রঙ্গীন দুনিয়া – ২

নেদারল্যান্ডস এর একটা ব্যাপার বেশ অবাক হবার মত; পুরো দেশটা একেবারে সবুজে ছাওয়া। যেদিকেই তাকাই সেদিকেই কেবল সবুজ। চারদিকে কেবল সবুজের সমারোহ। এরা খুবই সবুজ প্রিয় জাতি। খালি জায়গা পেলেই সেখানে গাছ লাগিয়ে দেয়। ডেলফ, হেগ বা লেইডেন এর মত শহরে না গেলে বিশ্বাস করা কঠিন যে কোন শহর গাছগাছালিতে এতটা পরিপুর্ণ থাকতে পারে। আর গ্রামের কথাতো বাদই দিলাম!

বাঙ্গালী ছাড়া আর কোন জাতিকে তেমন একটা কাছ থেকে ভালোভাবে কখনোই দেখি নাই। আইইউটিতে থাকতে অবশ্য ভিন জাতির পোলাপানদের সাথে কিছুটা মেশা হয়েছিলো। কিন্তু তাওতো আবছা’র উপর ঝাপসা করে। একেবারে পুরো একটা জাতিকে একসাথে দেখা – এই প্রথম। জাতি হিসেবে ডাচরা বেশ আড্ডাপ্রিয় বলেই মনে হল। এদের অফিস আদালতে গেলে মনে হবে যেন এরা অফিসে আড্ডা মারতে এসেছে। তবে এদের আসল আড্ডা চলে অফিস ছুটির পর। তখন দেখা যায়, সব লোকজন রেস্টুরেন্ট আর বারে গিয়ে ভীড় করেছে। এরা খাবার টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরে যায়। এদের বার মানে সেখানে কেবলই তরল জিনিস পাওয়া যায়। আগে কেবল গল্পের বইয়ে পড়তাম যে পশ্চিমারা ঘন্টার পর ঘন্টা তরল গলায় ঢালতে পারে। এইবার নিজের চোখে দেখলাম। এরা বারে বসে থাকে গড়ে পাঁচ থেকে সাত ঘন্টা। এই পুরো সময়টুকু কেবল মগের পর মগ হয় বিয়ার নয় ওয়াইন নতুবা হুইস্কি একের পর এক টানতে থাকে। অবাক ব্যাপার হল এরা এতটুকু মাতাল হয়না, অন্তত আমি দেখিনি! তরল ছাড়া আরেকটা যে ব্যাপারে এরা সিদ্ধহস্ত সেটা হল ধোঁয়া খাওয়া। সিগারেট টানতে এদের জুড়ি নাই। ছেলে বুড়ো সবাই দেদারসে ধোঁয়া গিলছে। এরা বাতাস টানার মত করে ধোঁয়া টানে।
ইউরোপের যে ব্যাপারটাতে এখনো অভ্যস্ত হতে পারিনি সেটা হল রাস্তার ডান দিকে চলা। সারাজীবন বাংলাদেশে রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলে এসেছি, নিজেও গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু এখানকার রাইট হ্যান্ড রুল এখনো কেমন কেমন জানি লাগে। তবে এখানে এসে বুঝেছি, ঢাকার ড্রাইভাররা বিশ্বসেরা। ঢাকায় যে চাপের মধ্যে গাড়ি চালাতে হয় তার কানাকড়ি চাপও এইখানে নাই। কেউ হুটহাট করে লেইন চেঞ্জ করেনা। সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন করা। আর রিক্সাতো নাই! একটা জিনিসকে সবাই ভয় পায়, সেটা হল আইন। সামনে পুরা রাস্তা খালি, আশেপাশে কোন জনমানুষ নাই, এই অবস্থাতেও যদি লাল বাতি জ্বলে তবুও গাড়ি থেমে যাবে। এমনকি যদি সময়টা রাত একটাও হয়!

এখানে আসার পর দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়েছিলাম ডলফিনেরিয়ামে। এইটা হেগ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে হার্ডারবাইক নামের আরেক জায়গায়। ডলফিনেরিয়ামে মুলত সামুদ্রিক প্রাণীদের শো হয়। ডলফিন, সীল – এদের বিভিন্ন খেলা দেখানো হয়। এতদিন কেবল ডিস্কভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতেই কেবল ডলফিন বা সীলের খেলা দেখতাম, এইবার নিজের চোখে লাইভ দেখলাম। এটা ছাড়াও ওখানে থ্রিডি সিনেমা আছে। সিকোয়েন্সের সাথে সাথে একেবারে চেয়ার নাড়িয়ে দেয়। পর্দায় হয়তো দেখা গেলো বোমা ফাটলো, সাথে সাথে বিকট বিস্ফোরনের শব্দ আর চেয়ারে সজোরে ঝাঁকুনি। ডলফিনেরিয়ামে গিয়ে ছিলাম মামা মামির সাথে। আসার পথে মামা লিলিস্টাডের বিশাল বাঁধ ঘুরিয়ে আনলো। যাদের নেদারল্যান্ডস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা নাই তাদের জন্য ছোট্ট একটা তথ্য- পুরো দেশটার এক তৃতীয়াংশ অংশ এসেছে সাগরের নীচ থেকে। ডাচরা সাগরে বাঁধ দিয়ে তাদের দেশ বাড়িয়েছে। সেরকম একটা বাঁধ আছে লিলিস্টাডে। এটাকে বাঁধ না বলে আসলে বলা উচিৎ সাগরের মাঝ দিয়ে হাইওয়ে। এর উপর দিয়ে একের পর এক গাড়ি চলে যাচ্ছে। রাস্তার একপাশে সাগর আর অন্যপাশে শুকনো সবুজ জমি, দেখে মনেই হয়না যে এই জমি এক সময় সাগরের নীচে ছিল। অপূর্ব দৃশ্য! না দেখলে বোঝানো কঠিন।

ডাচদের সাথে কথা বললে প্রথমেই যে জিনিসটা মনে ধরে সেটা হল এরা সবাই প্রতিটা বাক্যেই খক্‌ খক্‌ করে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। ইংলিশে কথা বললেও খক্‌ খক্‌! আসলে ডাচ ভাষাটা বেশ অদ্ভুত। এদের খুব প্রিয় বর্ণ মনে হয় “খ”। খুব সম্ভবত এদের প্রতিটা বাক্যেই একাধিক “খ” থাকে। “খ” তাই এদের গলা থেকে খিল খিল করে ঝরে পড়ে।

মারিয়াহোভ ট্রেন স্টেশন আমার প্রতিদিনের পরিচিত জায়গা। ইউনিভার্সিটিতে যেতে এখান থেকেই আমি ট্রেনে উঠি। একদিনের কথা, সবে ট্রেন থেকে নেমে মাত্র স্টেশনের বাইরে আসলাম, এসেই দেখি সামনে বিশাল মার্সিডিজ নিয়ে কালো স্যুট কালো সানগ্লাস পরা সিকিউরিটির এক দামড়া দাঁড়িয়ে আছে! কেবল যে দাঁড়িয়ে আছে তাই-না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুক ধ্বক করে উঠলো, সন্ত্রাসী হিসেবে আবার সন্দেহ করল নাতো! তার উপর আমার পিঠে আবার ব্যাকপ্যাক। আমার ব্যাকপ্যাকের যে সাইজ তাতে এটম বোমা আছে বলে সন্দেহ করাটা মোটেও অমূলক না। সাবধানে আরেকটু এগোতেই ব্যাপারটা চোখে পড়লো। ব্যাটার গাড়ীতে নীল রঙের নম্বর প্লেট লাগানো, তার মানে ব্যাটা ট্যাক্সি ড্রাইভার! এদের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের এই বেশভূষা বেশ কমন। বলা যায় এইটাই এদের ইউনিফর্ম! একেবারে ম্যাট্রিক্স সাজ যাকে বলে। তবে প্রথমবার একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের এই দশা দেখে হজম করতে বেশ কষ্ট হয়েছে।

রঙ্গীন দুনিয়া – ১

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে ভয়াবহ ধরনের ব্যস্ত ছিলাম। ভিসা প্রসেসিং, কেনাকাটা, অফিসে রিজাইন দেয়া – বহুত ঝামেলা। গ্রাজুয়েশন করার পর ভালই ছিলাম। হঠাৎ কী মনে হল আরও লেখাপড়ার জন্য মাথা কামড়া-কামড়ি শুরু হল। এম এস করার জন্য ইউরোপকেই পছন্দ করলাম। টেকনিকাল ইউনিভার্সিটি অফ ডেলফ এ এডমিশন পেলাম। ওই দিকে আবার মামা খালা নেদারল্যান্ডস থাকে। সব মিলিয়ে একেবারে খাপে খাপ মিলে যাবার দশা আর কী। যাই হোক সংক্ষেপে এই হল আমার নেদারল্যান্ডস যাবার আদ্যোপান্ত। এই আদ্যপান্তকেই এক মলাটে ঢেকে ফেলার একটা চেষ্টা এই লেখাটা। হয়তবা এটকে একটা সিরিজ হিসেবে লিখতে পারব। দেখা যাক কি হয়… অনেক দিন ধরেই এই লেখাটা লিখেছি, লেখাটা লেখা শুরু করেছিলাম হিথ্রো এয়ারপোর্টে।

ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ

নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। প্লেন কিভাবে আকাশে উড়ে এটা নিয়ে মনে কোনদিন সন্দেহ জাগেনি। কিন্তু আজকে সকালে যখন ব্রিটিশ এয়ার ওয়েযের বিএ১৪৪ ফ্লাইটটাকে দেখলাম তখনই মনে প্রথম সন্দেহটা জাগলো। আসলেই কি এই বিশাল জিনিসটা আকাশে উড়তে পারে? রান ওয়েতে বিশাল ধবধবে সাদা প্লেনটা ডানা বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কনকনে ঠান্ডা লাউঞ্জে বসে ছিলাম প্রায় ঘন্টাখানেক। একসময় ডাক পড়ল প্লেনে উঠার। লাইন ধরে উঠলাম একসময়। আব্বা বাসায় বারবার বলে দিয়েছিলো যে চেক ইনের সময় যেন জানালার পাশের সিটের জন্য রিকোয়েস্ট করি। এটাই আমার প্রথম প্লেনে উঠা। তাই উপর থেকে পৃথিবী দেখার সাধ কেন অপূর্ণ থাকবে। কিন্তু সারাক্ষন মনে রেখে ঠিক টিকেট চেক ইনের সময় ভুলে গেলাম রিকোয়েস্ট করতে। কী আর করা! এ যাত্রায় আর জানালার পাশে বসা হোলনা মেনে নিয়েই প্লেনে উঠলাম।

রাখে আল্লাহ মারে কে! প্লেনে উঠে দেখি জানালার পাশের সিটের পাশের সিটটা আমার। যাক বাবা অন্তত পাশের যাত্রীর উপর দিয়ে উঁকি মেরে জানালা দিয়ে কিছু তো দেখা যাবে! হঠাৎ মনে হল পাশের যাত্রী যদি মেয়ে হয় তাহলে তো উঁকি দিলে পুরা মার্ডার কেস! যাই হোক এক সময় প্লেন নড়াচড়া শুরু করল এবং আমার আর জানালার মাঝে আর কেউ নেই! টেক অফের আগেই তাই জানালার পাশের সিট আমার দখলে। যাক শেষ পর্যন্ত একটা আশা পুর্ণ হল তাহলে।

পাখির চোখে বাংলাদেশ

উপর থেকে বাংলাদেশকে যে এত অসাধারন লাগে তা আগে কখনো চিন্তা পর্যন্ত করি নাই। এক কথায় অপূর্ব! মেঘের ফাঁক দিয়ে একে একে চোখে পড়লো হোটেল রেডিসন, গুলশান লেক, হকি স্টেডিয়াম; আরো অনেক কিছু, কিন্তু সব গুলো ঠিক মত বুঝতে পারি নাই। একসময় চোখে পড়ল গ্রাম। গ্রামের টিনের ঘরের চাল গুলো রোদে ঝিকমিক করছিলো। যাই দেখিনা কেন, কেবল সবুজ রংটাই চোখে পড়ে। সবুজের মাঝে এঁকে বেঁকে গেছে চকচকে রূপালি নদী। সবুজের মাঝে রূপালী ফিতার মত নদী; অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য। না দেখলে এককথায় বোঝানো অসম্ভব! আমি কবি মানুষ না। তাছাড়া কবিতা খুব একটা পড়িওনা। এক কথায় আমি কখনোই কবিতার সমঝদার ছিলাম না। তাই আমার ভান্ডারে কবিতার সংখ্যা অনেক কম। পাখির চোখে বাংলাদেশকে দেখে আমার মনে হয়েছিলো কোন কবিই এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশকে কোন কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেনাই; হোক সেটা রবিন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রলাল। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, যদি তাদেরকে রূপালী-সবুজের অসাধারন এই মিশ্রনটা দেখানো যেত তারা এক বাক্যে তাদের সব সৃষ্টি নতুন করে লিখতেন।

মহাপতঙ্গের পেটে

খাওয়া দাওয়ার দিক থেকে মনে হয় প্লেনের কোন বিকল্প নেই। শুরুতেই সকালের নাস্তা। কিছুক্ষন পর আবার নাস্তা। তারপর আবার এক প্রস্থ। তারপরে লাঞ্চ। মোটামুটি বেশ রমরমা অবস্থা আর কী! আমার পাশের লোক আবার সিলেটি প্লাস লন্ডনি। বেশ মাই ডিয়ার ধরনের। এই লোক বছরে তিন-চারবার দেশে আসে। তার কাছে ঢাকা-লন্ডনের দশ ঘন্টা জার্নি কোন ব্যাপারই না। এরই মধ্যে প্লেনের ছোট এলসিডি টিভিতে একের পর এক মুভি আর কার্টুন চলতে লাগলো। ডিজনী’র “ক্রনিকেলস অফ নারনিয়া”র দ্বিতীয় পর্বটা দেখে ফেললাম। আর কার্টুন নেটওয়ার্কের একটা চ্যানেলে লাগাতার ভাবে “বেন টেন” আর “কে এন ডি” চলছিলো।
শুনেছিলাম এয়ারহোস্টেসরা বেশ অমায়িক হয়। কথাটা মিথ্যা না। তবে একেকজনের যে দামড়া সাইজ, দেখলেই কিছু বলতে ভয় করে। আর ব্রিটিশদের হাসি দেবার ভঙ্গীটা বেশ অদ্ভুত। এরা হাসি দেবার সময় মাথা নাড়ানাড়ি করে চোখ ভুরু কুঁচকে বিটকেলে হাসি দেয়, ব্যাপারটা হাসি না ভেংচি বোঝা বেশ কঠিন! আমার পেছনের সীটে এক বঙ্গদেশীয় ছেলে পাশের সীটের সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছে এক ব্রিটিশ রমনীকে। কী তার উচ্ছ্বাস! পুরা জার্নিতে সে ইয়েস-নো-ভেরি-গুড টাইপের ইংলিশ দিয়ে মহিলার সাথে বকর বকর করে গেছে। আমি মাঝে মাঝে ভয়ে ছিলাম যে মহিলা না আবার ক্ষেপে যায়। তবে মহিলা দেখলাম বেশ সরব হয়েই ঐ আদমীর সাথে কথা চালিয়ে গেছে। ব্রিটিশরা সত্যিই বিচিত্র!

মেঘের রাজ্য

আকাশে মেঘ যে তিন স্তরে জানে এইটা জানতামনা। জানলাম যখন প্লেন মেঘের রাজ্যে ঢুকলো। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! মেঘের উপর মেঘ, তারও উপরে আরো মেঘ। কোন মেঘ ধূসর রঙা, কোন কোনটা ধবধবে সাদা, কোনটা দুধ সাদা, কোনটা আবার উজ্জ্বল সাদা, দেখলে মনে হয় ওগুলো থেকে ঠিকরে আলো বের হচ্ছে! মেঘের উপর মেঘ বসে মেঘের স্তম্ভ তৈরি করেছে। পেঁজা তুলার মত স্তম্ভগুলো যেন মেঘের রাজপ্রাসাদ। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো প্লেন থেকে নেমে মেঘের উপর একটু হেঁটে আসি!

অবশেষে হিথ্রো

দশ ঘন্টা মাটির সাথে কোন মোলাকাত নাই। তাই পাইলট যখন বলল যে প্লেন ইংল্যান্ডের আকাশ সীমায় পৌঁছে গেছে, নিজের ভেতর একধরনের ফুর্তি ফুর্তি ভাব কাজ করলো। প্রায় দশ ঘন্টা পর মাটির উপর পা রাখব অথচ মনে হচ্ছিল যেন যুগ যুগ পর মাটির দেখা পাচ্ছি! জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম নীচে – এই তাহলে লন্ডন শহর! কেবল রাস্তা আর বাড়ি আর কিছু দেখা যায়না! মাঝে মাঝে অবশ্য সবুজ রঙ চোখে পড়ে। টেমস্‌ নদীকে যত বড় ভেবেছিলাম তা আদৌ তত বড় না, অন্তত আমাদের দেশের নদীর কাছে কোন পাত্তা পাবেনা। নদীর পাশে বিখ্যাত লন্ডন আই দেখলাম। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে বিভিন্ন রঙের গাড়ি। বাড়িগুলোর গড়নে সেই আদ্যিকালের ছাপ এখনো স্পষ্ট। এক সময় প্লেন হিথ্রোতে নামলো।

