রঙ্গীন দুনিয়া – ২

নেদারল্যান্ডস এর একটা ব্যাপার বেশ অবাক হবার মত; পুরো দেশটা একেবারে সবুজে ছাওয়া। যেদিকেই তাকাই সেদিকেই কেবল সবুজ। চারদিকে কেবল সবুজের সমারোহ। এরা খুবই সবুজ প্রিয় জাতি। খালি জায়গা পেলেই সেখানে গাছ লাগিয়ে দেয়। ডেলফ, হেগ বা লেইডেন এর মত শহরে না গেলে বিশ্বাস করা কঠিন যে কোন শহর গাছগাছালিতে এতটা পরিপুর্ণ থাকতে পারে। আর গ্রামের কথাতো বাদই দিলাম!

বাঙ্গালী ছাড়া আর কোন জাতিকে তেমন একটা কাছ থেকে ভালোভাবে কখনোই দেখি নাই। আইইউটিতে থাকতে অবশ্য ভিন জাতির পোলাপানদের সাথে কিছুটা মেশা হয়েছিলো। কিন্তু তাওতো আবছা’র উপর ঝাপসা করে। একেবারে পুরো একটা জাতিকে একসাথে দেখা – এই প্রথম। জাতি হিসেবে ডাচরা বেশ আড্ডাপ্রিয় বলেই মনে হল। এদের অফিস আদালতে গেলে মনে হবে যেন এরা অফিসে আড্ডা মারতে এসেছে। তবে এদের আসল আড্ডা চলে অফিস ছুটির পর। তখন দেখা যায়, সব লোকজন রেস্টুরেন্ট আর বারে গিয়ে ভীড় করেছে। এরা খাবার টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরে যায়। এদের বার মানে সেখানে কেবলই তরল জিনিস পাওয়া যায়। আগে কেবল গল্পের বইয়ে পড়তাম যে পশ্চিমারা ঘন্টার পর ঘন্টা তরল গলায় ঢালতে পারে। এইবার নিজের চোখে দেখলাম। এরা বারে বসে থাকে গড়ে পাঁচ থেকে সাত ঘন্টা। এই পুরো সময়টুকু কেবল মগের পর মগ হয় বিয়ার নয় ওয়াইন নতুবা হুইস্কি একের পর এক টানতে থাকে। অবাক ব্যাপার হল এরা এতটুকু মাতাল হয়না, অন্তত আমি দেখিনি! তরল ছাড়া আরেকটা যে ব্যাপারে এরা সিদ্ধহস্ত সেটা হল ধোঁয়া খাওয়া। সিগারেট টানতে এদের জুড়ি নাই। ছেলে বুড়ো সবাই দেদারসে ধোঁয়া গিলছে। এরা বাতাস টানার মত করে ধোঁয়া টানে।
ইউরোপের যে ব্যাপারটাতে এখনো অভ্যস্ত হতে পারিনি সেটা হল রাস্তার ডান দিকে চলা। সারাজীবন বাংলাদেশে রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলে এসেছি, নিজেও গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু এখানকার রাইট হ্যান্ড রুল এখনো কেমন কেমন জানি লাগে। তবে এখানে এসে বুঝেছি, ঢাকার ড্রাইভাররা বিশ্বসেরা। ঢাকায় যে চাপের মধ্যে গাড়ি চালাতে হয় তার কানাকড়ি চাপও এইখানে নাই। কেউ হুটহাট করে লেইন চেঞ্জ করেনা। সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন করা। আর রিক্সাতো নাই! একটা জিনিসকে সবাই ভয় পায়, সেটা হল আইন। সামনে পুরা রাস্তা খালি, আশেপাশে কোন জনমানুষ নাই, এই অবস্থাতেও যদি লাল বাতি জ্বলে তবুও গাড়ি থেমে যাবে। এমনকি যদি সময়টা রাত একটাও হয়!

