হাতের মুঠোয় ভেজাল খাবার

১।

ছোট্ট একটা খবর শেয়ার করি। গতবছর দৈনিক ইত্তেফাকে একটা খবর আসে যে, দিনাজপুরে গাছের নীচে থেকে কুড়ানো লিচু খেয়ে ১১ জন শিশু মারা গিয়েছিল। লিচু গাছে থাকা অবস্থায় কীটনাশক বিষ দেয়া হয়েছিল বলেই এই ঘটনাটি ঘটেছিল বলেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রীতিমত গবেষণা চালিয়ে নিশ্চিত করেছিল তারা। আপনি হয়তো খবরটি শোনেনই নাই। তাহলে আরও একটু যোগ করি। ঠিক একই কারণে দিনাজপুরেই ২০১৩ সালে মারা যায় ১৩ জন শিশু, আর ২০১২ সালে মারা যায় ১৪ জন শিশু। বলেন দেখি, এটা কী মৃত্যু নাকি খুন?

২।

ছোটবেলায় ট্রান্সলেশন করেছিলেন মনে আছে? ঐ যে ছিল – “দুধ একটি আদর্শ খাবার – Milk is an ideal food”। কিন্তু এই দুধও কিন্তু এখন আদর্শ নেই – সেখানেও ঢুকে গেছে ভেজাল।

একটা টিভি রিপোর্টে দেখলাম – প্রথমে শ্যাম্পুর সাথে খানিকটা ছানা পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয় ফেনা। এরপর এতে গুঁড়ো দুধ, সয়াবিন, চিনিসহ আরও কিছু রাসায়নিক যোগ করা হয়। আর এই জিনিসটিই বাজারে বিক্রি করা হয় তরল দুধ হিসেবে। এই দুধ গরম করলে যাতে ফেনা হয় সেজন্য মেশানো হয় আরেক ধরনের কেমিকেল। মেশিনেও ভেজাল ধরা পরে না।

তাছাড়া দুধে পানি মিশানোর গল্পতো আর নতুন নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে পানি কোথা হতে মেশাচ্ছে? কারণ যে সকল জায়গা থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়, সেটিও থাকে বিষাক্ত কল কারখানার বর্জ্যে আবৃত। ময়লা পানি ও ফরমালিনযুক্ত দুধ পান করে বর্তমানে দেশে অনেক শিশুই কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণে শিশুদের হাড়ের জোড়ায় দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে পড়ছে। পাউডার দুধ পান করলে কিডনির নেফরোটক্সিসিটি ও লিভার হেপাটোটিক্সিমস হতে পারে। শিশুদের শরীরে মরন ব্যাধি ক্যান্সার দেখা দিতে পারে।

এর একমাত্র সমাধান সরাসরি গরুর সামনে থেকে খাঁটি দুধ নিয়ে আসা। বর্তমানে এই রাস্তায় অনেকেই হাঁটতে শুরু করেছেন। তবে সমস্যা হল, গোয়ালা যদি গাভীকে এমন কিছু ট্যাবলেট খাওয়ান যাতে গরুর দুধ বেশী পাওয়া যায় – সেটা কীভাবে নিশ্চিত করবেন? আর এসব দুধ খেয়ে যখন একজন মানুষ তিলে তিলে মারা যেতে থাকে সেটাকে কী বলবেন? মৃত্যু নাকি খুন?

৩।

মুরগীর মাং‌স তো সবাই খান – তাই না? বিশেষ করে ভুনা, ফ্রাই, রোস্ট বা গ্রিল , চাকুম চুকুম – আরও কত্ত কী। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি এসব মুরগীকে কি খাওয়ানো হয়?

আগে মুরগির প্রোটিন খাবার হিসেবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হত মিট এবং বোন মিল। আর এখন?

ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে। প্রক্রিয়াজাত করার পর যে বিষাক্ত বর্জ্যগুলো বের হয়, সেগুলোই কম মুল্যে বিক্রি করে তৈরি করা হয় মাছ ও মুরগির প্রোটিন খাদ্য! নামীদামী অনেক পোল্ট্রি খামারই এগুলো খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এ খাবার মুরগি খেলে মুরগীর ডিম থেকে শুরু করে মুরগীর মাংসও বিষাক্ত হয়ে যায়। ফলে মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছেই !

এর ফলে শুধু মুরগির মাংসেই নয়, ডিমেও এখন বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ও শিশা পাওয়া যাচ্ছে। আর হোটেলে সাপ্লাই করা রোগে মরা মুরগির গ্রিল এর কথা আর নাই বা বললাম।

এর সাথে যোগ হয়েছে – কৃত্তিম ডিম! কৃত্রিম উপায়ে কেমিক্যাল দিয়ে ডিম তৈরি করে নাকি চীন নানা দেশে বাজারজাত করা হচ্ছে (যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে)।

এসব খেয়ে আপনার আয়ু যে এক্সপোনেনশিয়াল হারে কমছে – সেটাকে কি বলা যায়? স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি খুন?

৪।

রাস্তাঘাটের ধারে যেসব ভাজাপোড়া দোকান আছে, তারা কোনদিন কড়াইয়ের তেল পাল্টায় না। দিনের পর দিন বিষাক্ত পোড়া তেলের মধ্যেই আবার নতুন তেল যোগ করে ভাজাপোড়া জিনিস বানায় । অনেক দোকানি তো আবার খাবার তেলের পরিবর্তে সস্তায় গাড়িতে ব্যবহৃত ফেলে দেয়া বিষাক্ত লুব্রিক্যান্ট (মোবিল) দিয়ে ভাজাপোড়া বানায়।

মাছ ফল সংরক্ষণ করতে ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর ফরমালিন। আগে ফরমালিন মাছের গায়ে ঢেলে দেয়া হত। এখন বরফ পানিতে ফরমালিন মিশিয়ে মাছ হিমায়িত করা হয়। ফলে ফরমালিন শনাক্তকরণ কিট দিয়ে পরীক্ষা করেও ফরমালিন ধরা পড়ে না।

চিকন সাদা চালের দাম বেশি। তাই বেশি দামে বিক্রি লোভে মোটা চাল মেশিনে ঘষে চিকন করে ইউরিয়া মিশিয়ে সাদা করা হচ্ছে। মুড়িতেও ইউরিয়া মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে দেদারসে।

দই তৈরি হচ্ছে টিস্যু পেপার দিয়ে। টোস্টসহ বিভিন্ন বেকারি খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা হয় বিষাক্ত সাইক্লোমেট দিয়ে। শিশুখাদ্য, চকোলেট কিংবা ক্যান্ডিতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রঙ ও ট্যালকম পাউডার।

রাস্তার ধারের দোকানগুলোর কথা বাদই দিলাম। বিভিন্ন বড় বড় শপিং মলের ফুডকোর্টগুলোতে আপনি যে লাস্সি, জুস বা মিল্কশেক খেয়ে গলা জুড়াচ্ছেন – সেটাতে ব্যবহার করা হয় মাছ হিমায়িত করার বরফ আর খোলা ওয়াসার পানি! এসব বাদ দিয়ে বোতলজাত কোমল পানীয় খাবেন? সেখানেও বিপত্তি। চিনি দেওয়া সাবান পানির ভেতর সেভলন দিয়ে ঝাজ এনে তৈরি হচ্ছে নকল কোমল পানীয়। সেটা আবার পুরনো ব্যবহৃত বোতলে ভরে নতুন সিল মেরে দোকানে দোকানে বিক্রিও হচ্ছে। আর প্যাকেটজাত যেসব জুস পাওয়া যাচ্ছে তাতেও রয়েছে সমস্যা। বেশিরভাগ নামীদামী কোম্পানি বিভিন্ন জুস তৈরিতে ব্যবহার করছে মিস্টি কুমড়া, অশোধিত পানি, কৃত্রিম রঙ আর নানা রকম কেমিক্যাল দ্রব্য। তাতে বিভিন্ন ফলের কৃত্রিম ফ্লেভার যোগ করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে।

তবে শুধু পানীয়ই নয় – স্ন্যাকফুড, গ্রিনপিস, জ্যাম, জেলী, আচার, চাটনীতেও বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর রঙ ও ক্যামিকেল দ্রব্য ব্যবহার করা হয়।

এসব বিষ খেয়ে অসুস্থ হয়ে ওষুধ খেয়ে সেরে উঠবেন ভাবছেন? সে আশায়ও গুড়েবালি। দৈনিক যুগান্তরের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে রীতিমত প্রতিযোগিতা করে উৎপাদন করা হচ্ছে ভেজাল ওষুধ!