আমার টিকেটে লেখা ছিল যে আমার প্লেন নামবে চার নম্বর টার্মিনালে আর আমস্টারডামের পরের প্লেন ছাড়বে টার্মিনাল ৫ থেকে। অনেকে হয়ত পাঁচ নম্বর টার্মিনালের কথা শুনেননি। টার্মিনালটা একদম নতুন। আমি ভেবেছিলাম টার্মিনাল দুইটা হয়তো পাশাপাশি, যেমনটা আছে ঢাকা এয়ারপোর্টে। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি রীতিমত আমাদের জন্য বড়সড় বাস দাঁড়িয়ে আছে টার্মিনাল পাঁচে নিয়ে যাবার জন্য। বাসে উঠার পর পরই ড্রাইভার বললো যে টার্মিনাল চার থেকে টার্মিনাল পাঁচের এই যাত্রাটা হবে আঠার মিনিটের! প্রায় কাঁটায় কাঁটায় আঠার মিনিট পর টার্মিনাল পাঁচে এসে পৌছালাম। নেমে দেখি আর এক এলাহি ব্যাপার।শত শত লোক বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা কথা বলে রাখি- টার্মিনাল চার আর টার্মিনাল পাঁচ কেবল মাত্র ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের নিজেদের ব্যবহার করার জন্য, অন্য কোন কোম্পানী এগুলো ব্যবহার করতে পারেনা। এদিকে বোর্ডিঙের লাইনে এক চীনা শিশু বড়সড় ধরনের হিসু করে দিলো। সাথে সাথে দেখি এয়ারপোর্টের লোকজন যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে এসে সেই হিসুকে গায়েব করে দিলো। তবে হিথ্রোতে নেমে বুঝতে কষ্ট হয় আমি ইন্ডিয়াতে আছি নাকি ব্রিটেনে আছি, চারদিকে কেবল ইন্ডিয়ান চেহারা, শিখ-নন শিখ সব ধরনের আদমিই আছে।

হিথ্রোর চেকিং আবার ভয়াবহ ব্যাপার। জুতা, বেল্ট, জ্যাকেট সবই খুলে ফেলতে হয় [আল্লাহ বাঁচাইসে যে প্যান্ট খুলতে হয়না]। সেই চেক পোস্ট পাড়ি দিয়ে যখন ভেতরে ঢুকলাম তখন দেখি আরেক জগত। ডিউটি ফ্রি এলাকায় ঢুকে গেছি আমি। কি নাই সেই এলাকায়! পারফিউম, জামা, জুতা, বই, ম্যাগাজিন, খাবার দাবার থেকে শুরু করে মায় আস্ত লাল রঙের ফেরারি পর্যন্ত আছে। ওহ… এই প্রথম আমি জীবনে সামনাসামনি ফেরারি দেখলাম; দেখার মত জিনিস একটা! আমি যখন হিথ্রোতে পৌঁছাই তখন ওইখানকার লোকাল সময় হল বিকেল তিনটা। আমার পরের প্লেন সন্ধ্যা ছয়টায়। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে অবশেষে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম। নেট ব্যবহার করব ভেবেছিলাম, ল্যপটপ অন করার পরই দেখি সে বেশ কিছু ওয়াইফাই ডিটেক্ট করতে পেরেছে, কিন্তু কোনটাই ফ্রী না! কী আর করা বসে বসে তখন এই লেখাটার প্রথম অংশটুকু লিখলাম।

আমস্টারডামের ডাক

একসময় আমার প্লেনের ডাক পড়ল। গেলাম নির্ধারিত গেটের কাছে। এসে দেখি বিশাল স্ক্রীনে বিবিসি দেখাচ্ছে। ভয়াবহ ব্যাপার! স্পেনে এক প্লেন টেক অফ করার সময় বিদ্ধস্ত হয়েছে। কী অবস্থা! প্লেনে উঠার সময়ই প্লেন দুর্ঘটনার খবর। ভয়ে ভয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে প্লেনে উঠলাম। ঢাকা থেকে যেটাতে এসেছিলাম সেটা ছিল বোয়িং। আর এবার যেটাতে উঠলাম সেটা হল এয়ারবাস। এগুলোর সাইজ ছোটখাট। প্লেন টেক অফ করার সময় দেখি প্লেন ঝিরঝির করে কাঁপছে! হাতের খবরের কাগজে তখনো প্লেন ক্র্যাশের খবর জ্বলজ্বল করছে। প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে ছিলাম সারাক্ষন। এবার প্লেনে শরমা টাইপের বিদ্ঘুটে এক জিনিস নাস্তা হিসেবে দিল। খেতে অবশ্য খারাপ লাগেনাই। ঘন্টা খানেক পর প্লেন আমস্টারডামের শিপল্‌ এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছুঁল। আমার ঘড়ি বলছে তখন স্থানীয় সময় রাত আটটা, কিন্তু বাইরে দেখি তখনো সূর্য উঁকি দিচ্ছে। শিপল হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম অত্যাধুনিক এক বিমানবন্দর যেখানে সরাসরি আন্ডারগ্রাঊন্ড রেলওয়ে আছে একেবার বিমানবন্দর থেকেই। ঐ রেলে করে যে কেউ পুরো নেদারল্যান্ডস ঘুরে আসতে পারে। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর আমার অবাক হবার পালা। সামনে একসাথে চব্বিশটা কনভেয়ার বেল্ট ঘুরতে দেখলাম! কখনো এতগুলো কনভেয়ার বেল্ট একসাথে কখনোই দেখিনাই।

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ষোল ঘন্টা জার্নি করে অবশেষে জায়গামত পৌঁছালাম। খারাপ লাগেনাই জার্নিটা। তবে একটা জিনিস একটু খারাপ লাগলো; সবখানেই দেখি বাংলাদেশী পাস্পোর্ট দেখলে একটু নাক কুঁচকায়। যাহোক… জীবনের প্রথম প্লেন জার্নি হিসিবে জার্নিটা ভালোই ছিলো।

অনুজীব, বই ও অন্যান্য

ন্ধুহীন পরিণতবেলা হতে পারে কিন্তু বন্ধুহীন ছেলেবেলা হয়না। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায় কথাটা আসলেই ঠিক। ছেলেবেলা বন্ধুহীন কাটিয়েছে এমন কয়জন পাওয়া যাবে? সংখ্যাটা হাতে গোনা যাবে। তবে বন্ধুত্ব যে সব সময় মানুষের সাথে করতে হবে এমন কোন কথা নিশ্চয়ই নেই। অনেকের ছোটবেলার খেলার সাথী থাকে বাসার পোষা বিড়াল বা কুকুরছানা অথবা টিয়া পাখি কিংবা নিদেনপক্ষে মুরগী। মুরগী বললাম এই কারনে যে শিশুবেলায় আমার নিজেরই মুরগী প্রজাতির সাথে বেশ প্রগাঢ় সম্পর্ক ছিল। সেই কাহিনীতে আসছি একটু পরেই। তবে এক দিক দিয়ে আমি মনে হয় সবাইকে টেক্কা দিয়েছি। কারন ছোটবেলাতে আমার মানুষ আর অন্য প্রাণীকূলের চেয়ে সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল মনে হয় অনুজীবকূল!

আরেকটু খোলসা করে বলা যাক। ছোটবেলায় রোগবালাই ছিল আমার নিত্য সাথী। অনেকটা টেনিদা’র প্যালারামের মত। অনেক চেষ্টা করেছি ওসব অনুজীবদের সাথে আড়ি নেবার জন্য, কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়তোনা। কী করিনাই! হোমিওপ্যাথ, এ্যালোপ্যাথ, কোবরেজী সব ট্রাই মেরেছি। কিন্তু সেই বন্ধুদের ফেরাতে পারিনি। হাতেগোনা কয়েকটা অসুখ বাদে মনে হয় সব অসুখ হয়ে গিয়েছিল। সব ডাক্তারের যখন আমাকে দেখে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন আমার ভার পড়ল দাদীর উপর। আমার দাদী আবার লতাপাতা দিয়ে চিকিৎসা করতে খুব পছন্দ করতেন। আশেপাশের সবার কাছে দাদী ছিল অঘোষিত ডাক্তার। আর আমি ছিলাম সেই অঘোষিত ডাক্তারের ঘোষিত গিনিপিগ। এখনও মনে পড়ে, সকাল বেলা দাদু বাজারে যাবার জন্য বের হলেই দাদী তাকে ভেষজ লতা পাতার একটা লিস্ট ধরিয়ে দিতেন। সেই লিস্ট মেনে দাদু সবসময় জিনিসপ্ত্র এনে দাদীর হাতে তুলে দিতেন। এরপর শুরু হত দাদীর চিকিৎসা। রোগ সারাবার চিকিৎসা হিসেবে কাঁচা শাপলা থেকে থানকুনী পাতা বা দুর্ব্বা ঘাস সবই আমাকে খাওয়াতেন। চিরতার রস ছাড়া আমার সকাল শুরু হবে ভাবাই যেতনা। দুপুর আর রাতে শিং মাছের ঝোল দিয়ে জাউ ভাত ছিল আমার জন্য ধ্রুব সত্য। কিন্তু এত কিছুর পরও পরিচিত মহলে ভীষণ সফল এই চিকিৎসক কেবল আমার কেসেই নীরব হয়ে যেতেন। আমি ছিলাম তার একমাত্র ব্যর্থতা!

