আষাঢ়স্য প্রথম দিবস

১লা আষাঢ় আজ! আরো ভালো করে বললে ১৪১৮ সালে আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ। কাগজে কলমে বর্ষা ঋতুর চলে আসার দিন। অলিখিতভাবে আরো কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বর্ষা কালবৈশাখীকে সঙ্গী করে তার স্বভাবসুলভ তেজের ছটা দেখিয়ে গিয়েছে। অবশ্য বর্ষা নিয়ে আমার খুব একটা উৎসাহ নেই। বর্ষাকাল আমার ভালোও লাগেনা। তবে কীনা আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের জন্য বর্ষাকে খুব একটা খারাপ ও লাগেনা!

raindrops
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর ...

 

বর্ষা হচ্ছে কবি সাহিত্যিকদের মাস। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত এমন কোন কবি নেই যিনি কীনা বর্ষা নিয়ে কোন পদ্য লিখেননি। আষাঢ়-শ্রাবণ-বর্ষা-বৃষ্টি এইসব শব্দ শুনলেই কবিরা ভাবের জগতে বুঁদ হয়ে যান, তাঁদের চোখ চকচক করতে থাকে, হাত নিশপিশ করতে থাকে, আর দেখতে দেখতে দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরিয়ে ফেলেন। আমি অবশ্য কবিদের বেশ ভয় পাই। কবিতা পড়া বা লেখার সাধ ও সাধ্য কোনটাই আমার নেই। তবে বর্ষাকালকে পছন্দ না করার পেছনে এসবের কোন কারণ নেই। আকাশ তার হাসিখুশি নীল রংটাকে ফেলে দিয়ে বিদঘুটে কালো রং মেখে বসে থাকে, সেই কালো আকাশ থেকে সারাক্ষণ পানি ঝরে পড়ছে, সেই পানি রাস্তাঘাটে জমা হয়ে প্যাকপ্যাকে কাদা সৃষ্টি করছে – এইসব চিন্তা করলেই তো মনটা খারাপ হয়ে যায়। একদল লোক আছে যারা সেই প্যাকপ্যাকে কাদা-পানিতে বৃষ্টিতে ভিজে মহা সুখে দাপাদাপি করে। কী যে আনন্দ পায় কে জানে! তারউপর ঢাকায় আবার কথায় কথায় হাঁটুপানি- কোমড়পানি-গলাপানি উঠে যায়। এত পানির মধ্যে থাকতে কারই বা ভাল লাগে!

শেষবার বর্ষা দেখেছিলাম বছর দুয়েক আগে। সেসময়ও বেশ ভালোই বৃষ্টি হয়েছিল। এবারও মনে হচ্ছে ভালোই বৃষ্টি হবে। তারমানে হচ্ছে আমার সময়টা খুব একটা ভালো কাটবেনা। তবে পদ্মার তেল চকচকে ইলিশ মাছ পাওয়া গেলে অবশ্য আলাদা কথা! হাতে গোনা যে ক’টা কারণে বর্ষাকে ভালো লাগে তার একটা হচ্ছে এই পদ্মার ইলিশ। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি আর ঘরের মাঝে গনগনে গরম ভুনা খিচুরির সাথে ইলিশ মাছের দোঁপেয়াজা – এই কম্বিনেশন একেবারেই তুলনাহীন! ছোট বেলায় অন্য কারণে বর্ষাকে ভালো লাগত – সেটা হচ্ছে বাংলা ২য় পত্রের রচনা। স্কুলের ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত টানা চার বছর প্রতি ক্লাসেই বছরের তিনটা সাময়িক পরীক্ষার কোনটা না কোনটাতে সবসময়ই ‘বর্ষায় বাংলাদেশ’ রচনাটা থাকতো। বর্ষাকাল প্রিয় না হলেও বর্ষাকালের রচনাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। প্রিয় হবার প্রধান কারণ ছিল এতে প্রচুর কবিতা ব্যবহার করা যেত। আগেই বলেছি যে বাংলার আপামর কবিসমাজ বর্ষা নিয়ে দিস্তা দিস্তা লিখে ফেলেছেন। বর্ষা নিয়ে যতটা লেখা হয়েছে অন্য কোন ঋতু নিয়ে তার ধারে কাছেও লেখা হয়নি। তাই বঙ্গকবিদের একের পর এক সৃষ্টি ‘তাই তো কবি বলেছেনঃ’ লিখে আমার রচনায় চালিয়ে দিতাম। বঙ্গকবিদের কাব্যরসে পরিপূর্ণ আমার রচনার সাইজ দাঁড়াতো টেনেটুনে প্রায় চৌদ্দ-পনর পৃষ্ঠা! এত বড় রচনায় আমাদের বাংলার ম্যাডাম কাত হয়ে যেতেন। আর বছর বছর ‘বর্ষাকাল’ রচনাটা বাইডিফল্ট পরীক্ষায় আসতে থাকায় প্রতি বছরই আমাদের স্কুলের বাংলা টিচারকূলের কেউ না কেউ হরহামেশা কাত হয়ে যেতেন! বছরের পর বছর ‘বর্ষায় বাংলাদেশ’ লিখে টিচারকূলকে কাত করতে করতে এমন অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম যে পরীক্ষার আগে আর রচনা পড়েই যেতাম না, পরীক্ষার প্রশ্ন দেখেই খাতায় হড়হড় করে লেখা শুরু করে দিতাম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, মেট্রিক পরীক্ষার সময় ‘বর্ষায় বাংলাদেশ’ টাইপের কোন রচনা আসলোনা, নাহলে আমি নিশ্চিত যে বোর্ডের বেশ কয়েকজনকে অবলীলায় ধরাশায়ী করা যেত।

