রঙ্গীন দুনিয়া – ৫

অনেকদিন হয় ব্লগ লেখা হয়না। একটা সময় ছিল যখন সবকিছু নিয়েই কেবল ব্লগ লিখতে ইচ্ছা করত। ইদানিং আর সেই ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দেয়না। খামাখা ব্যস্ততা আমার। কোন কিছুই তেমন করা হয়না, তারপরও কীভাবে কীভাবে যেন দিন চলে যায়। কোন কিছুই ভালো লাগেনা। পরিবার-পরিজন ছাড়া তিন মাস টানা কোথাও কখনো থাকা হয়নাই। তিন মাস! নেদারল্যান্ডসে এসেছি তিন মাস হয়ে গেছে, দিন গুলো কীভাবে কীভাবে চলে যায়! মনে হয় যেন গতকালকে সকালে সবাই আমাকে বিদায় দিয়ে প্লেনে তুলে দিল, আর ক্যালেন্ডার বলছে তিন তিনটা মাস! যাই হোক, এই লেখাটা অনেকদিন ধরেই লিখছিলাম। নতুন পুরনো অনেক কথাই এখানে চলে এসেছে। একেবারে খসড়া খাতা থেকে তুলে দিলাম…

স্প্যাম

আমার জিমেইল স্প্যামবক্স প্রতিদিনই গড়ে ১৫টার মত স্প্যাম ধরে! আর স্প্যামের বাহার কী! কেউ আমাকে লটারিতে মিলিওন মিলিওন ডলার দিচ্ছে, কেউবা আবার আমার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ চিন্তিত! তবে এইসব স্বাস্থ্যবিষয়ক চিন্তাবিদদের ধ্যানধারনার সাথে ফার্মগেটের খুজলীওয়ালাদের অনেক মিল। পৃথিবীতে যে এত শক্তি-বর্ধক বা বল-বর্ধক ঔষধ পাতি আছে তা এদের মেইল না পেলে বুঝতামনা। ইদানিং আবার মরা কোটিপতিদের উৎপাত বেড়েছে। প্রায়ই মেইল আসে যে, নাইজেরিয়া বা আরবের কোন কোটিপতি অমুক ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকা রেখে মারা গেছে, সেই টাকার কোন দাবীদার নাই। তো ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছে যেন আমি সেই টাকাটা তুলে নেই, সেজন্য অবশ্য তাকে ভাগ দিতে হবে। একবার তো ইংল্যান্ডের এক ধনীর দুলালী আমাকে মেইল করল তাকে বিয়ে করার জন্য! তার মেইলের ভাষা ছিলো অনেকটা এইরকমঃ তার বাবা বিশাল ধনী। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বাবা সুইজারল্যান্ডে ব্যবসায়িক কাজে গিয়ে আততায়ীর হাতে খুন হয়। এখন সুইসব্যাঙ্কে ভদ্রলোকের প্রচুর টাকা যার একমাত্র উত্তরাধিকারী হচ্ছে আমাকে পত্র লেখা এই কন্যা। কিন্তু সে এই টাকা নিতে পারছেনা, কারন তার (ভিলেন) চাচা তাকে ঘরের বাইরে যেতে দিচ্ছে না, যদি আমি তাকে বিয়ে করি তবে সে তার চাচার অধীন থেকে মুক্ত হয় আর আমার সাথে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে টাকা নিবে, আমাকে টাকার শেয়ার দিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। হায়রে নাদানের কপাল! এইসব মেইল আসবি যখন ভালোভবেই আয়, স্প্যাম হয়ে কেন যে আসে!

ম্যাক্সপেইন

ম্যাক্সপেইন গেমের সাথে পরিচয় ইন্টারে থাকতে। যদ্দূর মনে পড়ে, চাচাতো ভাই আরেফীনের কাছ থেকে গেমটার সিডি নিয়েছিলাম। টানা সাতদিনে শেষ করেছিলাম গেমটা। কী একখান গেম! বুঝাই যায়না যে গেম খেলছি না মুভি দেখছি। এমনো হয়েছে যে যখন খেলছি তখন পিছন থেকে দেখে অনেকে জিজ্ঞেস করেছে যে এই মুভিটার নাম কি! তো যখন দেখলাম যে এই গেমের মুভি মুক্তি পেয়েছে, মোটেও দেরী করলামনা। দ্বিতীয় সপ্তাহের মাথায় গেলাম মুভি দেখতে প্যাথে সিনেমা হলে, সঙ্গী এরিক। পাঁচটার সময় গিয়ে শুনি যে নেক্সট শো হবে ছয়টায়, এক ঘন্টার ধাক্কা! দুইজনে কিছুক্ষন খাওয়া দাওয়া করে, সিনেমাহলের সামনে রাখা ফ্রী পিএস-থ্রী তে গেম খেলে ছয়টার কিছু আগে ঢুকলাম সিনেমা হলে। এবং আমরা দুজনেই ছিলাম সেই শোর প্রথম দুই দর্শক- পুরা হল খালি!