বয়সকালে এসে রোগবালাই চলে গেলো। একেবারেই যে চলে গেলো তা না। এখনো তারা মাঝে মাঝে আসে, তবে কিনা অনেকদিন পর পর। এই অনুজীব গোত্রের পাশাপাশি আমার আরেক ধরনের বন্ধু ছিলো। তবে আগের গোত্রের মত তারা আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি, এখনো আছে আমার সাথে। এই নতুন গোত্র হল বই (পাঠ্য বই না কিন্তু)। ছোটবেলায় আমার নিত্য সঙ্গী ছিলো ফেলুদা, শঙ্কু, শার্লক হোমস, ক্যাপ্টেন নিমো বা টেনিদা। স্কুলের বইয়ের ভিতর রেখে পড়তাম চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কী, চান্নি চাচী, রমন; এমনকি হী ম্যান, থান্ডারক্যাটস্‌, স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান কোন কিছুই বাদ যায়নি। সমস্যা হত নন্টে ফন্টে, বাটুল বা হাদা ভোদা নিয়ে। এদের সাইজ বড় ছিলো বলে স্কুলের বইয়ের ভিতর আটতনা। টিনটিন বা এস্টেরিক্স নষ্ট হয়ে যাবে বলে কখনো স্কুলেই নিতামনা। ক্লাস সিক্সে উঠার পর জাফর ইকবালের বইয়ের সাথে পরিচয়। প্রথম পড়ি “দুষ্টু ছেলের দল”। ছোটদের নিয়ে ছোটদের মত করে যে উপন্যাস থাকতে পারে সেটা আমি প্রথম টের পেলাম ঐ বই দিয়ে। পাশাপাশি চলত সেবা প্রকাশনীর বিভিন্ন অনুবাদ আর বিখ্যাত তিন গোয়েন্দা সিরিজ। সেসময় “গোয়েন্দা রাজু” নামে আরো একটা সিরিজ ছিলো যেটা পরে বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থ্রিলারের জগতে আমার প্রবেশ। রবার্ট লুডলাম, টম ক্ল্যান্সি বা সিডনী শেল্ডন আমার ব্যাগে এখনো আমার সাথে ঘুরোঘুরি করে। এত বড় হয়ে গেছি তারপরো আমি এখনো হ্যারি পটার কিংবা নন্টেফন্টে বা টিনটিন পড়ি। এগুলো কতবার যে পড়েছি কোন তার কোন ইয়েত্তা নাই, তারপরও পড়ি, প্রতিবারই আমার কাছে তা নতুন লাগে। যখন এইসব বাচ্চাদের বই পড়ি তখন একবারের জন্যও মনে হয়না যে কাহিনী গুলো গাঁজাখুরি। এই লেখা যখন লিখছি, তখন আমার টেবিলে টিনটিনের “The Castafiore Emarald” বইটা পড়ে আছে।

লেখার শুরুতে এক মুরগীর কথা লিখেছিলাম। আমার প্রিয় সেই মুরগীর নাম ছিল “কাজলী”। চিক্‌চিকে কালো ছিলো দেখতে। সেই মুরগীর পর আরেকটা মুরগীর আমদানী হয় বাসায়। দেখতে লাল দেখে ঐটার নাম ছিল “লালী”। বিশাল লম্বা রশি দিয়ে সবসময় এদের পা বেঁধে রাখতাম, বাঁধা না থাকলে যদি পালিয়ে যায়! নানুর বাসায় প্রতি রাতে কোথা থেকে এক কুকুর আসতো। বেশ বড়সড় সাদা রঙের কুকুর। রাতের বেলা বাসার এঁটো খাবার খেতো আর সারা রাত বাসার সামনে বসে পাহারা দিত। কুকুরটাকে দিনের অন্য বেলায় খুব একটা দেখা যেতনা। নানু আদর করে ওকে বাবলু নামে ডাকতো। একদিন দেখি কারা যেনো বাবলুর পেছনের এক পা ভেঙ্গে দিয়েছে। দেখে এত কষ্ট লাগলো যে বলার মত না! এর পর যতদিন বাবলুকে দেখেছি ততোদিন ওকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি। একদিন হঠাৎ করেই বাবলু নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আর কোন দিন দেখি নাই ওকে। এখনো রাস্তাঘাটে সাদা কুকুর দেখলে বাবলুর কথা মনে পড়ে।

জালের জগতে প্রথম ঠিকানা

এই লেখাটা প্রথম লিখি সচলায়তনের জন্য। তারপর মনে হল কিছু কিছু জায়গা আরো চমৎকার করে লেখা যায়। তাই ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে লেখাটার এই ব্লগে আগমন।

জালের জগতের সাথে প্রথম মোলাকাত ইন্টার পরীক্ষা দেবার ঠিক আগে আগে। সময়টা ছিলো ২০০২ এর শুরু’র দিকে। আমার জালের জগত সম্পর্কে জ্ঞান তখন খুবই করূণ। ইন্টারে রচনা কমন ফেলার জন্য যতটুকু জানা দরকার তার চেয়ে বেশি না। এই জগতের মাজেজা আমার কাছে তাই সম্পূর্ণ অচেনা। এক বন্ধু তখন এমএসএন ম্যাসেঞ্জারে চুটিয়ে প্রেম করছে কানাডা প্রবাসী (আদৌ কানাডা প্রবাসী কি না কে জানে!) এক মেয়ের সাথে। বন্ধুর সাথে সেই মেয়ের ছবি দেখতে গিয়ে আমার জালের জগতে হাতে খড়ি। তো আমার এই হাতেখড়ির পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি- আমার বন্ধুর না ওর বান্ধবীর (আরো সহজ করে বললে একজন নরের নাকি নারীর) সেটা এখনো আমাকে বেশ ভাবায়। যাই হোক আমার মত নাদান তখনো এই জগতের মহীমা বুঝতে পারেনাই!

মহীমা বুঝতে পারি যখন আমার প্রথম ইমেইল এড্রেসটা খুলি। কী ফটাফট এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চিঠি চলে যায়! জালের জগতে আমার প্রথম ঠিকানা তৈরি করি আইইউটিতে ভর্তি হবার পর। এই ঠিকানা খুলতে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। একে তো ইন্টারনেট কী তা জানিনা তার উপর ইমেইল কেমন করে ব্যবহার করে সেটা সম্পর্কেও অজ্ঞ।

আইইউটিতে ভর্তি হবার পর একদিন আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের সবাইকে একটা এপ্লিকেশন ফর্ম দিয়ে জানানো হলো যে আমাদের সবার নামে স্টুডেন্ট ইমেইল একাউন্ট খোলা হবে, সবাই যেন নিজেদের পছন্দের নাম জমা দেয়। আগেই বলেছি আমি ছিলাম নাদান। তো নাম যেহেতু চাইলো আমি তাই বাবা-মা’র দেয়া আমার ঊনিশ অক্ষরের (আন্ডারস্কোরসহ একুশ অক্ষর) বিশাল নামটাই দিয়ে দিব বলে ঠিক করলাম। এরই মধ্যে একদিন আবিষ্কার করলাম পোলাপান সব কাব্যিক নাম দিচ্ছে। কী বাহার সেই সব নামের! স্বপ্নীল, দলছুট, নীলআকাশ। আবার মারমার কাটকাট নামও ছিলো বেশ কয়টা; যেমন ডেথবয়, হেলকীপার, ফায়ার অফ ফিউরি। একজনতো ম্যাট্রিক্স মুভি দেখে সেই ছবির নায়ক চরিত্র নিও’র নাম দিয়েছিল নিজের একাউন্টে। আমার মত আরেকজন নাদান আবার তার প্রেমিকার নামে নিজের একাউন্ট খুলে বসেছিলো!

