিয়ে মহিলার সাথে বকর বকর করে গেছে। আমি মাঝে মাঝে ভয়ে ছিলাম যে মহিলা না আবার ক্ষেপে যায়। তবে মহিলা দেখলাম বেশ সরব হয়েই ঐ আদমীর সাথে কথা চালিয়ে গেছে। ব্রিটিশরা সত্যিই বিচিত্র!

মেঘের রাজ্য

আকাশে মেঘ যে তিন স্তরে জানে এইটা জানতামনা। জানলাম যখন প্লেন মেঘের রাজ্যে ঢুকলো। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! মেঘের উপর মেঘ, তারও উপরে আরো মেঘ। কোন মেঘ ধূসর রঙা, কোন কোনটা ধবধবে সাদা, কোনটা দুধ সাদা, কোনটা আবার উজ্জ্বল সাদা, দেখলে মনে হয় ওগুলো থেকে ঠিকরে আলো বের হচ্ছে! মেঘের উপর মেঘ বসে মেঘের স্তম্ভ তৈরি করেছে। পেঁজা তুলার মত স্তম্ভগুলো যেন মেঘের রাজপ্রাসাদ। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো প্লেন থেকে নেমে মেঘের উপর একটু হেঁটে আসি!

অবশেষে হিথ্রো

দশ ঘন্টা মাটির সাথে কোন মোলাকাত নাই। তাই পাইলট যখন বলল যে প্লেন ইংল্যান্ডের আকাশ সীমায় পৌঁছে গেছে, নিজের ভেতর একধরনের ফুর্তি ফুর্তি ভাব কাজ করলো। প্রায় দশ ঘন্টা পর মাটির উপর পা রাখব অথচ মনে হচ্ছিল যেন যুগ যুগ পর মাটির দেখা পাচ্ছি! জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম নীচে – এই তাহলে লন্ডন শহর! কেবল রাস্তা আর বাড়ি আর কিছু দেখা যায়না! মাঝে মাঝে অবশ্য সবুজ রঙ চোখে পড়ে। টেমস্‌ নদীকে যত বড় ভেবেছিলাম তা আদৌ তত বড় না, অন্তত আমাদের দেশের নদীর কাছে কোন পাত্তা পাবেনা। নদীর পাশে বিখ্যাত লন্ডন আই দেখলাম। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে বিভিন্ন রঙের গাড়ি। বাড়িগুলোর গড়নে সেই আদ্যিকালের ছাপ এখনো স্পষ্ট। এক সময় প্লেন হিথ্রোতে নামলো।

আমার টিকেটে লেখা ছিল যে আমার প্লেন নামবে চার নম্বর টার্মিনালে আর আমস্টারডামের পরের প্লেন ছাড়বে টার্মিনাল ৫ থেকে। অনেকে হয়ত পাঁচ নম্বর টার্মিনালের কথা শুনেননি। টার্মিনালটা একদম নতুন। আমি ভেবেছিলাম টার্মিনাল দুইটা হয়তো পাশাপাশি, যেমনটা আছে ঢাকা এয়ারপোর্টে। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি রীতিমত আমাদের জন্য বড়সড় বাস দাঁড়িয়ে আছে টার্মিনাল পাঁচে নিয়ে যাবার জন্য। বাসে উঠার পর পরই ড্রাইভার বললো যে টার্মিনাল চার থেকে টার্মিনাল পাঁচের এই যাত্রাটা হবে আঠার মিনিটের! প্রায় কাঁটায় কাঁটায় আঠার মিনিট পর টার্মিনাল পাঁচে এসে পৌছালাম। নেমে দেখি আর এক এলাহি ব্যাপার।শত শত লোক বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা কথা বলে রাখি- টার্মিনাল চার আর টার্মিনাল পাঁচ কেবল মাত্র ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের নিজেদের ব্যবহার করার জন্য, অন্য কোন কোম্পানী এগুলো ব্যবহার করতে পারেনা। এদিকে বোর্ডিঙের লাইনে এক চীনা শিশু বড়সড় ধরনের হিসু করে দিলো। সাথে সাথে দেখি এয়ারপোর্টের লোকজন যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে এসে সেই হিসুকে গায়েব করে দিলো। তবে হিথ্রোতে নেমে বুঝতে কষ্ট হয় আমি ইন্ডিয়াতে আছি নাকি ব্রিটেনে আছি, চারদিকে কেবল ইন্ডিয়ান চেহারা, শিখ-নন শিখ সব ধরনের আদমিই আছে।

