রঙ্গীন দুনিয়া -৩

হাসি কয় ধরনের? বাঙ্গালী হিসেবে আমি মাত্র চার ধরনের হাসি জানতাম – লাজুক হাসি, মুচকি হাসি, অট্টহাসি আর বাঁকা হাসি। (এর মধ্যে আবার চার নম্বরটা কেবল শুনেই এসেছি কখনো দেখলাম না!) এর বাইরে কি হাসি হয়না? হয় হয়, না হলে হাসি নিয়ে এই বেলা হাঁসফাঁস করতামনা। ইউরোপে পুরো সমাজ ব্যবস্থাটা চলে হাসি’র উপর। গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে পাশের গাড়িতে লেগে গেল তাহলে দিতে হবে অপরাধবোধ হাসি। এলিভেটরে কারো সাথে দেখা হলে আসবে সৌজন্যমূলক হাসি। ব্যাঙ্কে গেলে রিসিপশনের মানুষটি দিবে সম্ভাষনসূচক হাসি, এর উত্তরে তখন প্রত্যুত্তরমূলক হাসি দেবার নিয়ম। এভাবে আরো আছে অনুরোধমূলক হাসি, ভদ্রতামূলক হাসি, অনুযোগমূলক হাসি, অবুঝ হাসি, বঞ্চনামূলক হাসি, ভুল শোধরানোর হাসি, অপরাধমূলোক হাসি, ভয়ের হাসি (যদিও এই হাসি আমি কখনো দেখি নাই), সম্মানসূচক হাসি, দুঃখমূলক হাসি, ভালোবাসার হাসি (এখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি), এমনি এমনি হাসি; আরো কত ধরনের হাসি! এখনো সব খুঁজে বের করতে পারিনি। তবে এমন অনেকে আছে হাসতে হাসতে যাদের মুখের কাটিংটাই পারমানেন্টটলি হাসি হাসি হয়ে গেছে। এই প্রজাতির হাসিগুলো হয় বেশ বিভ্রান্তিমূলক। কারন এরা মুখ সামান্য ফাঁক করলেই মনে হয় এরা হাসি দিচ্ছে, হাসিটা কোন ক্যাটাগরির সেটা সহজে বোঝা যায়না।

নেদারল্যান্ডসে একটা প্রবাদ আছে “Be aware of four Ws: Wine, Wealth, Women and Weather!”. এখানকার আবহাওয়াকে মোটেই বিশ্বাস করা যায়না। এই হয়তো ফক্‌ফকা নীল আকাশ, হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই পুরো আকাশ কালো হয়ে ঝপ করে বৃষ্টি নেমে গেল। পুরো ব্যপারটা হয়তো বড়জোড় তিন মিনিটে ঘটে গেল! এর কিছুক্ষণ পরই আকাশ আবার পরিষ্কার। তবে আকাশ যখন পরিষ্কার থাকে তখন পুরোপুরি নীল আকাশ। নীল আকাশ তার মাঝে সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। ঢাকায় শেষ কবে নীল আকাশ দেখেছি মনে করতে পারিনা, দেশ ছেড়ে আসার আগেও যে আকাশ দেখে এসেছিলাম সেটা ছিল ধোঁয়া আর ধূলায় ঢাকা ছাই-রঙ্গা ম্যাটম্যাটে একটা আকাশ। বিকেল হলেই দেখা যায় ঝাঁক বেঁধে পাখিরা সব নীড়ে ফিরছে। এখানে বক, হাঁস আর গাংচিলই বেশি চোখে পড়ে। কাকও যে নাই তা না, কাক আছে তবে এদের সাইজ ঢাকার কাকের সাইজের প্রায় অর্ধেক। আমাদের দেশের ডাহুকের মত দেখতে এক ধরনের পাখি দেখা যায় আর দেখা যায় টিয়া পাখি। বিকেল হলেই কোত্থেকে যেন শত শত টিয়া পাখি গাছগুলোতে এসে ভীড় জমায়। ঢাকায় কখনো এমন দেখেছি বলে মনে পড়েনা।

ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় নেদারল্যান্ডস অনেকটা সমতল। ফলে দেখা যায় এখানকার বেশিরভাগ (অথবা সবাই) মানুষই সাইকেল ব্যবহার করে। এই দেশের প্রত্যেকটা রাস্তায় সাইকেলের জন্য আলাদা আলাদা লেইন আছে। এরা আবার সাইকেলকে বলে “ফিয়েটস”। সাইকেলের রাস্তাগুলো এত চমৎকার যে কেউ ইচ্ছে করলেই বেশ সহজেই সাইকেল নিয়ে পুরো নেদারল্যান্ডস ঘুরে আসতে পারে। এদের ট্রেন স্টেশনগুলোতে সাইকেল পার্ক করার আলাদা জায়গা আছে। সে সব জায়গায় দশ-বিশটা না, শত শত সাইকেল পার্ক করা থাকে। অনেক সময়ই দেখা যায় যে সাইকেলের সংখ্যা পার্কিং প্লেস ছাড়িয়ে পাশের রাস্তায় গিয়ে পড়ে!

বাংলাদেশে সম্ভবত দামের দিক থেকে সবচেয়ে সস্তা (মানের দিক দিয়েও মনে হয়) খবরের কাগজ মনে হয় “আমাদের সময়”। যতদূর মনে পড়ে এর দাম ছিল দুই টাকা। আমার এক কলিগ প্রায়ই বাসের সীট পরিস্কার করার জন্য এই পেপার খানা কিনত! অন্যদিকে “প্রথম আলো” বা এই টাইপের কাগজগুলো কিছুদিন পর পরই তাদের দাম বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু এইখানে নেদারল্যান্ডস-এ কাহিনী পুরোপুরি ভিন্ন। স্টেশনে প্রথমবার যখন গেলাম, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি, সময় আর কাটেনা। দেখি পাশে একটা স্ট্যান্ডে অনেকগুলো পেপার পড়ে আছে। কিন্তু পেপার কিনে দাম দেবার কোন ব্যবস্থা চোখে পড়লনা (অবশ্য টাকা খরচ করে পেপার কিনার ইচ্ছাও নাই)। বাংলাদেশে হলে একটা তুলে নিতাম, পরে যা হবার হত। কিন্তু এইখানে এইসব করে ধরা পড়লে বহুত হ্যাপা। চুপচাপ বসে আছি, এমন সময় দেখি একজন এসে একটা পেপার তুলে নিল। কী আজব কোন কিছু পে করলনা। কিছুটা অবাক হলাম। দেখলাম আরো কয়েকজন এসে একইভাবে তুলে নিল কয়েকটা কিন্তু কেউই কোন দাম দিলোনা। বাঙ্গালী নাদান মানুষ আমি। ততক্ষনে আমিও একটা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম একটা। নিয়ে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিলো যেন এখনই কেউ এসে দাম দিয়ে পেপার না নেবার জন্য ফাইন করে বসবে। নাহ্‌ তেমন কিছুই হলনা। ব্যাপারটা ধরতে একটু সময় লাগলো। নাদান বলে এই সময়টুকু লাগলো, নাহলে আরো আগেই বুঝতে পারতাম। এইখানে খবরের কাগজ একেবারে ফ্রী! পেপার স্ট্যান্ডে পেপার থাকে, যার খুশি যেটা খুশি সেটা নিয়ে যায়। এ্যাডভারটাইসিং থেকে এদের সব খরচ উঠে যায় বলে এরা পেপারের কোন দাম রাখেনা। বাংলাদেশে একেকটা পেপারে যেই এ্যাড থাকে আমার মনে হয় এরাও ইচ্ছা করলে ফ্রী না হোক অন্তত আরো কম দামে দিতে পারে।