এতসব নামের বাহার দেখে আমি বুঝলাম যে স্মার্ট হতে আমার এখনও অনেক দেরী। কী আর করা, আমার ইমেইলের নামতো বদলাতে হবে। স্টাইলিশ নাম দিতে হবে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার ঊনিশ অক্ষরের নামের মধ্যে মোট তিনটা অংশ, যার মধ্যে শেষ অংশের বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় “যার কোন ক্ষয় নাই”। ডিকশনারি নিয়ে বসলাম এর ইংলিশ প্রতিশব্দ বের করার জন্য। শেষমেষ বের করে ফেললাম। নামটা জমাও দিয়ে দিলাম। আমার প্রথম ইমেইল নিকটা ছিল “ইটারনাল” [ETERNAL]। সেই অনুযায়ী জালের জগতে আমার প্রথম ঠিকানাটা ছিলো eternal@iut-dhaka.edu . বিভিন্ন ল্যাব রিপোর্ট কিংবা এসাইনম্যান্ট দেবার কাজেই কেবল এই ঠিকানাটা ব্যবহার করতাম। পাঠশালার চার বছর এই ঠিকানা আমার সাথে ছিলো। পাঠশালার পাট চুকে যাবার সাথে সাথে এই ঠিকানাটাও বিলীন হয়ে যায়।

ল্যাব রিপোর্ট কিংবা এসাইনম্যান্ট জমা দেয়া ছাড়া অন্য কোন কাজে এই ঠিকানাটা খুব একটা ব্যবহার করতামনা, কারন কদিন পরেই হটমেইল আর ইয়াহু’র খোঁজ় পেয়ে গেলাম। এর পর কত জায়গায় কত নামে ঠিকানা খুলেছি তার ইয়েত্তা নাই। অবশ্য সার্বজনীন ঠিকানায থিতু হতেও খুব একটা সময় লাগেনি। কিন্তু ঐ প্রথম ঠিকানাটা কখনোই ভুলতে পারিনা।

বেগুনী গোলাপ ফুল

খুব ছোট থাকতেই আমার ছবি আঁকার শখ। বাসার দেয়াল থেকে মেঝে সব জায়গাতেই আমার প্রতিভার ঝলক থাকত। আমি ছবি আঁকতাম আমার মত করে। কে কি ভাবলো সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নাই। এই না মাথা ঘামানো অভ্যাসটা কেজি ওয়ানে আমার জীবনের প্রথম ড্রইং পরীক্ষায় ফেল করতে টনিকের মত কাজ করেছিলো। আমার পুরো স্কুল জীবনে ওই একটা বিষয়েই আমি ফেল করেছিলাম।

স্কুলে যাবার আগে থেকেই আমি ছবি আঁকতাম। স্কুলে ভর্তি হবার পর দেখলাম ড্রইং নামে আলাদা একটা সাবজেক্ট আছে। আমাকে আর পায় কে? মনের মত ছবি আঁকতাম। ক্লাসে সবাই আমার ছবির খুব প্রশংসা করত। কেবল একজন ছাড়া, আমাদের ড্রইং টীচার। সেই মহিলার কাছে আমার সব ছবিই কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং! ক্লাসে যাইই আঁকি না কেন সেই টীচার আমার সব কিছুতেই ভুল ধরেন। হাতি আঁকতে দিলেন, এঁকে দিলাম। কিন্তু টীচারের পছন্দ না। আমার আঁকা হাতির শুঁড় নাকি স্প্রিংয়ের মত প্যাচানো। হাতির এত বড় একটা শুঁড়, ওইটা কি হাতি সোজা ঝুলিয়ে রাখবে? এত সুন্দর একটা লকলকে জিনিস আমার থাকলে আমিও তো প্যাঁচিয়ে রাখতাম। মানুষের হাত কি মানুষ সোজা ঝুলিয়ে রাখে? হাতকে স্প্রিংয়ের মত প্যাচানো যায়না দেখে মানুষ হাত ভাঁজ করে রাখে। এখানেই শেষ না আমার আরো ভুল ছিল। হাতীর রঙ কেন নীল দিলাম! আরে বাবা হাতির গায়ের যে রঙ সেটা কি দেখতে খুব সুন্দর? কেমন ম্যাটম্যাটে রঙ। দেখলেই তো বমি আসে। এর চেয়ে নীল রঙের হাতি দেখলেই তো মন জুড়িয়ে যায়, কেমন একটা স্নিগ্ধ ভাব। টীচার কে কে বোঝায়!

দেখতে দেখতে ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষা চলে আসলো। সবার শেষ পরীক্ষা ছিল ড্রইং। ড্রইং পরীক্ষায় আমাদের আঁকতে দেয়া হল গোলাপ ফুল। মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকে চলেছি। কোন দিকে খেয়াল নাই। এক এক করে সবাই খাতা জমা দিয়ে দিচ্ছে, আমি তখনো রঙ পেন্সিল দিয়ে রঙ করে চলেছি। পাঁপড়ি রঙ করা শেষ, ডাঁট রঙ করে ফেললাম। বাকী আছে পাতা। যে-ই দেখছে সে-ই তারিফ করছে। সবারই একই কথা এমন সুন্দর গোলাপ ফুল কেউ জীবনে দেখেনি । অনেকে আফসোস করা শুরু করলো, যদি আমার মত করে আঁকতে পারতো। অন্যদের হা হুতাশ শুনে বুক গর্বে ভরে গেলো। এবার হায়েস্ট মার্কস ঠেকায় কে? রঙ পেন্সিলের শেষ টান টা দিলাম। খাতাটা নিজের সামনে মেলে ধরে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না , এত সুন্দর এঁকেছি আমি! খাতটা জমা দিতে খারাপ লাগছিলো, এত সুন্দর ছবিটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। কিন্ত খাতা জমা দিতে হবে – এটাই পরীক্ষার নিয়ম। নিয়মের বাইরে তো আর যাওয়া যায়না। কী আর করা, খাতাটা জমা দিয়ে দিলাম। খাতা নেবার সময় টীচার একবার আমার খাতা দেখলেন, তারপর আমার দিকে আড় চোখে তাকালেন। নাহ্‌ এবার টীচার তারিফ না করে যাবে কই! মনে মনে বেশ খুশি হলাম। জায়গায় গিয়ে বসতে যাব এমন সময় টীচার আমাকে ডাকলেন। আবারো খুশি হলাম। যে সুন্দর ছবি এঁকেছি টীচার না ডাক দিয়ে পারেবেনইনা। খুশি খুশি মনে গেলাম।
“সবাইতো গোলাপ ফুল এঁকেছে তুমি এটা কি একেছো?” টীচারের প্রথম প্রশ্ন।
“জ্বী, এটাও গোলাপ ফুল।” আমতা আমতা করে বললাম।
“এটা কে গোলাপ ফুল বলে?” আমি দুর্বলভাবে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম।
“আমি যদি বলি এটা একটা বেগুন!” টীচার বলে কি, জ্বলজ্যান্ত গোলাপ ফুল কেন বেগুন হবে বুঝলাম না।
“গোলাপ ফুল দেখতে কি বেগুনী রঙের?”
“আসলে টীচার গোলাপী রঙের ফুল দেখতে ভালো লাগেনা। গোলাপের রঙ বেগুনী হলে ভালো হত তাই…”
“গাধা! এজন্য তুমি রঙ পালটে দেবে! কোথাও কখনো বেগুনী রঙের গোলাপ ফুল দেখেছো। আর গোলাপের পাঁপড়ি কি এরকম লম্বা লম্বা হয়?”
“গোলাপ ফুল দেখতে যদি সূর্যমূখী ফুলের মত হত…” – আমি বলার চেষ্টা করি।
“তাহলে পৃথিবীর সব ফুলই সূর্যমূখী হত, কেউ গোলাপ বলে কিছু দেখতনা।” গোলাপ না দেখলে সমস্যা কোথায় বুঝলাম না। সূর্যমূখী দেখতে কত সুন্দর, ইয়া বড় সাইজ। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। কোথায় গোলাপ আর কোথায় সূর্যমূখী! কিন্তু টীচারের থমথমে রাগী চেহারা দেখে কিছু বলার সাহস পেলামনা। চুপচাপ বকা হজম করে যাচ্ছি।
“ফুলের ডাঁট উপরে কেন?” টীচার এবার পুরোপুরি ক্ষিপ্ত।
“আমি আসলে গাছ থেকে একটা ফুল পড়ে যাচ্ছে সেই অবস্থার কথা কল্পনা করে ছবিটা এঁকেছি। এটা পড়ন্ত ফুল তো তাই ডাঁটটা উপরের দিকে। নীচে পড়ে গেলেই আবার ঠিক হয়ে যাবে।” আমি আশ্বাস দিলাম। আসল কথা হল আমি আঁকার সময় খাতাটা উলটা করে ধরেছিলাম। টীচারের যেই রাগী মূর্তি, সত্যি কথা বলার সাহস পেলাম না। যদি আমার ভুল টের পেয়ে মারধর শুরু করেন? সেজন্য মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিলাম। টীচার বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

এরপরের ঘটনা খুব ছোট। আমি ওই পরীক্ষায় ফেল করলাম। এরপর সেকেন্ড টার্ম এবং এ্যানুয়াল পরীক্ষা দিলাম। কিভাবে কিভাবে যেন ক্লাস ওয়ানে উঠেও গেলাম। কিন্তু ওই ছোট বয়সেই টের পেয়েছিলাম, গতানুগতিক পথের বাইরে চলতে গেলে কীভাবে আটকে দেয়া হয়। মাঝে মাঝে ভাবি রাইট ভাইদ্বয় কল্পনায় মানুষকে উড়তে দেখেছিল বলেই আজকের দিনে এরোপ্লেনে আমরা উড়োউড়ি করি। যদি তাদের ধমক দিয়ে বলা হত “কত বড় ফাজিল, মানুষের নাই ডানা তাকে আবার আকাশে উড়ায়! এক্ষুনি এসব ফাউল কল্পনা বাদ দাও।” তাহলে আমরা আজকে কোথায় থাকতাম! অবশ্য আমার মত নগন্য মানুষের নীল হাতি বা বেগুনী গোলাপ ফুলের স্বপ্নের সাথে এরোপ্লেনের স্বপ্ন ঠিক মিল খায় না! কোথায় রাইট ভাইরা আর কোথায় আমি! কোথায় চাঁদপুর কোথায় কুয়ালালামপুর! তবে স্বপ্ন তো স্বপ্নই, সেটা যেরকমই হোক।