আমার সন্দেহ হল আমরা বোধহয় ভুল করে অন্য কোন হলে ধুকে গেছি (কারন এরকম আরো আটখান থিয়েটার হল আছে ঐ কম্পাউন্ডে)। এরিক দেখি নির্লিপ্তভাবে সামনের অন্ধকার পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে বললাম আমার সন্দেহর কথা কিন্তু ও পুরা নিশ্চিত যে আমরা ঠিক হলেই ঢুকেছি। আমি যখন প্রায় নিশ্চিত যে আমরা ভুল জায়গায় খামাখা বসে আছি তখন দেখি দুইজন-চারজন করে লোকজন ঢুকছে। দুইজন-চারজন বললাম এই কারনে সবাই জুটি বেঁধে একে একে ঢুকছে। মারমারকাটকাট ছবি দেখতে প্রেমিক জুটি আসে এই প্রথম দেখলাম! (আমার ধারনা ছিলো কেবল রোমান্টিক আমি-তুমি মার্কা ছবিগুলো কেবল জুটিরা দেখে।)

একেরপর এক এ্যাড দেখিয়ে যখন ছবি শুরু হল তখন আমার আক্কেল গুড়ুম! কারন ছবি শুরু হল একটা মিষ্টি মিষ্টি গানের সুর দিয়ে। ম্যাক্স পেইনের মত ভয়াবহ মারামারির ছবিতে এরকম মিউসিক বেশ দুঃখজনক। কোথায় রক্ত গরম করা মিউজিক থাকবে তা না কেমন একটা শান্তি শান্তি ঘুমপাড়ানি মিউজিক! এরপরের কাহিনী আরো হতাশাজনক। স্ক্রীনজুড়ে এক টিনেজ মেয়েকে রঙ্গিন জামা পড়ে ছুটোছুটী করতে দেখা গেল- যেকোন রোমান্টিক ছবির প্রথম দৃশ্য। এইবার আমি ড্যাম শিওর যে এরা ভুল ছবি ছেড়েছে। হলের মধ্যে দেখি সবাই আমার মতই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এরিককে বললাম যে চলো কমপ্লেইন করে আসি। এরিক সাদাসিধা মানুষ- ঝামেলায় যেতে চায়না, বলল এইটাই দেখি সমস্যা কি! ছেলে বলে কি! খামাখা ২০ ইউরো দিয়ে এই ফাউল টিন-মুভি দেখতে আসছি নাকি! ততক্ষনে স্ক্রীনে টিপিক্যাল টিনেজ মুভির মত হাই স্কুলের করিডর ধরে নায়কের বাস্কেটবল নিয়ে দৌড় শুরু হয়ে গেছে। কপাল ভালো, কিছু সহৃদয় জুটি তখনই উঠে কম্পলেইন করায় ম্যাক্সপেইন শুরু হয়।

দেখলাম ম্যাক্সপেইন, এবং দেখে হতাশ হলাম! কেন হতাশ হলাম সেটা ঠিক বোঝাতে পারবনা। যারা গেমটা খেলেছে তারাই কেবল মুভিটা দেখে আমার হতাশাটা উপলব্ধি করতে পারবে।