ডাচ জাতি কুত্তা নিয়ে তাফালিং করতে বেশ পছন্দ করে। এদের ঘরে মা, বাবা, ভাই, বোন, বউ, স্বামী, বাচ্চা না থাকলেও একটা কুকুর বা বিড়াল অবশ্যই থাকবে। এরা জীবন দিয়ে নিজের কুকুরকে ভালবাসে। বিড়াল-কুকুরের জন্য এরা যেই বিছানাপত্র ব্যবহার করে আমাদের দেশে অবস্থাপন্ন লোকজনও তাদের বাচ্চা কাচ্চার জন্য সেটা ব্যবহার করেনা। এদের মধ্যে যারা বড়লোক, তারা আবার কুকুরের জন্য আলাদা বাড়ি তৈরি করে। এদের লজিক হচ্ছে – বড় হলে বাচ্চারা চলে যাবে কিন্তু কুকুর কখনোই যাবেনা। এমনও দেখা গেছে যে আনন্দে কুকুর মালিকের গাল চাটছে আবার মালিকও কুকুরের গাল চাটছে! কিছু কিছু কুকুরের সাইজ এত ছোট যে আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে এরা মালিককে পাহারা দেয় নাকি মালিক এদের পাহারা দেয়!


যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম, তখন কৃষ্ণাংগদের উপর একটা আলাদা মায়া কাজ করত। সবখানেই পড়তাম যে এরা নিগৃহিত নিপীড়িত। আমার এই মায়া পুরোপুরি ঘৃনায় পালটে যায় যখন আমি আইইউটিতে পড়ি। এদের মধ্যে এখনো এক ধরনের হিংস্রভাব কাজ করে। যখন দু’জন আফ্রিকান কথা বলত মনে হত যেন তারা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ঝগড়া ঝাঁটি করছে! এরা অত্যন্ত অভদ্র আর মারামারিতে এদের বিকল্প কিছু নেই। সেই থেকে আমি আফ্রিকান মানুষ দেখলে দূরে থাকি। নেদারল্যান্ডসে এসেও দেখি, এই জাতিএ আচরনে কোন পরিবর্তন নাই। বাড়তি ব্যাপার হল, এরা সম্ভবত সবাই নিজেকে এক একজন র্যারপার ভাবে। কথা আর হাতপা ছোঁড়াছুড়ি দেখলে মনে হয় এরা সবাই র্যা প করতে করতে ঝগড়া করছে! এখানকার যত বেআইনী কাজ আছে সব এরা করে। এদের বেশিরভাগকেই দেখা যায় বেন্টলী বা ল্যাম্বারগিনি হাঁকাতে। সেই সাথে এরা প্রচুর গহনা পড়ে, সেটা ছেলে হক বা মেয়েই হোক। অনেকে আবার গহনা পড়ার জন্য দাঁতকে বেছে নেয়। যারা দাঁতকে বেছে নেয় তারা খামাখা পুরা দাঁতকে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে ফেলে। এই ক্ষেত্রে তারা একটা দুটা দাঁত না বাধিয়ে পুরো এক পাটি দাঁত বাধিয়ে ফেলে। সেই সোনায় আবার কারুকাজ করা থাকে। হাসি দিলেই পুরা নিখাঁদ সোনার ঝিলিক!