৫।

চারদিকে প্রচন্ড গরম পড়েছে। ভাবছেন এই গরমে তরমুজ খেয়ে প্রাণ জুড়াবেন? ঐ ভাবাভাবি পর্যন্তই থাকুন। কারণ বাজারে যে তরমুজ পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই ক্ষতিকর। ভোরবেলা তরমুজের ভেতরে সিরিঞ্জে করে ক্ষতিকর এরিথ্রোসিন-বি ও স্যাকারিন পুশ করে লাল ও মিষ্টি বানিয়ে সেই তরমুজ রাস্তাঘাটে বিক্রি করা হয়।

এ শুধু তরমুজেই নয়, বরং বাজারের প্রায় সমস্ত শাকসবজি ও ফলমূল; যেমন, টমেটো, পেঁপে, কলা, আঙ্গুর, আপেল, কমলা ইত্যাদি ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত। ব্যবসায়ীরা কৃত্তিম উপায়ে ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেট, কার্বনের ধোঁয়া, পটাশের লিকুইড সলিউশনসহ বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করছে। আর ফলগুলোকে টাটকা ও তাজা রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

সামনেই আসছে মধুমাস। আম, জাম, কলা, আনারস ও অন্যান্য ফল দিয়ে বাজার ভরে যাবে। কিন্তু সেসব কি আপনি আমি নিশ্চিন্ত মনে খেতে পারব? বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো এই ফলগুলো কি আপনি আপনার পরিবারের মুখে তুলে দিতে পারবেন?

৬।

একবার ভাবুন তো, আগে ক্যান্সার, হার্টঅ্যাটাক এইসব রোগে কতজন মারা যেত, আর এখন কতজন মারা যায়? একটু চিন্তা করে দেখুন – আপনার আমার পরিচিতজনদের এখন হরহামেশা কতজন ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে? ক্যান্সারের ঝুঁকি কেন এত বেড়ে গেছে বলতে পারেন? কারণ এখন হাত বাড়ালেই ভেজাল খাবার পাওয়া যায়। না চাইলেও ভেজাল খাবার আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আমরা খাদ্যদ্রব্য হিসেবে বিষ খাই। এই বিষ আমাদের শরীরে ক্যান্সারসহ একগাদা খারাপ অসুখের বাসা বাঁধছে।

আমাদেরকে স্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে মারা হচ্ছে। “মারা হচ্ছে” বললে ভুল বলা হবে। বলা উচিত “গণহত্যা” করা হচ্ছে! এত ঠান্ডা মাথায় সবার চোখের সামনে দিয়ে গণহত্যা করার নজির বোধহয় বিশ্বে আর কোথাও নেই। আমাদের দেশে আমরা খাদ্য খাইনা, বরং বিষ খাই। একজন খুনী কাউকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেললে যত বড় অপরাধ হয়, এভাবে প্রকাশ্যে একটা জনগোষ্ঠীকে বিষ খাওয়ানো কী রকম বড় অপরাধ হতে পারে – একবার চিন্তা করে দেখুন!

সরকারের ভেজাল বিরোধী অভিযান সত্ত্বেও বিষাক্ত বা ভেজাল খাদ্যের রমরমা ব্যবসার উপর কোন প্রভাব পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। আমার মতে তার প্রধান কারণ হল, ধরা পড়লে এসব ব্যবসায়ীরা জরিমানা দিয়ে কীভাবে কীভাবে যেন পার পেয়ে যায়। তারপর আবার মহা উদ্যোমে খাবারে বিষ মেশাতে থাকে। এদের যেন বিষ মেশানোতো ক্লান্তি নেই।

৭।

তাহলে উপায় কী?

আমার মতে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেবার শাস্তি হতে হবে মৃত্যুদণ্ড। যারা খাদ্যে বিষ মেশায়, তারা খুনী, একেবারে একশ ভাগ অরিজিনাল খুনী। এর বিষ মিশিয়ে খুন করে, খুনটা হয় ধীরে ধীরে – হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার, স্ট্রোক এর মাধ্যমে।

আর আপনাকেও সতর্ক হতে হবে। খাবার খাওয়ার আগে সতর্ক হয়ে নিন – কী খাচ্ছেন। টাকা দিয়ে হোক আর মাগনাই হোক – বিষ কিনে খাওয়ারতো কোন কারণই নেই। নিশ্চিন্ত না হয়ে বাজার করবেননা। প্রয়োজনে বাজার করা কমিয়ে দিন। পরিবারের কিংবা বাচ্চাদের আবদার এক পাশে সরিয়ে রেখে দোকানের বিষাক্ত খাবার খাওয়া ছেড়ে দিন। সবাইকে বুঝিয়ে বলুন। আমরা যখন এসব ছেড়ে দিব, তখন দেখবেন ঐপক্ষ ঠিকই লাইনে উঠে আসবে। কারণ আমরা টাকা না ফেললে তারা টাকা পাবে কই?

আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তাই আপনি এখনই সতর্ক হোন। না হলে এমন কোন দিন আসবে, যেদিন আপনার পরিবারও এই লেখাটার প্রথম অংশের ঘটনার মত কোন ঘটনার শিকার হবে।

Save

Leave a Reply