ফেসবুক

আইইউটিতে যখন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র তখন দেখি পোলাপান সব ধুমায়ে হাই-ফাইভ নামের ওয়েবসাইটে একাউন্ট খুলছে। জিনিসটা কি তখন বুঝিনাই। পোলাপানের পাল্লায় পড়ে আমিও একটা খুলে ফেলি। ওই খোলা পর্যন্তই, এরপরে সেই একাউন্ট আর ব্যবহার করা হয় নাই। ফোর্থ ইয়ারে থাকতে একদিন দোদুল বলল ফেসবুকে একাউন্ট খুলতে। স্বাভাবিকভাবেই আমার মত নাদানের মনে প্রশ্ন আসে কি এই ফেসবুক? গুঁতাগুঁতি করে বুঝলাম এইটা সেম কাহিনী। তাও কী মনে করে যেন একাউন্ট খুলে ফেললাম। একসময় মিসতিরী হিসেবে পাশ করলাম। তারপর দিপুর চাপাচাপিতে অরকুটে আরেকখান একাউন্ট খুললাম। আমার সোশাল সাইটে ঘুরাঘুরির পর্ব এইখানেই শেষ হয়ে যেত, যদিনা বছর খানেক আগে ফেসবুকে অনেকদিন পর আবার লগইন না করতাম। লগ ইন করে দেখি প্রচুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, সব আমার আইইউটির বন্ধুদের কাছ থেকে, যাদের কে আইইউটি ছাড়ার পর ভয়াবহভাবে মিস করছিলাম। রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করার পর দেখি ফেসবুকে ভালোই লাগে। সপ্তাহে তাই একদিন অন্তত লগইন করতাম। তারপর দেশ ছেড়ে চলে এলাম। দেশ ছাড়ার পর দেখি প্রায় প্রতিদিনই আমি ফেসবুকে ঢুঁ মারি। সব বন্ধুদের সাথে আলাপ চলে, কেউ হয়ত কোন ছবি আপলোড করলো কেউ হয়ত প্রোফাইল স্ট্যাটাস বদালালো, সাথে সাথে চলে কমেন্টের বন্যা। খুব এনজয় করি এই ব্যাপারটা। আরো মজার ব্যাপার হল, আমি বেশ কয়েকজন স্কুলের পুরনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। আমি যদিও খুব একটা কমেন্ট করিনা বা ওয়াল পোস্ট করিনা তবুও বন্ধুদের প্রোফাইল ঘুরতে মজা লাগে, বেশ মজা লাগে। ফেসবুকে একাউন্ট খোলার সময় যে ব্যাপারটা একদমই চিন্তা করিনাই সেই ব্যাপারটা ঘটছে এখন- আমি ফেসবুক এ্যাডিক্ট হয়ে যাচ্ছি!

বরফ! বরফ! বরফ!

জীবনে প্রথম বারের মত বরফ দেখলাম। এবং প্রায় তিন ধরনের বরফ। এবং সবগুলোই আকাশ থেকে পড়া! প্রথম ধরনের বরফগুলো দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের শিলাবৃষ্টির মত সাইজের। এরপরের ধরন হল এগুলোর চেয়ে কিছু ছোট আকারের, রাস্তার পাশে জমে থাকলে দেখে মনে হয় যেন চিনি জমে আছে। আরেক ধরনেরটা হল যেটা ইংলিশ সিনেমাতে প্রায়ই দেখা যায়, সোজা কথায় আকাশ থেকে বরফ পড়ছে শুনলেই যেটার কথা মনে হয়, পেঁজা তুলার মত বরফ। গায়ে পড়লে একেবারে ঠান্ডা তুলার মত লাগে। চারপাশ পুরো সাদা হয়ে যায়, একেবারে ধব্‌ধবে সাদা! মনে হয় যেন কেউ সাদা চাদার দিয়ে সব কিছু মুড়ে দিয়েছে। এইখানে আমেরিকা বা কানাডার মত অত তুষার পড়েনা। তাই এগুলোর স্থায়িত্ব হয় খুব কম। তবে এই কম সময়েই যতটুকু দেখেছি তাতেই সারা জীবনে কোনদিন বরফ না দেখার দুঃখ হাওয়া হয়ে গেছে!

পাতা ঝরা দিন

পাতা ঝরছে, শুধু হেগ না পুরো নেদারল্যান্ডেই ঝরছে। রাস্তার উপর পাতা জমে স্তুপ হয়ে থাকে। সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এসে ব্লোয়ার মেরে পাতাগুলোকে রাস্তার দুপাশে সরিয়ে দিয়ে যায়। বাতাস হলেই গাছগুলো পাতা ঝরিয়ে দিচ্ছে। একসময় যে গাছগুলোকে সবুজের আঁধার বলে মনে হত সেগুলোই এখন একেবারে শুকনো ডালপালাসর্বস্ব জিরজিরে দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ সময়ই আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে। বাংলাদেশের মানুষ আমি। দিনের বেলা রোদ দেখে অভ্যস্ত। এইভাবে মেঘে ঢাকা আলো আধারিময় দিন দেখে তাই মন খারাপ লাগে। মনে হয় যেন প্রকৃতি থেকে সমস্ত আনন্দ যেন শুষে নেয়া হয়েছে, কেউ যেন প্রকৃতির রঙকে গ্রে স্কেলে কনভার্ট করে দিয়েছে! মাঝে মনে হয় আমার মনের অবস্থার সাথে বেশ মিল খেয়ে যায়। দেশের ফেলে আসা দিনগুলো কোনমতেই ভুলতে পারিনা। মাত্র শখানেক দিন হয়েছে দেশ ছেড়েছি কিন্তু মনে হচ্ছে যেন সময়টা হাজার বছর!

Leave a Reply