ছোটবেলায় অবশ্য আরো একটা কারণে বর্ষাকাল ভালো লাগতো, রেইনিডে’র জন্য। খুব বেশি বৃষ্টি হলে স্কুলে রেইনিডে ঘোষণা দিয়ে স্কুল বন্ধ করে দেয়া হত। আর কোন ঋতুতে এভাবে দুপদাপ করে স্কুল বন্ধ হয় বলে শুনিনি। রেইনিডে’র জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষা করে থাকতাম। যখন রেইনিডে ঘোষণা দিত তখন আমাদের দেখে কে! স্কুল নাই – স্কুলপড়ুয়া একজনের কাছে এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে!

প্রতি বছর আষাঢ়ের পয়লা দিনে আমার আয়ু এক বছর করে কমে যায়। হিসেব অনুযায়ী মনটা খুব খারাপ থাকার কথা আমার। জীবন থেকে একটা বছর ছেঁটে ফেলা তো চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু তারপরও এ দিনেই প্রথমবার পৃথিবীর মুখ দেখেছিলাম বলে কেন জানি দিনটাকে খুব ভালো লাগে, খুব আপন লাগে, নিজের বলে মনে হয়। মনে হয় এদিন শুধুই আমার দিন, কারো কোন ভাগ নেই এতে! সেজন্যই হয়তো আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের জন্য বর্ষাকে খুব একটা খারাপ লাগেনা!


যাঁর কবিতার শিরোনাম দিয়ে আমার এই লেখাটার শিরোনাম, ১লা আষাঢ় ১৩৫৪ লেখা শচীন্দ্রনাথ সেনের সেই কবিতাটি নিচে দিয়ে দিলাম, বর্ষাপ্রেমী কাব্যপিপাসুদের মন ভরবে অন্তত!

আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে

আজি আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
কবি কালীদাসে পড়িল মনে,
অলকায় তিনি “মেঘদূত” রূপে
পাঠায়েছিলেন এমনি দিনে।
বিরহী যক্ষ বিনাইয়া কত
অলকার পথ চিনালো তারে,
তারি অনুরোধে নব জলধর
কত গিরি বন বেড়ালো ঘুরে।
নির্বাসিত হ’য়ে রাম গিরি ব’সে
যক্ষ তাহার প্রিয়ার ছবি
আঁকিল যে রূপে মেঘদূত পাশে
ভাষা দিল তারে অমর করি।
অতীত যুগের সেই দিন হতে
আজো সেই মেঘ মরিছে ঘুরে
খুঁজিয়া ফিরিছে অলকার পথে
যক্ষের প্রিয়া কোন সে দূরে।
ম’রে গেছে কবি কত যুগ হ’লো
মেঘদূত তার মরে নি সেযে
বাঁচিয়া রহিবে যুগ যুগ ধরি
বাঁচাতে কবিকে জগৎ মাঝে।
র’চে মেঘদূত কবি কালীদাস
উজ্জয়ীনির কোন সে কোণে
শত শত যুগ পরেও আজিকে
জগৎ তাহাকে তেমনি চেনে।
দেখি না বটে কবিকে আমরা
কোনো ক্ষোভ তাতে করি না আর
সকলি পেয়েছি হারাইনি কিছু
কাব্য নাটক কবিতা তার।
আজকে আবার পয়লা আষাঢ়
আসিল নবীন মেঘেরে লয়ে
যক্ষ প্রিয়ারে মেঘদূত পুনঃ
খুঁজিছে আজও কি উতলা হ’য়ে ?
রাম গিরি শিরে বিরহী যক্ষ
এখনও কি আছে তেমনি বসে ?
মেঘদূত তার প্রিয়ার খবর
ল’য়ে কি আবার আসিছে ভেসে।
কে আজ দানিবে উত্তর ইহার
কার কাছে পাবো সঠিক কথা
উদাস হয়েছে অন্তর আমার
ভাবিয়া যক্ষের বিরহ ব্যথা।

2 thoughts on “আষাঢ়স্য প্রথম দিবস”

    1. লিংক উল্লেখ করে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন, খুশি মনেই অনুমতি দিলাম! 🙂

Leave a Reply to Mskhaled BdCancel reply