হিথ্রোর চেকিং আবার ভয়াবহ ব্যাপার। জুতা, বেল্ট, জ্যাকেট সবই খুলে ফেলতে হয় [আল্লাহ বাঁচাইসে যে প্যান্ট খুলতে হয়না]। সেই চেক পোস্ট পাড়ি দিয়ে যখন ভেতরে ঢুকলাম তখন দেখি আরেক জগত। ডিউটি ফ্রি এলাকায় ঢুকে গেছি আমি। কি নাই সেই এলাকায়! পারফিউম, জামা, জুতা, বই, ম্যাগাজিন, খাবার দাবার থেকে শুরু করে মায় আস্ত লাল রঙের ফেরারি পর্যন্ত আছে। ওহ… এই প্রথম আমি জীবনে সামনাসামনি ফেরারি দেখলাম; দেখার মত জিনিস একটা! আমি যখন হিথ্রোতে পৌঁছাই তখন ওইখানকার লোকাল সময় হল বিকেল তিনটা। আমার পরের প্লেন সন্ধ্যা ছয়টায়। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে অবশেষে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম। নেট ব্যবহার করব ভেবেছিলাম, ল্যপটপ অন করার পরই দেখি সে বেশ কিছু ওয়াইফাই ডিটেক্ট করতে পেরেছে, কিন্তু কোনটাই ফ্রী না! কী আর করা বসে বসে তখন এই লেখাটার প্রথম অংশটুকু লিখলাম।

আমস্টারডামের ডাক

একসময় আমার প্লেনের ডাক পড়ল। গেলাম নির্ধারিত গেটের কাছে। এসে দেখি বিশাল স্ক্রীনে বিবিসি দেখাচ্ছে। ভয়াবহ ব্যাপার! স্পেনে এক প্লেন টেক অফ করার সময় বিদ্ধস্ত হয়েছে। কী অবস্থা! প্লেনে উঠার সময়ই প্লেন দুর্ঘটনার খবর। ভয়ে ভয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে প্লেনে উঠলাম। ঢাকা থেকে যেটাতে এসেছিলাম সেটা ছিল বোয়িং। আর এবার যেটাতে উঠলাম সেটা হল এয়ারবাস। এগুলোর সাইজ ছোটখাট। প্লেন টেক অফ করার সময় দেখি প্লেন ঝিরঝির করে কাঁপছে! হাতের খবরের কাগজে তখনো প্লেন ক্র্যাশের খবর জ্বলজ্বল করছে। প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে ছিলাম সারাক্ষন। এবার প্লেনে শরমা টাইপের বিদ্ঘুটে এক জিনিস নাস্তা হিসেবে দিল। খেতে অবশ্য খারাপ লাগেনাই। ঘন্টা খানেক পর প্লেন আমস্টারডামের শিপল্‌ এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছুঁল। আমার ঘড়ি বলছে তখন স্থানীয় সময় রাত আটটা, কিন্তু বাইরে দেখি তখনো সূর্য উঁকি দিচ্ছে। শিপল হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম অত্যাধুনিক এক বিমানবন্দর যেখানে সরাসরি আন্ডারগ্রাঊন্ড রেলওয়ে আছে একেবার বিমানবন্দর থেকেই। ঐ রেলে করে যে কেউ পুরো নেদারল্যান্ডস ঘুরে আসতে পারে। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর আমার অবাক হবার পালা। সামনে একসাথে চব্বিশটা কনভেয়ার বেল্ট ঘুরতে দেখলাম! কখনো এতগুলো কনভেয়ার বেল্ট একসাথে কখনোই দেখিনাই।

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ষোল ঘন্টা জার্নি করে অবশেষে জায়গামত পৌঁছালাম। খারাপ লাগেনাই জার্নিটা। তবে একটা জিনিস একটু খারাপ লাগলো; সবখানেই দেখি বাংলাদেশী পাস্পোর্ট দেখলে একটু নাক কুঁচকায়। যাহোক… জীবনের প্রথম প্লেন জার্নি হিসিবে জার্নিটা ভালোই ছিলো।