(প্রায়) জ্বালানী ছাড়া বিদ্যুৎ – ক্যামনে কী!

গত বছর জ্বালানীবিহীন বিদ্যুৎ নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। এই বছর প্রায় একই কাহিনী নিয়ে আবার লিখতে হচ্ছে! এবারের কাহিনীটি এসেছে দৈনিক কালের কন্ঠদৈনিক জনকন্ঠ নামে বাংলাদেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রে। খবরটিতে বলা হয় – নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জালাল উদ্দিন দীর্ঘ গবেষণায় সফল হয়ে তৈরি করেছেন খরচ সাশ্রয়ী এক বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র। তাঁর তৈরি অভিনব বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই যন্ত্রটিতে ১০ মিনিট জ্বালানী ব্যবহারের পর যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। জালাল সাহেব সাশ্রয়ীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন – খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু উনি পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সূত্রকে কাঁচকলা দেখিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন – এটা মোটেও আনন্দের কথা নয়।

নিজের উদ্ভাবিত বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্রের সামনে জালাল উদ্দিন। ছবি : কালের কণ্ঠ

উনি কাঁচকলা দেখাচ্ছেন কারণ, উনি দাবী করছেন যে – “যন্ত্রটিতে প্রথমে বাইরের যেকোনো শক্তি জ্বালানি হিসেবে ১০ মিনিট ব্যবহার করতে হয়। এরপর পুনর্চক্রাকার (রিসাইকেল) পদ্ধতিতে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ যন্ত্রটি জ্বালানি শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে বাকি ৬০ শতাংশ সঞ্চালন করে।” অদ্ভুত ব্যাপার! প্রথম দেয়া ১০ মিনিটের জ্বালানি দিয়ে, পরবর্তীতে যন্ত্রটি ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ৬০ ভাগ বিদ্যুৎ তৈরি করছে – ব্যাপারটা যে শুধু শক্তির নিত্যতা সুত্রকে কাঁচকলা দেখাচ্ছে তাই-ই নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত সূত্রকে কাঁচকলা দেখাবার জন্য জালাল সাহেব নোবেল পাওয়ারয‌োগ্য! শক্তির নিত্যতা সূত্র বলে – “শক্তির বিনাশ বা সৃষ্টি নেই, শক্তি কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয় মাত্র। এবং পৃথিবীর মোট শক্তির পরিমান নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়” অর্থাৎ আপনি কোন সিস্টেমে যে পরিমাণ শক্তি দেবেন, তার চেয়ে বেশি পরিমানে শক্তি কোনভাবেই সেখান থেকে পাবেন না। আপনি ২ কেজি আটা আর ২ কেজি পানি দিয়ে কখনোই ৬ কেজি রুটি বানাতে পারবেননা। কিন্তু জালাল সাহেব ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ দিয়ে ৬০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেখিয়েছেন যে শক্তি হিসেবে যা দিচ্ছেন তার থেকে বেশি শক্তি তিনি পাচ্ছেন। সোজা কথায়, উনার যন্ত্র শক্তি তৈরি করছে! অথচ পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রানুযায়ী শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করতে পারার কথা নয়!

শুধু তাই-ই নয়, দৈনিক কালের কন্ঠের রিপোর্ট অনুযায়ী,

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও বিদ্যুৎ প্রকৌশলী আমজাদ হোসেন ওই যন্ত্র দেখেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ জেনারেশন (উৎপাদন) ও ট্রান্সমিশন (সঞ্চালন) বিষয়ে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করেছি। কোনো অসংগতি পাইনি। এটাকে বলে ফিলার জেম। এই যন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।

“ফিলার জেম” কি বস্তু তা নিয়ে আমার কোন ধারণা নেই। অন্তত তড়িৎ প্রকৌশলে আমার সুদীর্ঘ পড়াশোনায় এই বস্তুর নাম কখনোই শোনা হয়নি। আমার জ্ঞানের ঘাটতি থাকতেই পারে – হাজার হোক আমিও তো মানুষ। তাই সবজান্তা গুগলের দ্বারস্থ হলাম। কিন্তু এ ব্যাপারে নিজের ঘাটতি স্বীকার করে গুগলও আমাকে অবাক করে দিল। আপনাদের মধ্যে যারা জ্ঞানীগুণী আছেন তারা কি আমাকে বলতে পারেন, প্রকৌশলী আমজাদ হোসেন সাহেব “ফিলার জেম” উল্লেখ করে আসলে কোন পদ্ধতির কথা বলেছেন?

আরও এককাঠি সরেস হিসেবে, দৈনিক কালের কন্ঠ তাদের রিপোর্টে যন্ত্র তৈরির কাঁচামাল (?) হিসেবে কিছু টেকনিকাল টার্ম ব্যবহার করেছে। তাদের লেখা বাক্যটি হুবহু তুলে দিলাম –

ফ্লাই হুইল, ইলেকট্রিক্যাল, রেটিও, অ্যাসেন্ট অ্যান্ড ডিসেন্ট, লেভেল, গ্র্যাভিটেশন অ্যান্ড মেকানিক্যালসহ নানা প্রকার বিদ্যুৎ শক্তির সমন্বয় করে একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। তাঁর এই যন্ত্র তৈরি করতে ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

রেটিও, অ্যাসেন্ট অ্যান্ড ডিসেন্ট, লেভেল – এসব মনগড়া টার্ম দিয়ে আসলে কি বোঝাতে চাচ্ছে তাদর রিপোর্টার কে জানে! আমি একটা ব্যাপার বুঝিনা, বৈজ্ঞানিক কোন কিছু ছাপাবার জন্য সংবাদপত্রগুলো উপযুক্ত রিপোর্টার বা সাংবাদিকদেরকে কেন দায়িত্ব দিতে চাননা? আমি বিজ্ঞানের লোক হয়ে নিশ্চয়ই অর্থনীতির বিষয়ে কথা বলতে যাবনা, কিংবা আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে নিশ্চয়ই ডাক্তারদের সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে যাবনা। একইভাবে সংবাদপত্রের উচিত সঠিক রিপোর্টের জন্য উপযুক্ত সাংবাদিকদের দায়িত্ব দেয়া। না হলে এমনও দিন আসবে, যখন সংবাদপত্রে খবর পাওয়া যাবে যে, অমুক গ্রামের তমুক সাহেব তার বাসার খাটের নিচে সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ তৈরির যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন! এখন কেবল সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বাকী!

4 thoughts on “(প্রায়) জ্বালানী ছাড়া বিদ্যুৎ – ক্যামনে কী!”

  1. এইসব তথাকথিত উদ্ভাবকদের সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দেয়না বলে কিছু ফেসবুকারের উষ্মা এবং আহাজারি দেখেছেন নিশ্চয়।

  2. স্যার আপনার লেখা পড়তে অনেক মজা লাগে, আপনি চাইলে এদের তুলধুনা করতে পারতেন কিন্তু আপনি সচেতনভাবেই তা করেন নি। কয়েকদিন পর পর এই ধরনের খবর পাওয়া যায়। একবার দেখেছিলাম কেউ একজন পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি ভুল বলে দাবি করছেন। আরও বেশি বেশি লিখুন স্যার। আপনার লেখা পড়তে ভাল লাগে ।

Leave a Reply