রুমমেট সমাচারঃ দ্বিতীয় প্রজন্ম

পাঠশালায় যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম পুরোন বছরের সাথে সাথে নিজের রুমখানাও বদলে ফেললাম। ৫২২ নম্বর রুম থেকে আমার নতুন ঠাঁই হল ৫২১ এ। রুমটার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটা একেবারে বাথরুমের সাথে লাগোয়া। এতে একটা সুবিধা হয়েছিলো যে বাইরের সবাইকে বলে বেড়াতাম আমাদের রুমের সাথে একেবারে এটাচ্ড বাথরুম আছে! ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে আমাদেরকে প্রতি রুমে চারজন করে থাকতে হোত। সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর এক রুমে তিন জন থাকার পারমিশন পাওয়া গেল। সে হিসেবে ৫২১ এ চার জন ছিলো যাদের দুইজন সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতেই অন্যরুমে চলে যায়। তাছাড়া আমারো সমস্যা হচ্ছিল, কারন ৫২২ এ আমার ডিপার্টমেন্টের কেবল মাত্র আমি ছিলাম। ফলে দেখা যেত আমাকে পরীক্ষার আগে প্রায়ই অন্যরুমে পড়া বুঝতে ছুটতে হত। তাই দিপু আর মিফতাহ যখন ওদের ৫২১ নম্বর রুমে আমাকে থাকার কথা বল্লো, একেবারে কোন কিছু চিন্তা না করেই রাজী হয়ে গেলাম। ভাগ্যিস হয়েছিলাম, নাহলে আমি আমার জীবনের খুব কাছের দুজন বন্ধুকে কখনোই পেতাম না।

ফাইনাল ইয়ারে আমরা তিনজন রুম পালটে তিন তলার ৩১৫ নম্বর রুমে চলে আসি। তার আগ পর্যন্ত বাথরুমের পাশের এই রুমটাতেই দুই বছর কাটিয়ে দেই। পাশে বাথরুম থাকাতে কখনোই কোন সমস্যা হয় নাই… কেবল মাত্র একবার ছাড়া, যেবার বাথরুমের টয়লেটগুলো ওভারফ্লো করেছিলো! আরেকটা ব্যাপার, কোন এক অজ্ঞাত কারনে প্রায়ই মাঝরাতের পর চামচিকা ঢুকে পড়ত আমাদের রুমে। এত রুম থাকতে আমাদের রুমেই কেন বারবার ঢুকত কে জানে?

এই রুমে আমার সাথী হল দিপু আর মিফতাহ। আমাদের ব্যাচ যতদিন পাঠশালায় ছিল ততদিন সম্ভবত সবচেয়ে দুই জনপ্রিয় চরিত্র ছিল এই দুইজন। এখনো সবাই একনামে এই দুজনকে চেনে। আমাদের তিনজনের মধ্যে প্রচুর মিল ছিলো। তিনজনই বকবক করতে পছন্দ করতাম। তিনজনেরই বাসা ছিল একই জায়গায়। আমাদের গ্রামের বাড়িও ছিল একই জেলায় – ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায়। আমাদের রুমের নামই হয়ে গিয়েছিলো বিবাড়ীয়া এক্সপ্রেস! বলতে ভুলে গেছি, আমাদের তিনজনই একই ল্যাব গ্রুপে ছিলাম।

মিফতাহ’র যে গুনটা সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলো সেটা হলো, সে যেকোন ঘটনা এত দারুন করে বলতে পারত যে বোঝা মুশকিল সে ওই সময় ওই জায়গায় ছিলো কিনা কিংবা ওই ঘটনা আদৌ ঘটেছিলো কিনা। ব্যাপারটা কিছুটা চাপা মারার মত কিন্তু ঠিক চাপা না। তবে নিজের বাহাদুরির জন্য কখনো এসব বলত না। ও ছিল কিছুটা আরামপ্রিয়। সকালের ক্লাস গুলোতে ওকে তেমন একটা পাওয়া যেতনা, ঘুমের জন্য। তবে শনিবার ছিলো ব্যতিক্রম, কারন ওই দিন আমাদের পাঠশালার ভোজনখানার সকালের মেনু ছিল গরম গরম তেহেরি। অকাটমূর্খ ছাড়া ওই জিনিস কেউ মিস করেনা। ওর আরেকটা মহা গুণ হলো মাথায় একবার কিছু ঢুকলে অন্তত দুইদিন ওই জিনিস ছাড়া ও আর কিছু ভাবতে পারতোনা। তবে দুই দিন পর সব আবার আগের মত! একবার মাথায় চাপলো কবিতা লিখবে, ব্যস আর যায় কোথায়… খাতা -টাতা খুলে কবিতা লেখা শুরু করলো। তিনদিন পর মনে হল কবিতা লেখা পোষাবেনা, উপন্যাস লিখা দরকার… সাথে সাথে আরেকটা খাতার আগমন , এবার উপন্যাসের পালা! আরেকবার মাথায় চাপলো সকালে উঠে জগিং করবে, যেমন কথা তেমন কাজ, প্রতিদিন ভোরে শখের বিছানা ছেড়ে জগিং এর জন্য উঠত। এভাবে চললো প্রায় দুই দিন। তবে সবচেয়ে বেশিদিন যেটা টিকেছিলো সেটা হল দাবা খেলা। হঠাৎ বলা নাই কওয়া নাই কোথা থেকে এক দাবার বোর্ড জোগাড় করে নিয়ে আসলো। তারপর একে একে সবাইকে দাবার চ্যালেঞ্জ দিত। কেউ না চ্যালেঞ্জ না নিলে প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে বসাতো দাবা খালানোর জন্য। মনে আছে, একবার রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আমার চোখের সামনে যে দৃশ্য ছিল তা হল ও আর রায়হান গভীর চিন্তা মগ্ন হয়ে দাবা খেলছে। এ দেখতে দেখতেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। প্রায় ছয় ঘন্টা পর ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি একই দৃশ্য! ছয় ঘন্টা ধরে দুজনে দাবা খেলছে, তাও আবার পুরোরাত না ঘুমিয়ে! ফাইনাল ইয়ারে ওর পাঠশালার ভেতর সাইকেল চালানোর খুব শখ হল। সেই শখ মেটাতে ও ঢাকায় এসে সাইকেল কিনলো, সেটা কে ঢাকা টু গাজীপুর বাসের ছাদে তুলে সোজা পাঠশালায় নিয়ে আসলো। তবে ঐ বস্তু চালাতে গিয়ে আমার বেশ বাজে অভিজ্ঞতা চছে। পাঠশালায় আনার পর সেটা চালাতে গিয়ে আমি একেবারে রাস্তার উপর ধপাস্‌ করে ফ্ল্যাট!