এখানে আসার পর দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়েছিলাম ডলফিনেরিয়ামে। এইটা হেগ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে হার্ডারবাইক নামের আরেক জায়গায়। ডলফিনেরিয়ামে মুলত সামুদ্রিক প্রাণীদের শো হয়। ডলফিন, সীল – এদের বিভিন্ন খেলা দেখানো হয়। এতদিন কেবল ডিস্কভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতেই কেবল ডলফিন বা সীলের খেলা দেখতাম, এইবার নিজের চোখে লাইভ দেখলাম। এটা ছাড়াও ওখানে থ্রিডি সিনেমা আছে। সিকোয়েন্সের সাথে সাথে একেবারে চেয়ার নাড়িয়ে দেয়। পর্দায় হয়তো দেখা গেলো বোমা ফাটলো, সাথে সাথে বিকট বিস্ফোরনের শব্দ আর চেয়ারে সজোরে ঝাঁকুনি। ডলফিনেরিয়ামে গিয়ে ছিলাম মামা মামির সাথে। আসার পথে মামা লিলিস্টাডের বিশাল বাঁধ ঘুরিয়ে আনলো। যাদের নেদারল্যান্ডস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা নাই তাদের জন্য ছোট্ট একটা তথ্য- পুরো দেশটার এক তৃতীয়াংশ অংশ এসেছে সাগরের নীচ থেকে। ডাচরা সাগরে বাঁধ দিয়ে তাদের দেশ বাড়িয়েছে। সেরকম একটা বাঁধ আছে লিলিস্টাডে। এটাকে বাঁধ না বলে আসলে বলা উচিৎ সাগরের মাঝ দিয়ে হাইওয়ে। এর উপর দিয়ে একের পর এক গাড়ি চলে যাচ্ছে। রাস্তার একপাশে সাগর আর অন্যপাশে শুকনো সবুজ জমি, দেখে মনেই হয়না যে এই জমি এক সময় সাগরের নীচে ছিল। অপূর্ব দৃশ্য! না দেখলে বোঝানো কঠিন।

ডাচদের সাথে কথা বললে প্রথমেই যে জিনিসটা মনে ধরে সেটা হল এরা সবাই প্রতিটা বাক্যেই খক্‌ খক্‌ করে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। ইংলিশে কথা বললেও খক্‌ খক্‌! আসলে ডাচ ভাষাটা বেশ অদ্ভুত। এদের খুব প্রিয় বর্ণ মনে হয় “খ”। খুব সম্ভবত এদের প্রতিটা বাক্যেই একাধিক “খ” থাকে। “খ” তাই এদের গলা থেকে খিল খিল করে ঝরে পড়ে।

মারিয়াহোভ ট্রেন স্টেশন আমার প্রতিদিনের পরিচিত জায়গা। ইউনিভার্সিটিতে যেতে এখান থেকেই আমি ট্রেনে উঠি। একদিনের কথা, সবে ট্রেন থেকে নেমে মাত্র স্টেশনের বাইরে আসলাম, এসেই দেখি সামনে বিশাল মার্সিডিজ নিয়ে কালো স্যুট কালো সানগ্লাস পরা সিকিউরিটির এক দামড়া দাঁড়িয়ে আছে! কেবল যে দাঁড়িয়ে আছে তাই-না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুক ধ্বক করে উঠলো, সন্ত্রাসী হিসেবে আবার সন্দেহ করল নাতো! তার উপর আমার পিঠে আবার ব্যাকপ্যাক। আমার ব্যাকপ্যাকের যে সাইজ তাতে এটম বোমা আছে বলে সন্দেহ করাটা মোটেও অমূলক না। সাবধানে আরেকটু এগোতেই ব্যাপারটা চোখে পড়লো। ব্যাটার গাড়ীতে নীল রঙের নম্বর প্লেট লাগানো, তার মানে ব্যাটা ট্যাক্সি ড্রাইভার! এদের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের এই বেশভূষা বেশ কমন। বলা যায় এইটাই এদের ইউনিফর্ম! একেবারে ম্যাট্রিক্স সাজ যাকে বলে। তবে প্রথমবার একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের এই দশা দেখে হজম করতে বেশ কষ্ট হয়েছে।

Leave a Reply