গত উইকেন্ডে গিয়েছিলাম “বারলেনাসু”তে। বারলেনাসু একটা শহর যার উপর দিয়ে নেদারল্যান্ডস আর বেলজিয়ামের বর্ডার চলে গিয়েছে। হেগ থেকে প্রায় দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। এই শহরের সব কিছুই দুইটা করে- পুলিশ স্টেশন, ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল মায় মিউনিসিপ্যাল ও। বারলেনাসুতে আমার সঙ্গী ছিলো মামা আর খালামনির প্রতিবেশী পরিবার জুয়ায়ের-এনেকা। কিছু কিছু লোক আছে যাদেরকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায়, জুয়ায়ের-এনেকা ঠিক সেরকম লোক। বারলেনাসুতে পৌঁছানোর পর এনেকা দৌড় দিলো মার্কেটিং করতে, মেয়েদের যেই স্বভাব আরকি! তারুপর আবার বেলজিয়ামে জিনিসপত্রের দাম আবার কম। আর এদিকে জুয়ায়ের আমার মত নাদান পেয়ে পুরোদস্তুর গাইড বনে গেল। পুরো শহর ঘুরিয়ে দেখাতে লাওগলো ও। ওর কাছেই শুনলাম, এইখানে কেউ যদি এ্যাক্সিডেন্ট করে বর্ডার লাইনের উপর পড়ে তাহলে নাকি দুই দেশের কোন পুলিশ বা হাসপাতালই এগিয়ে আসবেনা। এইখানে এমন সব বাড়ি আছে যাদের একটা দরজা পড়েছে নেদারল্যান্ডসে আরেকটা বেলজিয়ামে! নীচে দুইটা ছবিও দিয়ে দিলাম। প্রথমটাতে দেখা যাচ্ছে বর্ডার লাইন গেছে ফুটপাথের উপর দিয়ে। দ্বিতীয়টা আরো মজার, এইবার বর্ডার গেছে একটা কফি শপের ভেতর দিয়ে!

একটু আগে খবর পেলাম কালকে ঈদ। সকাল ১০টায় ঈদের জামাত। জীবনে এই প্রথম ঈদের জন্য দুঃখ লাগছে। দেশ ছেড়ে প্রথম বারের মত বাইরে ঈদ… পরিচিত সবাইকে ছেড়ে ঈদ… বেশ কষ্ট লাগছে। ঈদের দিন নানীর পা ধরে সালাম করা হবেনা… আব্বুর সাথে ঈদ্গাহে যাওয়া হবেনা… পরিচিতদের সাথে কোলাকুলি করা হবেনা… আম্মুর হাতের ঈদের খাবার খাওয়া হবেনা… নতুন জামা পেয়ে ছোট বোনের খুশি খুশি চেহারাটা দেখা হবেনা… দীপু, মিফতাহ, নাফিস, মারুফদের সাথে ঈদের পরদিন আর মুক্তমঞ্চে বসা হবেনা… খুব মিস করছি। কালকের ঈদটা একেবারে বোঝার মত লাগছে। যদিও বোঝা লাগার কোন কারনই নাই। স্বজনদের সাথেই ঈদ করছি। সকালে খালু আর মামার সাথে ঈদ্গাহে যাব। খালামনি ঈদের খাবার রান্না করবে। সেই খাবার খেয়েই দৌড় দিতে হবে ভার্সিটিতে নাহলে দুপুরের এডহক নেটওয়ার্কের ক্লাসটা মিস হবে। নামাজের জন্য এমনিতেই সকালের এডভান্সড ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ওয়েভের ক্লাসটা মিস যাবে। কী কপাল! ঈদের দিনও ক্লাস! আর লিখতে ইচ্ছা করছেনা… আজকে আরো অনেক লিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঈদের কথাটা শুনেই আসলে মন খারাপ হয়ে গেছে। পুরনো সব স্মৃতি ভেসে উঠছে… হয়তো এক সময় মন শক্ত হয়ে যাবে… দেশের পরিচিত পরিবেশের জন্য হয়তো আর খারাপ লাগবেনা… কিন্তু সেটাতো পরের ব্যাপার… এই বেলার কষ্টটা কই রাখি!

One thought on “রঙ্গীন দুনিয়া -৩”

  1. স্যার,আপনার শেষের কয়েকটা লাইন পড়ে খুবই ভাল লাগলো,আবার অনেক খারাপও লাগলো !ঈদ মোবারাক !!!

Leave a Reply to shorifCancel reply