এবার আসা যাক দিপুর কথায়। এই ছেলে আবার মিফতাহ’র মত না। মিফতাহকে যত সহজে বর্ণনা করা গেলো, একে আবার তত সহজে করা সম্ভব না। দিপুকে কোন ছাঁচে ফেলা মুশকিল। এই বান্দা’র পড়াশুনায় মাথা যথেষ্ট ভাল (যদিও সে কখনো ওর মাথার পঞ্চাশ পার্সেন্টও ব্যবহারকরে নাই)। ওর পড়াশুনার স্টাইল ছিল কিম্ভুত। মাঝে মধ্যেও বিছানায় এমনভাবে শুয়ে পড়াশুনা করত যে দেখে বোঝার উপায় নাই ও পড়ছে না ঘুমাচ্ছে! ওর পড়াশুনার প্রিয়জায়গা ছিল ওর টেবিল (চেয়ার না কিন্তু) যেটার উপর প্রায়ই সে একেবারে দুপা তুলে আসন করে বসতো। একবার দেখি ও বাথরুমে গিয়ে পড়ছে। জিজ্ঞেস করায় বললো ওর নাকি বাথরুমের নিশব্দতায় খুব ভালো পড়া হয়! প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার জন্য ও ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতো। সকালে এলার্ম বেজেই চলত, কিন্তু ওর ঘুম থেকে উঠার সামান্যতম লক্ষণ দেখা যেতনা। আমাকে বা মিফতাহকেই সকালে সাধের বিছানা ছেড়ে ওই এলার্ম বন্ধ করতে হত! কোন রুমে একটু আড্ডার গন্ধ পেলেই হত, দিপু নিমিষেই সেখানে হাজির। যেকোন আড্ডায় ও ছিলো মধ্যমণি। ও যে কারো কথা বলার ধরন নিঁখুতভাবে নকল করতে পারতো। আমাদের তিনজনের মধ্যে একমাত্র দিপুই মূভি খুব একটা দেখতোনা (যদিও আমাদের মত খুব কার্টুন দেখত)। তবে ও ভোজন রসিক। বলতে দ্বিধা নাই ওর পাল্লায় পড়ে ফার্মগেটের ওভারব্রিজের তলায় বিসমিল্লা’র হালিম থেকে শুরু করে এলিফ্যান্ট রোডের মালঞ্চ বা ধানমন্ডির স্টারের বোরহানী কোন কিছুই বাদ দেইনাই। বন্ধুদের জন্য দেদারসে টাকা পয়সা খরচ করে ও। ওর মত রসিক মানুষও আমি খুব একটা দেখি নাই। যেকোন পরিস্থিতিতে যে কাউকে হাসানোর ক্ষমতা একমাত্র ওরই আছে। স্বিদ্ধান্ত দিতে ওর কম সময় লাগতো আবার সেটা বদলাতেও বেশি সময় লাগতনা। সেকেন্ড ইয়ারের একটা ঘটনা, মিড সেমিস্টার পরীক্ষা ওর ভাল হয়নি, মন খুব খারাপ। প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে, ও আমাদের পূরো রুমে বিভিন্ন স্লোগান লিখে পোস্টারিং করে ফেললো। পোস্টারের ভাষাও দেখার মত, একেটাতে একেক ধরনের লেখা। ।কোনটা উৎসাহমূলক -“এইবার পড়তে হবে”, “কোন সাব্জেক্টকে ছাড়ন নাই”, “এই পরীক্ষা তো পরীক্ষা নয় আরো পরীক্ষা আছে, এই পরীক্ষারে নিব আমি সেই পরীক্ষারও কাছে”; আবার কোনটা হয়ত তিরস্কারমূলক -“দিপু, এইবার না পড়লে তোরে খাইসি”, “ফাউল কামে আর কত, এইবার পড়ায় মন দাও”। ভয়ের ব্যাপার, অবস্থা তো বেগতিক। আমরা ভাবলাম ছেলে না আবার পরে পরীক্ষার দুঃখে অন্যকিছু করে বসে। এক সময় পরীক্ষা শেষ হল। খাতা দেয়া যখন শুরু হল তখন দেখা গেল ও যত খারাপ খারাপ করবে ভেবেছিলো আসলে তত খারাপ হয়নাই পরীক্ষা। পরীক্ষা যখন খারাপ হয়নাই তাহলে পোস্টারের দরকার কী! একটা একটা করে সাব্জেক্টের খাতা দেয়া হতে থাকল আর আমাদের রুম থেকেও পোস্টার কমতে থাকলো। একসময় দেখা গেলো সব পোস্টারই হাওয়া হয়ে গেছে!

পাঠশালার শেষ দিনটি পর্যন্ত আমরা একসাথে ছিলাম। হোস্টেলে অনেক রুমে রুম্মেটদের মধ্যে ঝগড়া এমনকি মারামারিও পর্যন্ত দেখেছি। কত রুমে রুম্মেটদের মাঝে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নাটক দেখেছি। কিন্তু আমাদের তিনজনের মধ্যে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও কোন ঘাপলা হয়নি। তিন বছরের মধ্যে বরং আমাদের বন্ধুত্ব আরো মজবুত হয়েছে, যেটা এখনো হয়ে চলেছে। আমার রুম্মেট ভাগ্য আসলেই ঈর্ষা করার মত।

রুমমেট সমাচারঃ প্রথম প্রজন্ম

আইইউটিতে যখন প্রথম গেলাম তেমন কাউকেই তখন চিনিনা। নটরডেমের কয়েকজন পরিচিত বন্ধু ছিল… এইযা। এদিকে বাসায় আম্মু চিন্তায় অস্থির! ছেলে প্রথমবারের মত হোস্টেলে থাকতে যাচ্ছে, রুমমেট হিসেবে কারা পড়ে, ওদের পাল্লায় পড়ে ছেলে আবার উচ্ছন্নে যায় কিনা – এইরকম হাজারো চিন্তা! অন্যদিকে আবার বিভিন্ন পরিচিত মানুষজন হোস্টেলে থাকলে ছেলেপেলে কিরকম খারাপ হয় তার একেরপর এক উদাহরন দিয়ে যাচ্ছে রাতদিন।

যাই হোক সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আমার ঠাঁই হলো সাউথ হলের ৫২২ নম্বর রুমে। এই লেখার শুরুতে “প্রথম প্রজন্ম” কথাটা লিখলাম এই কারনে যে আইইউটি জীবনে আমি রুম বদলেছি মোট তিনবার আর রুমমেট পেয়েছি টোটাল দুই সেট। আইইউটিতে প্রথম বছরে আমার প্রথম রুম আর প্রথম রুমমেটদের নিয়ে এই লেখাটা। দ্বিতীয় প্রজন্মের রুমমেটদের কাহিনী আসছে পরের লেখায়।

প্রথম যার কথায় আসছি সে মানুষ হিসেবে ছিলো একদম সাদাসিধা আর মেধাবী। কলেজ লাইফ থেকেই ওকে চিনতাম। ভদ্র শান্তশিষ্ট মানুষ। সহজে কারও উপরে রাগ করেনা। সারাক্ষন ওর পড়া নিয়ে থাকে। একদম সাধারন একটা মানুষ বলতে যা বুঝায়। ও ছিলো সিআইটিতে। প্রায়ই দেখা যেত পরীক্ষার আগের রাতে ওর কাছে ছেলেপেলের ভীড় লেগে যেত। ভাল স্টুডেন্টদের লাইফ যেমন হয় আরকি! নিজের পড়ার খবর নাই, অন্যদের পড়িয়েই রাত কাবার। অবশ্য এখনো ও অন্যদের পড়ায় মানে পাঠশালায় (আইইউটি) টিচারগিরি করে। আরেকজন যে ছিলো সেও নটরডেমে আমার সাথে একই গ্রুপে ছিলো। তবে ওর আসল নাম জেনেছি আইইউটিতে আসার পর। নটরডেমে সবাই ওকে ডেঙ্গু নামে চিনতো। এই নামেরও এক ইতিহাস আছে। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই ওর ডেঙ্গু হয় আর ডেঙ্গু জ্বর তখন সবেমাত্র বাংলাদেশে আমদানী হয়েছে। তো বেচারা First Come First Serve অবস্থায় পড়ে গেলো। সম্ভবত ওই ছিলো নটরডেমে প্রথম ডেঙ্গু ধরা পাবলিক। সেই থেকে ওর নাম ছিল “ডেঙ্গু”। তো এই ডেঙ্গু প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে মশারির ভিতর কিসব বিদঘুঁটে সব শব্দ করে ঘুমাতে যেত। মোটামুটি যখন ওই শব্দের সাথে মানিয়ে নিয়েছি তখন একদিন শুনি ও বুয়েটে চলে যাচ্ছে। ও আমাদের সাথে ছিলো প্রায় দুই সপ্তাহ। ৫২২ নম্বর রুম থেকে ডেঙ্গু বিদায় নেবার পর ওর জায়গায় আসলো এক দার্শনিক। এই দার্শনিকের কথায় একটু পরে আসছি। তার আগে আরেক রুমমেটের সাথে পরিচয় করানো দরকার।

এই বান্দা ছিলো আমাদের তুলনায় বিশালদেহী। গলার আওয়াজও ছিলো মাশাল্লাহ… ওই গলার আওয়াজ ছাপিয়ে কথা বলা আর বাংলাদেশ রেলওয়ের চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনের ছাদে বসে ফোনে কথা বলা প্রায় একই জিনিস। সত্যি বলতে কি ও রুমে ছিল বলে আমাদের বেশ সাহস লাগতো। একদিনের ঘটনা। তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছিলো। স্টুডেন্ট সেন্টারে ভীড়ের ঠেলায় ঢোকাই যেতনা! এদিকে আবার দুইটা টেলিভিশনই স্টুডেন্ট সেন্টারে। আমার ‘দশাসই’ রুমমেট তখন বিশ্বকাপ মহামারিতে চরমভাবে আক্রান্ত। ঝোকের চোটে নিজের বাসা থেকে টেলিভিশন নিয়ে আসলো সে। সেটা রাখা হলো আমাদের রুমে। কেবল মাত্র আমাদের চারজনের ওই টিভিতে খেলা দেখার কথা থাকলেও মোটামুটি আমাদের ইয়ারের সবাই চলে আসতো খেলা দেখতে। সবার সাথে আমার এই রুমমেটের ভাল ভাব থাকলেও কয়েকজনের সাথে খিটমিট ছিলো। তো দেখা গেলো এক সন্ধ্যায় খেলা দেখতে সেসব খিটমিটদের একজনের আমাদের রুমে আগমন। একে দেখেই ‘দশাসই’ এত ক্ষেপে গেল যে ওর গলার আওয়াজ শুনে নীচতলা থেকে সিনিয়র ভাইরা সব ছুটে উপরে এল কী হয়েছে তা দেখতে! এই বান্দা আবার মাঝে মাঝে ঘুমের মাঝে নাকে হাল্কা হিমেশ রেশামিয়া টাইপ সুর তুলতো। ওর সুরে তেমন জোর ছিলোনা (এইটা অবশ্য জেনেছি আসল হিমেশের ‘নাক’ শোনার পর!) অনেকটা মশার পিনপিন শব্দ। এবার আসি দার্শনিকের কথায়। এই দার্শনিক আমাদের রুমে আসলো ‘ডেঙ্গু’ বিদায় নেবার পর। ‘ডেঙ্গু’ বিদায় হবার সময় ওর যাবতীয় সম্বল (লেপ, তোষক, বালিশ, বিছানার চাদর এইসব হাবিজাবি যা ও আমাদের পাঠশালা থেকে নিয়েছিল) ফেরৎ দিয়ে দিলো। ফলে আমাদের রুমটাতে চারটা খাটের মধ্যে একটাকে পুরোপুরি জীর্ণ মনে হচ্ছিলো। সেদিন ক্লাস থেকে ফিরে এসে দেখি সেই জীর্ণ খাটে একটা তোষক আর দুইটা বালিশ পড়ে আছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি তোষকের উপর বিছানার চাদর, লেপ, কম্বল এইসব পড়ে আছে। ব্যাপার কী! ‘ডেঙ্গু’ ফিরে এল নাকি! ব্যাপারটা পরিষ্কার হল যখন আমি বাথরুম থেকে গোসল সেরে রুমে ফিরলাম তখন। এসে দেখি সেই জীর্ণ খাট তার দৈন্য চেহারা থেকে একেবারে সুপুরুষ হয়ে গেছে, আর সেই খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে আরেক পুরুষ, মানে সেই দার্শনিক পুরুষ আরকি! সেই থেকে দার্শনিকের ৫২২ এ থাকা শুরু। এই দার্শনিক সবসময় ভাবুক মনে কেবল কী যেন চিন্তা করে। প্রায়ই সময় সে খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে ওর বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে হাতে কলম নিয়ে খেলা করতো আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে কী যেন ভাবতো। তো দেখা যেত যে এই দার্শনিকের কাছে প্রায় সব কিছুরই একটা উত্তর থাকত, সেটা পড়াশুনা নিয়েই হোক অথবা ভবিষ্যৎ জীবন। যেকোন কথা শুনে সে একটা সূক্ষ্ম হাসি দিত। হাসিটা বেশ বিভ্রান্তিকর ছিল, ছোট বাচ্চাদের অর্থহীন কথা শুনলে বড়রা যেমন হাসি দেয় অনেকটা সেরকম। তবে পড়ালেখায় ছেলের মাথা ভালো ছিল। আমার সন্দেহ ছিলো ও বুঝি মাঝে মাঝে কবিতা টবিতা লিখতো (যদিও কখনো প্রমান পাই নাই)। পুরো ২০০৩ সাল আমি ৫২২ নম্বর রুমে এই তিনজনের সাথে ছিলাম। সত্যি বলতে কি বেশ ভাল ছিলাম। ওই তিনজন রুমমেট হিসেবে খুবই দারুন ছিল। ২০০৩ এর শেষ দিকে সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে আমি ৫২২ ছেড়ে ৫২১ এ আসি। রুম বদলাবার কারন অবশ্য অন্য। ৫২২ এ একমাত্র আমিই ছিলাম ইলেক্ট্রিক্যালের ছাত্র। তাই দেখা যেত পরীক্ষার বেশ ঝামেলায় পড়তে হত। তাই এমন একটা রুম চাচ্ছিলাম যেখানে আমি আমার ডিপার্টমেন্টের কাউকে রুমমেট হিসেবে পাব। এ কারনেই আমার ৫২২ ছেড়ে ৫২১ এ আসা।

আমরা সবাই রকি!

রকিকে (এঁই রঁকি) চেনেনা অথচ ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আইইউটিতে ছিল এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। যারা আইইউটিতে থাকতো না তারাও রকি’র বিভিন্ন কীর্তির সাথে কমবেশি পরিচিত। আজকের এই লেখাটা রকি কে নিয়ে। যারা রকি’র সাথে পরিচিত না তাদের জন্য সাবধানবাণী “রকিকে বেশি জানতে নেই, বেশি জানতে গেলে নিজেই রঁকিতে পরিনত হবার সম্ভাবনা প্রবল।” আর রঁকিতে পরিনত হলে জীবন কেমন ঝুঁকিময় হতে পারে তার অতি ক্ষুদ্র একটা উদাহরন এই লেখাটা!


আমাদের আইইউটিতে অন্যতম মজার আড্ডাটা হয় রাতের বেলায়, রাত বলতে আমি আসলে মাঝরাতের পরের সময়কে বুঝাচ্ছি। আইইউটিতে রাত শুরুই হয় ঠিক মাঝরাতের পর। সেই আড্ডার পরিধি প্রায়ই আইইউটি পার হয়ে পাশের হোটেলগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। তো মাঝ রাতের পর হোটেলে গিয়ে পরোটা-ভাজি খাওয়াটা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে তখন। হঠাৎ আমাদের হ্ল প্রভোস্ট নতুন নিয়ম করলেন। রাত দশটার পর বাইরে যাওয়া বন্ধ। কেউ যদি যেতে চায় তবে গেইটের সিকিউরিটি মামাদের কাছে নাম-ধাম লিখে বাইরে যেতে হবে। নতুন নিয়ম হজম করাটা আমাদের জন্য বেশ কষ্টের। আগেই বলেছি, বাইরে খেতে যাওয়াটা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। একেতো বাঙ্গালী তার উপর আবার আইইউটিয়ান। আমাদের অভ্যাস পরিবর্তন করার চেয়ে বরং ক্যালকুলেটর দিয়ে সুপার কম্পিউটার এর কাজ করা অনেক সহজ। উপায় একটা বের করতেই হবে। যাই হোক যথারীতি রাতের বেলা গেলাম গেইটের কাছে। এখন বের হবার পালা। দেখলাম মামা আমাদের দিকে একটা খাতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সেই রেজিস্ট্রি খাতা যার মধ্যে নাম, স্টুডেন্ট আইডি, রুম নম্বর, বের হবার সময়, ঢোকার সময় এইসব হাবিজাবি লিখতে হবে। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিলো, যদি বাইরে কোন ঝামেলা হয় তাহলে তো নাটস্‌ এন্ড পাটস্‌ (আমাদের দুই হল প্রভোস্ট) পুরা ধুয়ে ফেলবে। কী করা যায়! যেভাবেই হক নিজেদের নাম দেয়া যাবেনা। সাথে ছিল দিপু। বুদ্ধি করলাম যে নিজেদের নাম না দিয়ে বরং রকি’র নাম দিই। এতে ঝামেলা বলতে গেলে একদমই নাই। তো গেলাম রেজিস্ট্রি খাতায় রকির প্রক্সি দিতে। নাম লিখতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হবার দশা। আমার আগেই রকি কমপক্ষে বিশবার এই গেইট দিয়ে আসাযাওয়া করেছে, অন্তত রেজিস্ট্রি খাতা তাই বলে। রেজিস্ট্রি খাতার এক পৃষ্ঠাতেই প্রায় বিশবার রকির নাম লেখা, যদিও হাতের লেখা বিশ রকমের! বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই বোঝার কথা, আমাদের বুদ্ধি অনেক আগেই অন্য পোলাপান আবিষ্কার করে ফেলেছে!

এই আইন যতদিন ছিলো ততদিন রকি ছিলো রেজিস্ট্রি খাতার হিট সেলিব্রিটি আইটেম। কী সিনিয়র কী জুনিয়র, সবাই তখন রকির ভক্ত। এই ভক্তদের বাঁধভাঙ্গা আবেগের সাক্ষী ছিলো ওই রেজিস্ট্রি খাতা। তাদের কল্যাণে প্রতিরাতেই রকির অজস্রবার আগমন-নির্গমন নিয়মিত ঘটনায় পরিনত হলো। রকির এই হিট ইমেজ ফ্লপ করতেই কিনা কে জানে বেশিদিন এই আইন টিকে নাই। তবে এইটা ঠিক যে এই আইন আমাদের সবাইকে আর কিছু না হোক, রকির কাতারে নিয়ে এসেছিলো! আমার সন্দেহ হয় রকি মনে হয় ওর ভক্তকূলের উন্মাদনার কিছুই জানেনা। এই লেখা পড়ে ও যদি কিছু জানে!